লালাদা’র সাহিত্যে প্রেম ও যৌনতা
![laladar_sahitya_prem_jounota](https://www.dakshinerjanala.com/wp-content/uploads/2021/10/laladar_sahitya_prem_jounota.jpg)
বর্ষা-বনানীর মরকত কুঞ্জের মত একটা তীব্র প্যাশনেট সবুজ দ্যূতি যেন ছড়িয়ে দিয়েছিলেন এই অরণ্যপ্রেমিক, বাংলাসাহিত্যের অকলঙ্ক নীল আকাশে! প্রেম ও যৌনতা অত্যন্ত ক্লিশে হয়ে যাওয়া একটা বিষয়, যা পাঁঠার মাংসে ডবকা আলুর মত সুলভ, কিন্তু এই আমূল বোহেমিয়ান, বিরহপ্রবণ মানুষটি, সেই পটভূমিকায় থেকেও বিন্দুমাত্র রাখঢাক না করে, সজোরে ছুরি মারলেন ঘোমটার নীচে খেমটা’র লো-কাট চোলির চটুল বিভঙ্গের আখোলা পিঠে! ব্যতিক্রমী বইকি! চুমুর আশ্লেষে ডুবে গেল দু-তিন শতকের বৈধ অবৈধ’র ঘোলাজলে ভেসে থাকা অবুঝ তারুণ্য। সেইই শুরু, সেই মেগা সিরিয়াল এপিসোডের মতো নিরবিচ্ছিন্ন সম্মোহন, থামলো এসে চলতি বছরের আগস্টে। কী আশ্চর্য সূক্ষতায় পাঞ্চ করেছেন প্রেম আর যৌনতা, গার্হস্থ্য আর পরকীয়া, বহিরঙ্গ থেকে অন্তরঙ্গ, আপাত আর সত্যি ! কুর্নিশ আপনাকে, লেখক।
অমন স্যুটেড-বুটেড ঠোঁটের কোনে পাইপ চেপে সায়েব-সুবো মানুষ যে কী করে রথীন ঘোষ মহাশয় বা ব্রজবাবুর কীর্তন শুনতে পারেন তা আশ্চর্যের! বিভিন্ন চরিত্রের পরতে পরতে, নারী পুরুষ নির্বিশেষে, মিশিয়ে দিয়েছেন তাঁর সুতীব্র অনুরাগ রবীন্দ্রসঙ্গীতের ওপর, নিঃসন্দেহে এখানে ‘দক্ষিনী’র সুস্পষ্ট প্রভাব ছিলো, তাঁর অসম্ভব প্রকৃতিপ্রেম, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা এবং অন্যান্য বিদেশী সাহিত্য, বিশেষত আর্নেস্ট হেমিংওয়ের লেখার প্রতি আকর্ষণ, বাঙালি খাওয়া-দাওয়ার ওপর একটা ওভারপজেসিভনেস, সবটাই বাংলা সাহিত্যের পাঠক তারিয়ে তারিয়ে রেলিশ করেছেন আর তখন অসামান্য দক্ষতায় সৃষ্ট হয়ে চলেছে একের পর এক কালজয়ী নভেল। মাধুকরীর পৃথু ঘোষের প্রেমে মজে আছে হাইস্কুল থেকে ইউনিভার্সিটির তাবৎ মেয়েরা, ছুটি’র স্বপ্ন বুকে, জমে উঠছে কলকাতা থেকে দূর মফস্বলি যুবকদের কুর্চিবনে গান। সো-কলড্ আঁতেল সাহিত্যিক- সম্পাদক মহল নাক কুঁচকালেও, টপ বাউন্সার হেঁকে পরপর বেস্টসেলার ‘মাধুকরী,’ ‘কোজাগর’, ‘কোয়েলের কাছে’ বিকোচ্ছে দেদার!
