রেল-লাইনে ঠোঁট ঘষছে গোলাপী বিকেল

জয়দীপ চট্টোপাধ্যায় on

rail_line_bikel

জানতে ইচ্ছে হয়

কে বেশি ভালো আছে?

প্ল্যাটফর্ম…

না সেই ছেলেটা–

যে রেল-লাইনের ধারে

দাঁড়িয়ে

একের পর এক

কামড়াগুলো চলে যেতে দেখে

আর

হাসতে হাসতে

অস্ফুট

স্বশ্রুত শব্দের খেলা

প্রতিদিন।

— — — 

একটা মন খারাপ থেকে আর একটা মন খারাপের দিকে ভেসে যাওয়া।

এক একটা হল্ট এক একটা স্টেশনের মত… ছোট-বড়ো… শহর-মফঃস্বল… ওই মন খারাপের থেমে থাকাটাও একরকম ভবিতব্য, যাকে জ্ঞানবৃদ্ধরা মাথা দুলিয়ে বলে– ‘পার্ট অফ লাইফ’।

ওই যে মাঝের ভেসে যাওয়া, গতিশীল দশাটা… ওটাই ভালো লাগে। ভেসে যাওয়ার জানলায় মুখ রেখে, চোখ বন্ধ করে থাকলেও, ঠান্ডা বাতাস চোখ-মুখ ছুঁয়ে যায়। ওই আবার এক বৃদ্ধ মাথা দুলিয়ে বলল– ‘ওটা জার্নি… ওটাও পার্ট অফ লাইফ।’

নির্দিষ্ট গন্তব্যের টিকিট কেটেই তো ট্রেনে উঠতে  হয়… তাই হয়ত একটা স্টেশনে নামব আবার; যেমন এর আগেও চলতে চলতে নেমেছি এক এক হল্টে… যাত্রাকালীন। তবে মন খারাপের কোনও স্টেশনই আমার জন্য নয়, আমিও তাদের জন্য নই… সেটা এই স্বার্থপর ‘আমি’টা হাড়ে হাড়ে বুঝে গেছে এতদিনে। গোগ্রাসে সিঙ্গারা-কচুরি বা ভাঁড়ের পর ভাঁড় চা খাওয়ার সব কোনো স্বজন বিয়োগের কথা মনে থাকে না। বিরহ অথবা অবসাদের কথাও মনে থাকে না। বার্থে শুয়ে দুলুনি আর ট্রেন চলার যান্ত্রিক শব্দ মিঠে ঘুম পাড়ানিয়া। পৃথিবীর কোনো অ্যান্টি-ডিপ্রেস্যান্ট বা ঘুমের ওষুধের এমন মোহনিয়া ক্ষমতা নেই। এত নিরাময় গুণ নেই।

স্বার্থ তো অবশ্যই আছে। থাকে। একটা সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা কিংবা ভেঙে দেওয়া– দুইয়ের পেছনেই কারো না কারো স্বার্থ থাকে। কিছু ব্যবহারিক হিসেব-নিকেশ থাকে।  

অবশ্য স্টেশন আর যাত্রীদের মধ্যে কে  বেশি স্বার্থ আঁকড়ে থাকতে ভালোবাসে, সেই তর্ক শুনে রেল-লাইনও মিটিমিটি হাসে… যেমন আমিও হাসি মাঝে মাঝে।

ঝিমোতে ঝিমোতে চোখের পাতা ভারী হয়ে যায়, দু-চোখ বুঁজে আসে। একটা স্বপ্ন থেকে আর একটা স্বপ্নের মাঝে চোখ খুলে মৃদু দুলতে দুলতে ভাবি– 

একদিন ঠিক সাহস করে নামব ইচ্ছে মত অনামী স্টেশনে। শুধু এক অনামী স্টেশন থেকে আর এক অপরিচিত স্টেশনে গিয়েই কাটিয়ে দেব ক’টা উষ্ণ অবসরের দিন। পরিচিত কেউ থাকবে না এই শখের নিরুদ্দেশ যাত্রার সাক্ষী অথবা সঙ্গী।  যাত্রা পথের মাঝেই নেমে যাব, যদি হঠাৎ করে কোনো স্টেশন ভীষণ রকম মায়াবী হয়ে ওঠে। গোলাপী রোদ্দুর, হুপি পাখি, নিঃসঙ্গ চাওয়ালা অথবা স্কিপিং-এর দড়ি হাতে কোনো কিশোরীকে অজুহাত করে নেমে যাব। একা।

