হাতেম ছৈয়াল…

চৈত্রী ব্যানার্জী on

hatem_chayal

এ মানুষটা সম্পর্কে লিখতে বসলে কোনো তত্ত্বকথার অবতারণা করা চলে না।
কোনো সাহিত্য নির্ধারক তরাজু তে প্রখর করে মাপা চলে না।
মূলত লেখ্য ভাষার যেকোনো অনুষঙ্গের সাথে এই মানুষটিকে জুড়ে দিতে ভালোই লাগে না।
এ মানুষটা গল্পের;
…গল্পের দুখের ও গল্পের বুকের।

সেই যে বেলা ডোবার আগে আগে মজনু শাহের হাজার হাজার বেশুমার ফকিরদের সাথে করতোয়ার দিকে ছোটার সময় বন্দুকের গুলিতে মরে পড়ে গিয়েছিলো যে মুনিশ, তার‌ই মতো করে রাতের পাঁকে ডুবে মরেছে হাতেম।
কাফন দাফন সব র‌ইলো বাকী,
কেবল জ্যান্ত ধড়মুন্ডু খানা ঘোরে ও বেঘোরে অবশেষ তেঁতুলতলা খুঁজে পেলো মরণের।।

কে এই হাতেম??

সেই যে… রোদের মধ্যে রোদ হয়ে মিশে যে বিলের পানিতে তাপ দেয় আর হাপসে গেলে তেঁতুল গাছের জিরিজিরি পাতার আড়ালে হরিয়াল পাখির ডানার তলে লোমের মধ্যে লোমশিশু হয়ে হরিয়ালের নরম মাংসের ওমে টানাআআ ঘুম দেবে বলে রাত জাগে…
সেই অগাধ তন্দ্রাই হাতেম ছৈয়াল।

অথবা অবলা পক্ষীর জাত, যার ঠাঁইটুকু তেঁতুলতলা।
যে পাখি পিটপিটিয়ে দেখে শুধু, টগর কোনোদিকে ফোটে।

আর যেসমস্ত বক শরাফতের পেয়ারের জীব, যাদের বাঁচার নসীহত আয়াৎ নিয়ে , হায়াৎ নিয়ে,
তাদের কাছে ছৈয়াল শাপলার ডাঁটার মতো লকলকে; নরম অথচ মাথায় ফুলভার, সে ফুলের প্রতিটা পাপড়ির নয়তোন নাম।।

নাগরিক স্হিতিসংকট,
মানুষ-মানুষীর পরিচায়ক ধোঁয়াশা ও রাষ্ট্রীয় স্যান্ডুইচ মেকানিজম্ , হাতেম কে আর দশটা লাইনধরা বাপ বানায় বড়োজোর, কিন্তু পূর্ণতা দেয় না, এমনকি অপূর্ণও রাখেনা।
নয়তোন থাকে চাল ছেঁড়া একচিলতে আলো হয়ে,
মোমেনা থাকে ছায়া হয়ে,
মৈদুল হাজী রাষ্ট্র হয়ে,
আর বেঁকাহরি থাকে সর্বজনহর সিস্টেম এর ব্রেইনোয়াশড্ মেটাফর হয়ে।

হাতেম চরিত্রের নির্মাণে লুৎফর রহমানের সার্থকতা এই যে , ঝোলভাত আর রুটি আলুভাজার ফারাক টুকু তিনি ধরে রাখতে পেরেছেন। তাই গরম ভাত আর মজগুরের ঝোল এখানে অন্তর্হিত দৃশ্য। বোঝা যায়, কিন্তু দেখা যায় না। কারণ ঝোলেভাতে সিনেম্যাটিক করা চলে না হাতেম ও মোমেনা কে।
তবে মোমেনা নিয়ে বিশেষকিচ্ছু বলবার পরিসর লেখক রাখেননি। যে আদোল যে গড়নে তাকে গড়েছেন, যে গৃহ ও সমাজের কাঠামের চূড়ায় তার বাস, সেখান থেকে যতখানি সিঁড়িভাঙা সম্ভব, ততখানিই ভেঙেছেন। নাটকীয় অতিশয়তায় তাকে অকারণ আবেগমেহুল করবার প্রয়াস করেননি। যতটুকু সঙ্গত না হয়েও সংগতিপূর্ণ ততটুকুই রেখেছেন। হাতেম চরিত্রের ব্যাপ্তজলের পাশে মোমেনা যেন জেগে ওঠা মৈদুলের চরা। রাতব্যাপী জ্বলে থাকা পিলসুজের মৃদু আলোর পাশে দপ্ করে জ্বলে ওঠা ক্ষণস্হায়ী শিখা। সমস্ত নামাজের শেষ মোনাজাত।