এই আদিম-বিরহ এবং বন্য প্রেমের চরিত্রগুলির ওপর যদি অন্বেষণের সার্চলাইট ফেলি, তবে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যৌনতার অনাবিল শ্যামলিমা। শিলীভূত কামনার চওড়া চাতালে আকস্মিক আনন্দলহরীর মতো ঝর্ণাস্রোতের নিষিদ্ধ ফেনার ঘূর্ণিতে উড়ে গেছে প্রোলেতারিয়েত আস্তর। প্রকট হয়েছে ইচ্ছে, অনুভূতি,আবেগ মনুষ্যত্বও। কী প্রগাঢ় আস্থায় মানুষী ঋতি, বনপালক রাজর্ষির ‘বড় আদরের’ পর, মানবী থেকে দেবীত্বে উত্তরণ ঘটার সেই দুর্লভ মূহুর্তে, স্নিগ্ধ পুরুষত্বের ছায়ায় সমর্পন করেছে নিজেকে! সম্মোহনী সেই সময়, উদ্ভাসিত করেছে প্রেমকে, যৌনতা ছাপিয়ে যা চিরকালীন আনন্দে তোলপাড় করে তুলেছে পাঠকচিত্ত। দেশি-বিদেশি রান্নার রেসিপির মতোই যে প্রেমকে এভাবে ম্যারিনেট করে তা বিভিন্ন প্রিপারেশনে পরিবেশন করা যায়, তা একমাত্র বুদ্ধদেব গুহ’ই দেখাবার সাহস রেখেছিলেন। ম্যাকলাক্সিগঞ্জের পটভূমিকায় সুকু’দা যে আদর দিয়েছিলেন ছুটির বুকে তাতে আপিসের গড়পড়তা কেরানিগিরি করা, ছা-পোষা বাঙালি, আকর্ন বেগুনি করে ‘ছ্যা ছ্যা’ করে উঠলেও, মধ্যবিত্ত জীবনে একমাত্র ঢেউ হয়ে আছড়ে পড়েছিল তা, বেডরুমে, শরীরে ও মনে। পৃথু ঘোষ, সুকুদা, রাজর্ষি, অর্যমা, অথবা রুষা, কুর্চি, ঋতি, যোজনগন্ধাদের আইডল করে এখনও সামনের দুটি প্রজন্ম যে ম্যারাথনে দৌড়বে তা সুনিশ্চিত। প্রেম যে এত নিরাবরণ আবার অবগুণ্ঠিত হতে পারে একই আঙ্গিকে, তার জ্যান্ত উদাহরণ ঋতি। রাজর্ষির সাথে দীর্ঘ পত্রমিতালির অখণ্ড নির্জনতায় একটি নারী-মনের উন্মোচন, তাকে কলি থেকে তোড়া করে তুলেছিলো। আবার রাজর্ষির দৃষ্টিকোন থেকে দেখলে, একটি বিবাহিত পুরুষ, যার শারীরিক সম্পর্কের অভিজ্ঞতা আছে, স্ত্রী বনী’র প্রতি প্রেম’ও অটুট, শুধুমাত্র সিচুয়েশনের জন্য, একটা গরমের দুপুরের পাতাঝরা হু হু বাতাসের মতো জীবন যাপন করতে হয়, সেই উদলা হাওয়ায় উড়ে আসে হরজাই রঙের পাতা, খয়েরী, হলদে, লালচে-ধূসর মেশানো। তারপর একদিন বর্ষার দুপুরে মারুমারের জঙ্গলে, বনবাংলোয়, একটি তিরতিরে সবুজ পাতার মতো নায়িকার সাথে মিলনের দৃশ্যটি অপরূপ হয়ে থাকবে পড়ন্ত সোনালী আলোয়। এর দাম কিছু কম বুঝি!?এখানেই তো লেখকের কলম সোনার হয়ে উঠলো, এই তো মাল্টি-লেয়ার্ড আইসক্রিমের মতো পরতে পরতে মাখামাখি হয়ে যাচ্ছে প্রেম ও যৌনচেতনা, কখনও প্রকট কখনও অবদমিত, মূল স্বাদটুকু জেগে থাকে শুধু অবচেতনে ঘুমিয়ে থাকা সাধের মতো ! আবার নতুন করে জাগবে বলে!