আবার কদিন পরে সেই প্ল্যাটফর্মের টিকিটঘরের সামনে পকেট হাতড়ে, যা আছে তাই দিয়ে টিকিট কেটে নেব। কাউণ্টারে হাত গলিয়ে  জানলার ধারের একটা সিট আবদার করব… যেখানে বেঁচে থাকার ভালোবাসা রোদ লেগে থাকে।

সরকারী কর্মচারী বিরক্ত হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকবেন। আমি হাসব। 

বিশেষ বিশেষ অবস্থায় চেতন আর অবচেতন, ভাবনা আর স্বপ্ন, ভালোবাসে আর ভালোবাসি… এসব আলাদা করতে না পারা বোধহয় এক রকম মেডিকাল কন্ডিশন।

— — — 

হয়ত… 

একই ট্রেনের দু’টো আলাদা কম্পার্টমেণ্টে… আমরা একই পাহাড়তলীর দিকে যাব। অথচ জানতে পারব না যে আমরা একই ট্রেনে… হয়ত। 

মরূবর্ণ চোখের তারা, আর তার মাঝে ওয়েসিস। কিন্তু মরূবর্ণ মানেই কি বালির রঙ? বালি সমুদ্রতটে, ঝাউবনে বা ক্ষীণস্রোতা নদীর আঁচলের নীচেও চিকচিক করে। অপরাহ্নের রোদে বালির ওপর অভ্র চিকচিক করে, নদীর জল চিকচিক করে। ক্রমে আলো কমতে কমতে গাঢ় নীল হয়ে আসে সব কিছু। শিল্পীর প্যালেটে কালো থেকে ক্রমে নীলে এসে হারিয়ে যাওয়া রাত। আর আমি একা, ফিরে যেতে বাধ্য হই। আমার মনে সোনালী বালির মত চোখ, অভ্রর মত চিকচিক করা বিয়োগাশ্রু। শুধু শ্বাপদের অতর্কিতে আক্রমণ, অথবা নিয়তিমাত্র শিকার হয়ে যাওয়াই নয়… অনিশ্চয়তা আর নিরাপত্তাহীনতা মনে এক অন্যরকম ব্রীড়া প্রসব করে। ক্লেদজ। অথচ কৈরবসুন্দর নয়। বরং অন্যরকমই। ক্যানভাসের অন্ধকারে হারিয়ে যায়। ক্ষীণতরু আশাধমনীর পাশে এমন পাণ্ডুর অনিশ্চয়তাই পেছন থেকে লাফ দিয়ে পড়ে ঘাড়ের ওপর। হয়ত এই কারণেই, দু-পা এগিয়েও থমকে যায় মানুষ। পা বসে যায় মাটিতে। যে এগিয়ে গেল, সে ভুল বোঝে। এক রাশ অভিমান নিয়েও একা চলে যায়। ফিরে তাকায় না। নদীর জলে চাঁদ ছটফট করে আরো একটা রাত। পুরনো কথা মনে পরে যায়… হয়ত। 

হয়ত, স্টেশন অবশ্যম্ভাবী এক বলেই… নামতেও হবে গতানুগতিক সবকিছু সামলে একসাথে… আলাদা আলাদা। 

পরিচিত গান হঠাৎ কানে এলে মন অন্যমনষ্ক হয়ে যায়। আগে রাগ হত। সময়ের সাথে সাথে রাগের বদলে জায়গা করে নিয়েছে স্মিত হাসি। বয়স বাড়লে, পুরনো অনেক কথাই মনে পড়লে হাসি পায়। সামনের জনের কৌতূহল বাড়ে। সে বা তারা শুনতে চায় সেই সুখস্মৃতি– হাসলে কেন? বলো? 

আমরা হাসি… একসাথে। আলাদা আলাদা। পরিচিত গান বা সুর কানে এলে। 

রোমান্টিকতা বা আবেগের একটা নিজশ্ব অশরীরী অস্তিত্ব আছে। বিরহ যাদের বুকে ছুরি বসিয়েছে, তারা সূক্ষ্ম দেহে সুর, মুহূর্ত, ঘ্রাণ, স্মারক… কোথাও একটা আস্তানা খুঁজে নেয়। দেখাও দেয়… যদি কেউ সত্যিই দেখতে চায়। এমন নিরীহ  অশরীরীদেরও, কেউ কেউ ভয় পায়… হয়ত। 

হয়ত স্টেশনের ভিড়ে… একটা চেনা মুখ দেখে ভাববে– ওই তো!… ‘সে’-ই তো! তারপর ভারী ব্যাগ নামিয়ে এগনোর ব্যস্ততার মাঝে মুখটা হারিয়ে ফেলবে… পরিচিত হারানোর অভ্যেসে।

হারিয়ে ফেলার মত বিচিত্র অভিজ্ঞতা কম হয়। অনেক কিছুই অজানতে বা অনিচ্ছাবসত হারিয়ে ফেলে মানুষ তখনকার মত দুঃখ পায়… ভেঙে পড়ে। অনেকরকম কারণে অবসাদ বা আশংকাগ্রস্ত হয়। কিন্তু অনেক দিন, অনেক বছর পর মনে হয়… হারিয়ে ভালোই হয়েছিল। সে সান্ত্বনা, নাকি সত্যিই ভালো হয়ছিল… অত ভাবার মত অবসর সত্যিই কি আমাদের আছে? আমরা তো কাউকে ফোন করে একবারে না পেলেই বিরক্ত হয়ে যাই। 

হয়ত আমিও মোবাইল ফোনে এনগেজ টোন শুনতে শুনতে বিরক্ত হয়ে এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে হঠাৎ কাউকে দেখে ভাববো… মুখটা অবিকল সেইরকমই! 

হয়ত… ডাকার ইচ্ছেটা মুখে আসার আগেই দেখব, অন্য কেউ ডেকে নিয়েছে আগেই। সাড়াও পেয়ে গেছে। হঠাৎ করেই প্রিয় মানুষকে দেখে সচেতন হয়ে ওঠে, কেয়ারিং হয়ে ওঠে, পজেজিভ হয়ে ওঠে… পুরুষ হয়ে ওঠে– এতক্ষণ নিরীহ ভাবে অপেক্ষা করা একজন মানুষ। 

পাড় ভাঙার শব্দ আমি শুনেছি অনেকদিন আগেই। কুঁতিয়ে ভদ্রতা করতে মাঝে মাঝে কষ্টই হয়।   অতীতের ব্যর্থতার কথা মনে পড়লে… ঈর্ষাও হয়। নরম মাংসের ব্যর্থতা ঈর্ষা দিয়ে সযত্নে মুড়ে রাখলে, ক্রমে তা মাছের পাতুরির মত দেখতে লাগে…  হয়ত। 

হয়ত… ট্রেন, স্টেশন, অথবা কুয়াশা ঘেরা পাহাড়ী শহরটার নাম রাখা যায়– 

হয়ত।

— — — 

এখন ড্রোন হয়েছে, আগে ক্রেন বা দোতলা-তিনতলা (বা আরো উঁচু) বাড়ির ছাদ থেকে শট নেওয়া হত। যাদের বাজেট অনেক বেশি, তারা হেলিকপ্টার ব্যবহার করত।

এমন ওপর থেকে নেওয়া শটে অনেক সময়ে স্টেশন থেকে বেরিয়ে আসা রেল-লাইনদের দেখা যায় একটা জায়গার পর বেঁকে গেছে, বা একে অপরকে কেটে এদিক ওদিক চলে গেছে। অনেকগুলো সমান্তরাল লাইন, একটা জায়গার পর যে যার নিজের মত চলে যায়। গা থেকে সেই জংশনের অস্তিত্ব ঝেড়ে ফেলে।