তবে সব দিক থেকেই অনেক বেশি পূর্ণ চরিত্র সদরালির বৌ। এই চরিত্রের ভিলেনিস্টিক অ্যাপ্রোচ কে বড়শিগাঁথা করে বাংলা সাহিত্যে বড়ো মজগুর তুলেছেন লেখক। অনায়াসেই বলিয়েছেন,
বাপ খাচ্ছে মজগুরের ঝোল,
মেয়ে খাচ্ছে ঝাঁটার হেড়ো।

নারী মনস্তত্ত্বের আরেক স্ফুরণ দেখি পুন্দার বৌর চরিত্রে, আখেরে চুরিও যার আখেরাতের জীয়ন্ত প্রয়োজন।

মোমেনার দেওয়া গরম চাদর গায়ে জড়িয়ে এই গল্পের মানুষ গুলোকে পড়তে বসলে শব্দমহিমায় ভাপ ওঠে ক্রমশঃ। বিলের হাওয়া লাগলে মানুষ‌ও গাছের মতো ফলধরা হয়, তখন জাড় লাগে গায়। চোখের উপর পাতা নীচের পাতা জুড়ে গাবা টানে বিল।
এই মনমন শীতলতায় প্রকৃতির পারসোনিফিকেশনের প্রতিটি ধাপে কোত্থাও শীত ঠান্ডা বা কাঁপের মতো শব্দ চোখে পড়ে না। বরং মনে পড়ে “চিয়েন জাড় বাড়ছে ক্রমশ”।
এখানে মাথা হয়ে যায় মটকা,
কথা হয়ে যায় বোল, কোঁপ হয়ে যায় খচাম খচাম শাণিত,
অথচ একটু যে খবর হবে , নিদেনপক্ষে একটা গাছ হবে, তার পাতা পড়বে শোকতাপ হয়ে ঝরে, তার হলোনা কিছুই।

…কারো গায়ে হাত দিয়েলে হাতেম?

…কৈ না তো

…মনে করে দেখ

…একজুনা বুকি হাত দিতি দিয়েল, দিয়েছিলাম
কপালে হাত দিতি দিয়েল, দিয়েছিলাম…

এই ‘পারা না পারাই’ হাতেম ছৈয়াল। একটি প্রারম্ভিক ঢেকুর ও সমাপ্তির অস্পষ্ট গোঙানির মাঝের এই সমস্ত নিরুপায়তাই ছৈয়াল।

তার মুখের উপর অনায়াসে শুনিয়ে দেওয়া চলে,
…ডাক পাবা কনে যে সাড়া দোবা,
ডাল পাবা কনে যে ঝোলবা!…

অর্থাৎ আমি তুমি কেউ কিস্সু না। কেবল খড়ের গাদা, কেবল হাতের ভাঁজুনি, কেবল চালের ফুটো ছাওয়ার জুগাড়। আর তার‌ই জন্য যত ব্যাঙ্কের লাইন, দেশ যন্ত্রণার যাবতীয় কাগুজে আয়োজন।

মেনিপিয়ান স্যাটায়ারের আধো পরশন, আর ইলিয়াসী ব্যঞ্জনার স্বীয়গতি , উভয়ের উর্দ্ধে হাতেমের সহজতাকে প্রতিষ্ঠা দেওয়া নিঃসন্দেহে লেখকের মেধাদীপ্ত কলমপ্রয়াস, তবে এ প্রয়াসে যতখানি কালি ঢেলেছে মুদ্রণগাফিলতি, তা প্রকাশকের ব্রীড়ার কারণ হবে বলে মনে হয়।