কত শীত রাতে মনে হয় দরজার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে ছুটি, তবু ভবিষ্যতের কোনো সুকুদা হয়তো তাকে বুকে টেনে নিতে চেয়েও নিতে না পারার বেদনায় দীর্ণ হয়ে, স্পন্দিত হৃদয়ের যূথবদ্ধ সমস্ত উষ্ণতা বুকে, কোন পান্ডুর পান্ডুলিপিতে লিখে যাবে আবহমান কালের প্রেমের যন্ত্রণা, সে স্মারক লিপিবদ্ধ থাকবে মহাকালের শিলালিপিতে খোদাই করে! পৃথিবীর পুরনো অসুখে খুঁড়িয়ে হাঁটবে যখন অন্ধকার রাত, আগামীর দিনরাত ডুবে যাবে আরও কেজো আরও স্টিরিওটাইপড রুটিনের ধুসর মার্জিনে, নাকের সামনে খুড়োর কলে ঝোলানো থাকবে টার্গেট, বারবার পিছনে ফিরে তাকানো সময় অবসাদের কালো মুখোশে ঢেকে আড়চোখে মেপে নেবে প্রেম, তখন… সুখের পাখিটিকে বুকে চেপে রাখার অদম্য ইচ্ছে, ছুটির রাজঘুঘুর মতো দুটি বুক, ঠোঁটের নোনতা স্বাদে, জিভ আড়ষ্ট করে রাখবে কোনো সুকুদাকে!? আদৌ? নাকি ফ্লেভারড কন্ডোমের মত সেই আশ্লেষটুকুও ছুঁড়ে ফেলে দেবে আগামীর ড্যাশিং প্রেমিক-প্রেমিকারা! কে জানে!
রমা, রুষা, আরও অনেক এ্যকমপ্লিসড মহিলার সাহচর্য লালাদা’র নায়ক চরিত্রদের সঙ্গে অদ্ভূত এক কেমিস্ট্রিতে জারিত হতে গিয়েও সবটুকু হয়ে উঠতে পারেনি, তাদের প্রেম, শরীর, আবেদন ছাপিয়ে গেছে পরমাপ্রকৃতি, আর হলুদ মসৃণ-পালকের পাখির মতো প্রেমিকারা, চাঁদের রাতে, কিম্বা ক্যাম্পফায়ারের আলোয়, অথবা জঙ্গলের বনজ অন্ধকারে, রৌদ্রময় সকালে, সদ্যস্নান করে ওঠা শরীরের গন্ধে মিশে গেছে মস্তিষ্কের কোষে কোষে, পাঠকের, প্রেমিকের ও।
পুরুষ ও নারীর চিরাচরিত প্রেম ভিন্ন আরও অনেকরকম প্রেম নিয়ে এসেছেন তিনি তাঁর লেখায়। তাঁর চরিত্রেরা বড় আরণ্যক, সে পৃথু কিম্বা রাজর্ষি, সুকুদা, সায়ন, ঠুঠা বাইগা সক্কলে। জঙ্গলের প্রেম বড় নাছোড়, সে বুনো গন্ধ একবার গায়ে লেগে গেলে, ডাভ, লাক্স আরও কোনো দেশী-বিদেশী সুগন্ধি সাবানের ক্ষমতা নেই তা মুছে দেয়, বগলতলির গন্ধের মতই তা অনতিক্রম্য। প্রেম’কে এতরকম করে ভেঙেচুরে ভালোবাসতে মনে হয় আর কোন সাহিত্যিক পারেননি। তার সমস্ত প্রেমের গন্তব্য যেন মিশে গেছে এক অপার নির্লিপ্তিতে। ঈশ্বর প্রেমের মতোই তা অমলিন, চিরনবীন। পরকীয়া প্রেমের যে অভিঘাত এবং তাকেও বিন্দুমাত্র ছোট না করে যে অসামান্য আদলে গড়েছেন সেখানেই কলমের কৃতিত্ব। এমনকি শরীরী ভালোবাসা ও কামবোধকেও নিয়ে গেছেন প্রশান্তিতে। কিছু একপেশে সম্পাদক ভাগ্যিস তাদের বাপোত্তর সম্পত্তির মতো বাংলা সাহিত্যের চোরাবাজারে চায়না মাল টাইপ কিছু সস্তা চমকপ্রদ বাজারকাটতি নভেলের আমদানি করেছিলেন অথবা ক্লাসিক সাহিত্যের ধবধবে কাপড়ে যৌনতার লাল-হলদে ছোপ ধরে যায়, তাই রে রে করে উঠেছিলেন তারা, তাই তীব্র অভিমানে ঠুঠা বাইগা নাঙ্গা বাইগীনকে খুঁজে গেলো শতাব্দীভর। এই সভ্যতাতে সতত নিষ্পেষিত, উপেক্ষিত লেখকের, কলমের কাছে নতজানু হই বারবার। প্রেম ও যৌনতা যে একটা অনস্বীকার্য রিয়ালিটি সে জন্তুজানোয়ার, মানুষ, এমনকি কাক-হাঁড়িচাচার জীবনেও, তা এমন করে আর কেউই দেখাবার সাহস দেখায়নি আগে। বিবাহিত সম্পর্কের একঘেয়েমি আবার একই সাথে নির্ভরতা, পরকীয়া, উদ্দাম জীবনের হাতছানি, ডাকাতদের সাথে এনকাউন্টার, ছেলে-মেয়েদের প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসা, বিবাহিত স্ত্রী’র কাছে অপমানিত হয়ে বারবার অন্য কোন নারীর কাছে আশ্রয় চাওয়া, বাঈজি বিজলীর কাছে শরীর খুঁজে পাওয়া প্রচন্ড তাড়নায়, পৃথু, তুমি একবিংশ শতকের নর-নারীদের সাবালক করে দিয়ে গেলে। এই যন্ত্রণার হিমেল তারাকুচি অন্ধকার, ঝোড়ো হাওয়া না পাওয়ার, তুমি আলোর চেয়েও ভালো। এত প্রেম, এত সুর, এত গান, রবীন্দ্রনাথ পরবর্তী প্রজন্ম জানতেই পারতো না পৃথু ঘোষ না থাকলে। দিগা পাঁড়ে, শামীম, ভুচু, বিনোদ ইদুরকার, ঠুঠা এরা তো সব শাশ্বত চরিত্র প্রেম ঘৃণা ব্যথা ভালোবেসে যারা রয়ে যায় সারসার, বোধের ভেতরে। লেখক, ভালোবাসা নেবেন। ফিরদৌসী আখতার’রা কোথায় যাবে, কার কাছে যাবে? আপনি না থাকলে! আজও বহুতল আবাসনের অত্যাধুনিক চানঘরে শাওয়ারের নীচে দাঁড়িয়ে কোন আধুনিকা, শ্যাম্পু সাবানের পিচ্ছিল মসৃনতায় উজ্জ্বল হয়ে উঠতে উঠতে ভাবে,
“আমি নিশিদিন তোমায় ভালোবাসি
তুমি অবসরমতো বাসিও… ” চানঘরে গান আজও যে ভীষণ সত্যি, লাবডুপের মতই।
আবার আগষ্ট মাস আসবে, বর্ষার জলে ভরে যাবে বন, জঙ্গল, টাঁড়, পাহাড়ের সবটুকু সবুজ। গেরুয়া রঙ জল কলকল করে বয়ে যাবে নালায় খাঁড়িতে। বৃক্ষে, গুল্মে, লতাপাতায় প্রাণের হিল্লোল বয়ে যাবে, বৃষ্টির সাদা চাদরে মুড়ি দিয়ে সবুজ কলিরা ঘুমিয়ে থাকবে, তখন আপনি কোথায় থাকবেন লালা’দা? আপনাকে ছাড়া বাঁচি না, প্রাণ আমার!
রবীন্দ্রনাথ আর আপনি, কেমন জড়িয়ে-মড়িয়ে আছেন অগন্য পাঠক-পাঠিকার জীবনে, না? আলাদা করে বই পড়ে, স্টাডিতে বসে নাকে চশমা এঁটে মনে যে করতে হয় না আপনাদের এইই তো ঢের, এখানেই তো আপনারা জিতে গেছেন। তবে যখন-তখন প্রেমকাতরী করে তোলেন, ভারী বিচ্ছিরি আপনারা,
আপনি !!!
গ্রন্থঋণ :
মাধুকরী
চানঘরে গান
সবিনয় নিবেদন
একটু উষ্ণতার জন্য
0 Comments