জংশনে ঘটে যাওয়া ঘটনা, নেওয়া সিদ্ধান্ত… আমাদের গন্তব্য পথের রাস্তা ঠিক করে দেয়, পরিবর্তিত করে দেয়। আমরা আর সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগের অবস্থানে ফিরতে পারি না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে হয়ত বুঝতে পারি দিক বা পথ কোথায় এসে পরিবর্তন হল, সব সময়ে তাও পারি না… পারলেও অনেক দেরিতে। কিন্তু ওই চেনা অবধিই। এর পর এই পথে যা যা আসার, যা যা ঘটার এই পথের নিয়মেই হবে। অন্য পথ যেখানে গেছে, অন্য পথে যা হতে পারত… তা এই পথে আসবে না। জংশনে ফিরে গিয়ে আবার পথ পরিবর্তন করা? বাস্তবে সম্ভব না… চেষ্টা করাও সবার হাতে  থাকে না, আর থাকলেও তার নিজস্ব কোল্যাটারাল ড্যামেজ থেকে যায়।

দূরত্বর সঙ্গে অপর এককটি সময়। মাস, বছর, জীবন… অনেকটা এগিয়ে যাওয়া। দূরত্ব অতিক্রম করে ফিরতেও সময় লাগে। আর যে সময় গেছে, তাতে যা কিছু ঘটেছে। যা কিছু হারিয়েছে… এক অপরিবর্তনীয় বিয়োগ।

শুধু মাঝে মাঝে, অবসরে ওপর থেকে দেখা সেই রেল-লাইনগুলো। 

একটা রেল-লাইন এগিয়ে গেছে। এখন সেই কবে/কখন পরের জংশন আসবে। ট্রেন থামবে। তখন কীভাবে কী করা যায়… সেই ভাবা।

জীবনের তো কোনো সেকন্ড টেক নেই, অভিনয়/দৃশ্য পছন্দ না হলে রি-টেক করা যায় না। রেকর্ডিংগুলো মাঝে মাঝে দেখা যায়, পরের দৃশ্যটা অন্যভাবে শট নেওয়ার কথা ভাবা যায়, যতটা বাজেট, পরিকাঠামো আর সম্পদে কুলোয়। ইচ্ছাশক্তি আর মনোবল খুব গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। তার থেকেও বড়ো সম্পদ হয়ত কোনো অভিষ্ট লক্ষ্যতে পৌঁছনোর জেদ। অবসাদ মানুষকে হারিয়ে দেয়, ক্লান্তি মানুষকে হারিয়ে দেয়। প্রতিদিনের পারিপার্শ্বিক ঘর্ষণ ক্ষয় করতে থাকে।  

অন্য কাকে কী বলব? নিজেই তো বুঝতে পারছি– ঝাঁপিয়ে পড়া আর হাঁপিয়া পড়ার মধ্যে অনুপাতটা কত দ্রুত পালটে যাচ্ছে। আবেগ, অনুভূতি কিংবা পদাবলীর সন্ধি থাকলে সেখানেও ব্যথা হত। চিকিৎসা, ফিজিওথেরাপি… এসব চালিয়েও অমাবস্যা-পূর্ণিমা টনটন করে জানান দিত… পেইন কিলারের কাতর প্রার্থনা শুরু করত। 

পেইন কিলার প্রসঙ্গে মনে পড়ে, রনজীশ-এ-ইশকের আহত দিওয়ানা গজলের কলি আর উর্দু কবিতায় পানশালার আশ্রয় খোঁজে। গালিব শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে থাকেন পুরানি-দিল্লির কোনো নির্জন রাস্তায়, দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে থাকেন মুঘোল সালতানাতের শেষ জ্যোৎসনার দিকে। নিশ্চিৎ তারও আগে থেকে– খেজুর গাছে কুপিয়ে রস বের করে আনার মত বিরহর ফোঁটা টপটপ করে জমানো হয় কলসিতে। রস জাল দিয়ে অন্য কেউ বাজারে বেচতে বসে। আর যা-ই হোক, ভাঙা সম্পর্কের ওপর প্লাস্টার পড়ে না, স্টিল-প্লেট বসে না, ক্রেপ ব্যান্ডেজ খুলে মালিশ করতে হয় না। ভালোবাসার মুহূর্ত নইহারের মত খোয়ানো… ওষুধগন্ধে ভরা ক্লসট্রোফোবিয়া জাগানো ঘরে আটকে থাকার থেকে ভালো।  

