শিল্পকলা দিবসে যুদ্ধের বিরুদ্ধে রঙ-তুলি দিয়ে প্রতিবাদ বালুরঘাটের শিল্পীদের
১৫ ই এপ্রিল বিশ্ব শিল্পকলা দিবস উপলক্ষ্যে এক মনোজ্ঞ কর্মকান্ডের পরিচয় বহন করে রাখলো দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার বালুরঘাট শহরের একদল শিল্পী। রঙ-তুলির আঁচড়ে ফুটে উঠলো যুদ্ধ বিধ্বস্ত মানুষের কথা। আর এই কাজের জন্য বেছে নেওয়া হলো শহরের একটি গুরুত্বপূর্ণ দেয়ালকে যা নিজেও শতাব্দী প্রাচীন ইতিহাসকে বয়ে নিয়ে চলেছে। জেলা আদালত সংলগ্ন এই দেয়ালটি যা শহরের শতাব্দী প্রাচীন বালুরঘাট উচ্চ বিদ্যালয়ের ঠিক পাশেই অবস্থিত , তার খাঁজে খাঁজে ফুটে উঠলো ব্যথা ও যন্ত্রনার দলিল।
মোট ১২ জন শিল্পী ৬ ফুট চওড়া ও ১৯০ ফুট লম্বা এই দেয়ালে ফুটিয়ে তুললেন তাঁদের নিজস্ব স্বাক্ষর। পুরো কর্মকান্ডটি চললো ‘ আতস ‘ শিল্পগোষ্ঠীর তত্ত্বাবধানে।
প্রায় পাঁচদিন ধরে চলা এই শিল্পকলা প্রদর্শনীতে শিল্পী নেপাল দাস ফুটিয়ে তুললেন এক ঐশ্বরিক হাত , যা ভেদ করে একেকটা মিসাইল ও রূপান্তরিত হচ্ছে ফুলের কুঁড়ি হিসাবে। সাদা রঙের সুচিন্তিত ব্যবহার এই ছবিকে অসম্ভব মনোগ্রাহী করে তুলেছে।
শিল্পী শুভ্রদীপ চৌধুরীর ছবিতে ধরা দিলো যেন এক মহাকাল। পাখির মতো নির্বিচারে মরতে থাকা মানুষ যার কোলে শেষ ঘুমে মগ্ন। তিনি ক্রুদ্ধ অথচ অসহায়। ব্যাকগ্রাউন্ড এ বর্ষবলয় যেন যুগের পর যুগ ধরে বয়ে চলা ঘটমান অতীতের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। এই ছবিতে রাস্তায় থাকা একটি চারাগাছের বাস্তবিক ছায়াকে শিল্পী তাঁর নিজস্ব মুন্সিয়ানায় যেভাবে ছবিতে ব্যবহার করেছেন তা তাঁর জাত চিনিয়ে দেয়।
শিল্পী শুভদীপ পাল যুদ্ধকে ধরেছেন শরীরী ভঙ্গিতে। শরীর , সঙ্গম ও যুদ্ধ এখানে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।
নিত্যম সিংহ রায়ের ছবিতে স্বপ্ন দেখছি আমরা। আশার আলো , বাঁচার স্বপ্ন নিয়ে এখানে এক শিশুকন্যা ভালোবাসার বেলুন হাতে নিয়ে উড়ে চলেছে। অলক্ষ্যে ধ্যানস্থ বুদ্ধের চোখ যেন সমস্ত ঘটনার স্বাক্ষী।
শিল্পী সিদ্ধার্থ দাসের ছবিতে এক উড়ন্ত মানুষ ভেদ করে এগোতে চাইছে লাশের পাহাড়। ফিগার ড্রয়িং এর অনবদ্য ব্যবহার এই ছবির মূল আকর্ষণ।
শিল্পী সৈকত ঘোষের ছবিতে ফুঁটে উঠেছে যুদ্ধবিদ্ধস্ত পৃথিবীতে এক শিশুর মনোজগত। অদ্ভুত এক মায়া জড়িয়ে আছে এই ছবির দৃশ্যপট জুড়ে।
শিল্পী ঋতুপল বিমূর্ত ভাষায় ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁর ছবির ভাষা। সীমিত রঙের ব্যবহারেও তাঁর ছবি হয়ে উঠেছে অনবদ্য। হাতে আঁকা ছবিও এক্ষেত্রে হার মানাচ্ছে ডিজিটাল আর্টকে।
শিল্পী সুদীপ সাহা ছিমছাম পরিবেশনায় ধরতে চেয়েছেন যুদ্ধের রাজনৈতিক অভিসন্ধি। এক কাগজেই শুরু যুদ্ধ আবার এক কাগজেই শান্তিচুক্তি , যা বারবার মনে করিয়ে দেয় যুদ্ধ আসলে রাষ্ট্র – রাষ্ট্র খেলা।
শিল্পী মৃন্ময় মন্ডল এই যুদ্ধের পৃথিবীতেও শান্তির কথা বলেন। প্রেমের কথা বলেন।
শিল্পী অর্ণব সাহা আলোর মূর্ছনায় ধুইয়ে দিতে চান যুদ্ধের সমস্ত কালো অধ্যায়।
শিল্পী রানার ছবিতে ফুঁটে ওঠে এক যুদ্ধ বিদ্ধস্ত ট্যাংক। যেখান থেকে পালিয়ে বাঁচতে চাইছে রঙ – তুলি হাতে এক শৈশব।
শিল্পী মনোজ এক ঐশ্বরিক ত্রিনেত্র থেকে নির্গত শাখা-প্রশাখায় ধ্বংস করে দিতে চান সমস্ত যুদ্ধাস্ত্র।
শিল্পী সম্পা সাহার ছবিতে দাবার চালে যুদ্ধ আসে , যা আরেকবার মনে করিয়ে দেয় যে রাষ্ট্র না চাইলে যুদ্ধ আসে না।
দেশ ও রাজ্য জুড়ে ও সর্বোপরি সমগ্র পৃথিবী জুড়ে যে অশান্তির আবহ তার জলজ্যান্ত স্বাক্ষর হয়ে উঠলো বালুরঘাটের শিল্পীদের এই সম্মিলিত আয়োজন। ছাপ রেখে গেল একটি সময়ের দলিল রূপে। ভবিষ্যতে আরো বিচিত্র ভাবনা ও আঙ্গিকে তাঁরা নিজেদের সাক্ষ্য বহন করবেন এই আশা রেখেই আপাতত আগামীর পথ চলা।
0 Comments