“ভগবানের বাড়ি” ও দুই ভগবান

কমল সরকার on

পাশের পাড়া থেকে এক দাদু আসতেন মামার বাড়ি । অন্ধ । চোখদুটোর দিকে তাকিয়ে দেখেছি , মণিদুটো সাদা । বোধ হয় ছানি পড়েছিল কোন একসময় , অপারেশন করা হয়নি । হয়তো সামর্থ্য ছিল না বলেই । কোমর সমান উঁচু একটা লাঠি নিয়ে ঠক ঠক ক’রে রাস্তা বুঝে তিনি ঘুরে বেড়াতেন এপাড়া ওপাড়া , কাজে অকাজে । তাকে নিয়ে সবাই বেশ রঙ্গ-তামাশা করত । ছেলে বুড়ো সকলেই । কতকটা তাঁর নিজেরই রসবোধের কারণে , কতকটা তাঁর অন্ধত্বের সুবাদে । বারকয়েক পাকনাড়া ক’রে ছেড়ে দিয়ে কেউ বলত, “কইন দেহি , আপনের বাড়ি যাওনের রাস্তা কুন্‌দিকে ?” । তিনি আন্দাজ ক’রে একটা দিকে হাঁটা লাগালেন, ঠিক হলে সবাই বাহবা দিচ্ছে , ভুল হলে হাসিতে ফেটে পড়ছে । এমনই আরো অনেক ।
একবার তিনি এসেছেন মামার বাড়ি নিমন্ত্রণ দিতে । বাড়িতে রাতে কীর্ত্তন হবে । তার নিমন্ত্রণ । এসে বললেন , “আউজগা কীত্তন আচে গো । তুমরা যায়ো ।”
কেউ জিজ্ঞেস করল , “কার বাড়ি গো , কাহা ? কার বাড়ি কীত্তন?”
— ভগবানের বাড়ি ।
— ভগবানের বাড়ি ! হেইডা আবার কার বাড়ি ?
— আরে আমার বাড়ি ! আর কার বাড়ি হইবো ?
— তা , আপনে কি ভগবান নাকি ?
— আমিই ত ভগবান । আমি না ত আর কেডা ?
একটা হাসির ঝলক ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে ।
ফেরার পথে দাদু বললেন, “আমারে কেউ ইট্টু আউগ্যাইয়া দিবে রে ? হেই জীবনরা বাড়ির সামনে কোট্টি গোরু বাঁইন্দ্যা থইসে । বড় ত্যাঁন্দর !”
ডাক পড়ল আমার । সকলের ফাইফরমাশ খাটার অবৈতনিক হোলটাইম সার্ভার ।
দাদুকে ধরে ধরে নিয়ে যাচ্ছি আমি । মামার বাড়ি থেকে বেরিয়ে কিছুটা এগিয়ে রাস্তা দু’দিকে চলে গেছে । ইংরাজি ‘T’ অক্ষরের মত । ডান দিকে গিয়ে রাস্তাটা আবার সমকোণে বাঁক নিয়েছে । এই বাঁকের কাছেই জীবনমামার বাড়ি । আর এই বাঁকটাতেই সুপারি-শিমুল-আম গাছে বাঁধা আছে গরু । দাদুর জন্য প্রথম বিপত্তি । দ্বিতীয় বিপত্তি — রাস্তার পাশের জমি থেকে মাটি কেটে রাস্তা উঁচু ও চওড়া করা হয়েছে । ফলে রাস্তার পাশেই খাল । তৃতীয় বিপত্তি — ঐ রাস্তার বাঁ-পাশ ঘেঁষে বাশঁঝাড় । এমাথা থেকে ওমাথা — পাকা রাস্তার আগে পর্যন্ত । বাঁশের কঞ্চি নুইয়ে পড়েছে রাস্তায় । কেউ কেউ বাঁশ কেটে নিয়ে গেছে — রাস্তায় পড়ে রয়েছে বাঁশের ডগা আর কঞ্চি । আমরা যারা চোখে দেখি তারা কঞ্চিকাঞ্চা দেখে নিয়ে সাবধানে হাঁটতেই পারি । কিন্ত একজন অন্ধের পক্ষে !!!