 দাঙ্গা, অতিমারী, রাষ্ট্র আর পিঠে কাঁটাতারের দাগের মত গুরুপাককে নিয়ন্ত্রিত শ্বাস-প্রশ্বাস আর একশ থেকে এক অবধি গোণার ছলনায় ভুলতে ভুলতে ট্রেনের দুলুনিতে ঘুমিয়ে নেওয়া যায়… সকালে উঠে আবার ভাবা যাবে। 

এভাবেই সকাল আসে… তারপরের দিন সকাল আসে… তার পরের দিন…

— — — 

আমি বিশ্বাস করি

আমি বিশ্বাস করি না

যাই থাকুক সমান্তরাল রেল-লাইন ধরে হাঁটতে হাঁটতে… এক স্টেশন থেকে আর একটা স্টেশনের মাঝে… রেল-লাইনগুলো তো কেউ হাওয়ায় মিলিয়ে যায় না, মাটিতে মিশেও যায়না হঠাৎ করে। ওই ইস্পাতের লাইন দু’টোই ইতিবাচক। দু’ক্রোশ… দশ ক্রোশ, বিশ ক্রোশ… যত দূরই হোক, আবার একটা স্টেশন আসবেই চলতে চলতে। তা সে জাংশান হোক, কিংবা নেহাত অনামী প্ল্যাটফর্ম… কিংবা অন্তিম স্টেশন বা কারশেড। 

যাত্রাপথে আসা অনামী স্টেশনগুলোর প্রতি আমার মোহ সেই ছোটোবেলা থেকেই। 

লাল মোড়াম বিছনো প্ল্যাটফর্ম। বৃষ্টি ভেজা আয়নার মত জনশূন্য প্ল্যাটফর্ম। কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া আর পলাশে সাজানো প্ল্যাটফর্ম। একলা মানুষের ছায়া বুকে নিয়ে দুপুর রোধে ঝিমিয়ে থাকা প্ল্যাটফর্ম। অনেক সময়ে ট্রেন থামেও না, আসতে আসতে পার করে চলে যায়। জাফরি দেওয়া পাঁচিল– কখনো সাদা, কখনো হলুদ, কখনো চুন-হলুদ। দূরে লালচে পথ, আরো দূরে সবুজ টিলা। তবু সাহস করে নামা হয় না, এমন স্টেশনে থামা হয় না। 

এই ঝিরিপাতা গাছের ছায়া, চাপা কলের জল, সেদ্ধ হওয়া ভাতের গন্ধ… আর খোঁজ করলে হয়ত আরও অনেক কিছুই পাবো, যা ব্যস্ত জাংশানের ভিড়ে জিজ্ঞেস করতেও ঠিক করে হদিস পাওয়া যায় না।

    রোদে পোড়া তামাটে ইস্পাত, দিগন্তের কাছাকাছি যেখানে নৌকার নোঙর হয়েছে, সেই স্টেশানের নাম ‘বেশআছিপুর’… ঘাটের নাম ‘ছুঁয়ে থাকা’। সেখানে এগিয়ে যাওয়ার ইচ্ছেকে বাঁচিয়ে রাখা খুব জরুরি বলেই, অন্য অনেক কিছু… অন্য অনেককে অদেখা করতে শিখতে হয়… ভেতরে বাইরে। 

আমি তো নামতে চেয়েছিলাম, আমি যে এখনো নামতে চাই… থাকতে চাই সেই রকম অনামী স্টেশনের কোনো গ্রাম বা প্রত্যন্ত অঞ্চলে। কিন্তু সেই সময়ের পারিপার্শ্বিকতা ট্রেনের ভেতরেই পায়ে বেড়ি দিয়ে রাখে। অন্য এক বস্তুবাদী পার্থিব পরামর্শদাতা কানে কানে বলে– কেন উঠেছিলে এই ট্রেনে… ভুলে গেছ? কী করবে এখানে নেমে? ঘন্টা দুয়েক পর আর ভালো লাগবে? থাকবে কোথা? খাবে কী? চলবে কী করে? এখানকার মানুষও কি তোমাকে প্রকৃতির মত উষ্ণতা দেবে?