একটা সমস্বত্ব জীবনের আশা, যা হাতেমের কাছে অধরা, তার‌ই সন্ধানে এক অসংবেদনশীল সমাজে মানবমন নিয়ে নিত্যযাত্রা । এখানে প্রত্যেকেই প্রত্যেকের মতো করে হেরে বসে আছে। প্রত্যেকেই
আদতে লাচার। তবে নেমেসিস বোধহয় বেঁকাহরিই। যে সময়ের প্রেক্ষাপটে লেখা এই হাতেম উপাখ্যান, সেখানে দাঁড়িয়ে হরি কেই গজিয়ে ওঠা সমাজব্যবস্হার জ্বলজ্যান্ত প্রতিনিধি বানাতে লেখক একটুও কসুর রাখেননি। যদি হাতেম ব্যতীত আর কিছু এ লেখায় মুখ্য হয়ে থাকে, তা হলো সময়। যে বার্নিং ইস্যু তে সমস্ত ধারাবিবরণী শুরু, সেই এনার্সি ও রাষ্ট্রব্যাবস্হার পোলারাইজড্ গা-জোয়ারীর নিদর্শন বেঁকাহরি।
অথচ আদতে
সে ও
লাচার।
কারণ এই অণুন্যাসের কোনো শব্দ‌ই স্পেসিফিক্যালি রাজনীতির নয়, বা রাজনৈতিক মনুষ্য চেতনার নয়। লেখকের পরিচিত রাজনৈতিক লেখধারার সাথে সমান্তরাল শাসকবিরোধী অভ্রংলিহ শব্দনির্মাণ নয়।

এ লেখ্য মানুষের।
চিরাচরিত লাচার মানুষের কোঁচড়ে কাপড়ে জড়িয়ে পাঁকে ছেতরে মরার কাহিনী।
…যতখানি কাদার, ততখানি কাঁদার।
মোড়কসর্বস্ব ব্রিটানিয়াবিশ্বে একটি আন্তরিক আধামুধো বাপুজি কেক , অথবা সড়কপন্হী পরিযায়ী জীবন থেকে আড়াল খোঁজার সাময়িক হাসপাতাল গলি, যেখানে পথ চেয়ে বসে থাকা চলে, হামার খামার করে মরা চলে, হাতের হাত দুটোকে বুকের পাঁজরায় বসিয়ে জন্ম মৃত্যু ঘুচিয়ে বলা চলে,
…এই এখেনে ছৈয়াল, জেনো, এখেনে আম্মো থাকলাম তোমার কেড়ি আঙুল ডা ধরে।…
বলা চলে,
…”যতদিন বাঁচব- তুমার পা ধোবার পানি দোব, পা ধুইয়েও দোব। জানবা মোমেনার বদনায় তুমার জন্যি পানি সে তুলে রেখেছে এই জনমের মতো।”

কিন্তু হাতেম যে ভ্যান্নাকাঠের ঘরামী, তাই কোমরের তলা থেকেই ঢসে আসে দেশকালের অনিবার্য মাটি।
শ্বাস যখন পিছলে আসে বুক অবধি, চাঁদ যখন চোখ বুঁজোয় পীরবাড়ির দরজায়, চুপপাখিটা নিশ্চিন্তির বাসা পায় জীবনজুগনিতলায়, তখন কোলে কাঁখে জ্যান্তেমরা মানুষটা টের পায়,
মৈদুলের দোতলায় পুবে পশ্চিমে স্হাবর অস্হাবর সর্বস্ব দাউদাউ জ্বলছে।
এ আগুনের যতখানি ওপারে হাসরের ময়দান,
ততখানি এপারে দগদগিয়ে উঠেছে মোমেনার মুখ, আর তাড়া খাওয়া কুকুরের মতো পালিয়ে বেঁচেছে চাঁদের আলোর আবডাল। সে আলোর ডানদিকে পাঁজর কালো করা রাত, বাঁ দিকে জল গিলে হাঁ করে আছে মৈদুলের চরা। আছে, আমার হয়ে তুমারে দেখে যাওয়া কয়েকটা নৈতন ঢাল, কয়েকটা বেঘোরে বাতাস লাগা বাঁচামরা দিন।

আদতে,
গাছ হয়ে গাছ‌ই আছে দাঁড়িয়ে,
মিলনে ও মৃত্যু তে, শেষ অবধি।


ফেসবুক অ্যাকাউন্ট দিয়ে মন্তব্য করুন


চৈত্রী ব্যানার্জী

নাম: চৈত্রী ব্যানার্জী। বাস : কলকাতা। বিদ্যা: ইংরেজি স্নাতকোত্তর। পেশায় : সরকারী চাকরি। "মানুষ দেখতে ভালো লাগে। খালে বিলে ঘুরি। তাদের কথা শুনি। প্রত্যন্তের মানুষ যে ভাষায় কথা বলে , তাই আমার ভাষা।"

0 Comments

মন্তব্য করুন

Avatar placeholder

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।