নিয়ে যাচ্ছি দাদুকে । ছোটমামার মুখোমুখি । আমার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন । কিন্তু কিছু না বলে প্রশ্ন করলেন দাদুকে , “কী গো কাহা ? কই গেইস্‌লাইন ?”
— গেস্‌লাম তরা বাড়িতই । নিমন্তন দিয়া আইসি ।
— কিয়ের নিমন্তন ?
— কীত্তন ।
— কারা বাড়িত ?
—ভগবানের বাড়িত ।
ছোটমামা না বুঝে জানতে চাইলেন , ভগবানের বাড়িটা আসলে কার বাড়ি । দাদু বললেন, “আমরা বাড়িত” ।
উত্তর পেয়ে ছোটমামা এবার আমার দিকে তাকালেন , “তুই কই যাস?”
আমি কিছু বলার আগেই দাদু বলে উঠলেন , “অ্যা আমারে ইট্টু আউগ্যাইয়া দিতাসে । দেহস না রাস্তাডার মইদ্যে কোট্টি গোরু বাঁইন্দ্যাই থইসে ! কিরম আক্কেলডা কসেন দেহি ! মানুষজন যায় কিবায় ?”
— হ । সাবধানে যাইনগো কাহা ।
দাদুকে বলে এবার আমার দিকে ছোটমামা , “হেনো গিয়া আবার লইটকা পড়িস না কিসুত । তাড়াতাড়ি আয়া পড়বে ।”
প্রথম বিপত্তি পার হলে দাদু বললেন , “অহন আমি পারবাম রে যাইতে । তুই যা গা । আর আওন লাগদো না ।”
— পারবা যাইতে ? বাড়ি অবদি আগায়া দেই ?
— না রে ছ্যাড়া । পারবাম ।
ছেড়ে দিলাম দাদুকে । কিন্তু আমি চলে এলাম না । দেখছি দাদুকে । লাঠি দিয়ে ঠক ঠক ক’রে রাস্তা চিনে নিচ্ছেন । বার দুয়েক কঞ্চিতে আটকে থমকেছেন । আমি কোন সাড়াশব্দ না ক’রে গেলাম দাদুর কাছে । পেছন পেছন আছি ।
কিন্তু ধরা পড়ে গেলাম । দাদু বুঝে ফেলেছেন যে আমি যাইনি, তার পেছনেই আছি ।
— কী রে ছ্যাড়া । যাস নাই ?
আমি চুপ ক’রে রইলাম ।
— কী রে ? রাও করস না ক্যারে ?
— না , যাই নাই । তুমারে বাড়ি অবদি আগায়া দেই ।
— তরে যে যাইতে কইলাম , তুই যাস নাই ক্যান ক’ শুনি ।
— রাস্তাত অনেক কইঞ্চা পইড়া আচে । যুদি উস্‌টা খায়া পইড়া যাও !
— হে হে হে । কি মনে করস ? চোক নাই দেইখ্যা কি দেখতে পাই না ? ঠিহই দেখতে পাই রে ছ্যাড়া । সব দেখতে পাই । আয় , লগে লগে আয় ।
“লগে লগে” গেলাম দাদুর বাড়ি — “ভগবানের বাড়ি” । সারা রাস্তায় দাদুকে আর একটিবারের জন্যও ধরে রাস্তা দেখাতে হয়নি । দাদুর বাড়ি যখন ঢুকছি , দু’পাশে চালতার গাছগুলো দেখলাম । বেশ বড় হয়েছে চালতাগুলো । দেখে আমার মনে সাধ জেগে উঠল “টক” (চাটনি) খাওয়ার । আমি যেহেতু দাদুকে বাড়ি আসতে সাহায্য করেছি তাই বিনিময়ে কিছু আবদার করে বসলে এই বেলা আমাকে “না” বলতে পারবেন না — এই বিশ্বাসে সাহস ক’রে কথাটা বলেই ফেললাম, “দাদু ! আমারে দুইটা চালতা দিবা ? টক খামু ।”
—টক খাওনের মনো লইসে তর ?
আমি চুপ ক’রে রইলাম ।
— তরে যুদি কেউ টক বানায় না দেয় , তাইলে ?
— তাইলে ?
— হুম । তাইলে ? কী করবে ?

— তাইলে শিলপাডাত ছেঁইচ্যা লবণ মাইখ্যা খায়ালামু ।
— হে হে হে ।
— দিবা ?
— দিয়ামনে । আয় ।
ঢুকলাম বাড়ির ভেতর । উত্তর , দক্ষিণ ও পশ্চিমদিকে তিনটে ছাপড়া ঘর । দক্ষিণ দিকের ঘরটার সঙ্গে লাগোয়া আরেকটা একচালা । পাটকাঠির বেড়া । এখানে ওখানে ভাঙা । পূবদিকে ছেঁড়া ত্রিপল দিয়ে রোদ-বৃষ্টি ঠেকানোর চেষ্টা । ঘরের ভেতরে বাঁশের মাচার বিছানা । এই ভাঙা ঘরেই থাকেন এই বাড়ির ‘ভগবান’ ।
বাড়িতে ঢুকে দাদু হাঁক পেরে ডাকলেন তাঁর এক মেয়েকে , “এই ছ্যাড়াডারে দুইডা চাইলতা দেসে দেহি ।” নাতনি দেখল আমাকে । রান্নাঘর থেকে দুটো চালতা এনে দিল । আমি দু’হাতে চালতা দুটো নিয়ে বললাম , “আমি যাই তাইলে ।” বলে রওনা দিলাম ।
দাদু বলে উঠলেন , “খাঁড়ো । খাঁড়ো । ”
দাঁড়িয়ে পড়লাম, “কী ?”
আমার “কী ?”-র উত্তরে দাদু কী বলেন শোনার জন্য তাকালাম দাদুর দিকে । দাদু আমাকে কিছু না বলে ডাকলেন তাঁর মেয়েকে , “পূজার লাইগ্যা যে ফলমূলডি আনাইসি , কই থইচস রে ?”
— আচে ঠাহুরঘরো ।
— দেসে, এই ছ্যাড়াডারে একটা আফেল আইন্যা দে । খাক ছ্যাড়াডা । আমারে সারাডা পথ ধইরা ধইরা বাড়িত আনসে ।
— হেইডি ত পূজার লাইগ্যা বাবা । ছঁওন যাইতো না ।
— থ ফালায়া তর পূজা ! যেইডা কইসি হেইডা কর । পূজা আমরা করি কেল্লাইগ্যা ? ভগবানের লাইগ্যা ত ! তে, ভগবানই ত বাড়িত আইসে । দে , হেরে আফেল দে একটা ।”
আমি অবাক চোখে তাকালাম দাদুর দিকে । দাদুর কথার অন্তর্নিহিত অর্থ বোঝার বয়স সেটা নয় । তবু , দুটো জিনিস বুঝতে অসুবিধা হল না আমার । এক , উঁনি আমাকেও ভগবান বলেছেন । দুই, আমি একটা আপেল পেতে চলেছি । সেটাও আবার পূজার জন্য বরাদ্দ থেকে !
অনিচ্ছা সত্ত্বেও দাদুর মেয়ে একটা আপেল নিয়ে এল । আমার দুই হাতে দুটো চালতা । এবার আপেল নিই কী করে ? চালতা দুটো মাটিতে রেখে বাঁ-হাতে পরনের স্যান্ডো গেঞ্জিটা তুলে ধরলাম । চালতা দুটো চালান ক’রে দিলাম গেঞ্জিতে । ডান হাতে নিলাম আপেল ।
“আমি যাই অহন” বলে বেরিয়ে এলাম ।
এক “ভগবানের বাড়ি” থেকে বেরিয়ে এসে আপেল খেতে খেতে বুক ফুলিয়ে রাস্তায় হাঁটছি আরেক ভগবান — যার বাঁ-হাতের মুঠি গেঞ্জির ভেতর ধরে রেখেছে “টক” খাওয়ার দুটো চালতা আর ডান হাতে ভগবানের পূজার প্রসাদ ।।

 ........................

ফেসবুক অ্যাকাউন্ট দিয়ে মন্তব্য করুন


কমল সরকার

জন্ম ১৬-০৫-১৯৮৩। বাড়ি বর্তমান আলিপুরদুয়ার জেলা ও অসম সীমান্তের গ্রাম বারোবিশায়। শৈশব কেটেছে কোচবিহার জেলার ভোগডাবরি কেশরিবাড়ি নামক গ্রামে মামার বাড়িতে। প্রাথমিক শিক্ষা সেখান থেকেই। এরপর বারোবিশা থেকে মাধ্যমিক। অতঃপর ফালাকাটা, জলপাইগুড়ি এবং উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরবর্তী শিক্ষা । পেশায় রসায়নের শিক্ষক । বর্তমানে শিলিগুড়ির কাছে কর্মরত । ছোটবেলায় মামারবাড়িতে থেকেই একটি ছোট্ট অভিমান থেকে লেখালেখির শুরু । শখ সাহিত্যচর্চা, ভ্রমণ ও লেখালেখি ।

0 Comments

মন্তব্য করুন

Avatar placeholder

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।