যথার্থ ভবঘুরে নই, বরং বস্তুবাদী পরামর্শদের গুরুত্বই দিতে হয় বেশি। মেনে নিই… সাহস-ই নেই সেরকম। প্ল্যাটফর্ম অপেক্ষা নিয়ে চেয়ে থাকে। দু-হাত বাড়িয়ে আলিঙ্গন করার জন্য এগিয়ে রাখে উষ্ণ বাহু। আমি পর্দা টেনে নিই। সহযাত্রীকে জিজ্ঞেস করি কটা বাজে, পরের জংশন আসতে আরো কতক্ষণ দেরি।  

আমি বিশ্বাস করি

আমি বিশ্বাস করি না

যাই থাকুক কথা-বাক্যের মাঝে বিঘৎ থেকে মহাশূন্যব্যাপি ফাঁকগুলোর গর্ভে… সেই প্ল্যাটফর্মের পেট্রোম্যাক্সের আলোও অনেক বেশি উজ্জ্বল। তার জ্বালানী ইতিবাচক লোহিত কণিকা।

আমি সেখানে থাকতে পারি আর না পারি, তারা থেকে গেছে আমার ভেতরে। এখন বুঝতে পারি– ট্রেন থেকে না নামলেও, তাদের দূরে সরিয়ে রাখা যায় না। 

— — — 

স্টেশন বা প্ল্যাটফর্মের থেকেও বেশি ভালো ছবি দেয় রেল লাইন।

নিঃসঙ্গ রেল-লাইন… একজন আর একজনকে ছেদ করে চলে যাওয়া লাইন, নদীর মত বাঁক নিয়ে চলে যাওয় লাইন, বৃষ্টি ভেজা রেল লাইন, একলা ছাতা উড়ে যাওয়া লাইন, কুয়াশা বা সন্ধের হিমে ঢাকা লাইন। রঙিন, সাদা-কালো, সেপিয়া। এত আলো, এত অন্ধকার, আলো-ছায়ার পরতে পরতে… এভাবে খুব কম উপস্থিতিই পারে, দু’হাত ভরে এমন শূন্যতা সাজিয়ে দিতে। উঁহু, সে শূন্যতা মানেই হতাশা বা ব্যর্থতা নয়। সেই শূন্যতা মানে, আর কিছু না হারানোর অনুভূতি। যেখানে বেলাশেষের রোদ্দুর রেল-লাইনটাকে শেষবারের মত এসে ছোঁয়ে, সেখানে আর কিছু আঁকড়ে ধরার কোনও মানে নেই। তারপর কিছু বাসায় ফেরা পাখির কিচিরমিচির, গাছের ডালপালায় ঘনপাতার ফাঁকে আলোর অভাবে ধূসর-কৃষ্ণ… সব পাখি একই রকম। অথচ আলো থাকলে, কেউই ধূসর-কৃষ্ণ নয়।

চুপচাপ রেল-লাইন ধরে খানিকটা এগিয়ে যাওয়া যায়। লাইনের ধারে রেলের জমিতেই বেঁচে থাকা সরু খালের ওপর ওপর ছোট ব্রিজটার ধারে বসে থাকা যায় কিছুক্ষণ। একদিকে ফাঁকা জমি, চাষ হয়নি এখনও, অন্য দিকে তেঁতুল গাছ, নিম গাছ… বিকেল হতেই ঘনিয়ে আসা অন্ধকার। তবে অন্ধকার শুধু ওইটুকুই। ওই অন্ধকারে দেখার কিছু নেই। মাঠের ওপর এখনও আলো, মাঠ পার করে ছোটছোট ঘরের আভাস, টালির চাল। কেউ ফিরবে কাজ করে, কেউ এখনও ঘুমোচ্ছে ক্লেশে-অক্লেশে… কোথাও সাইকেল, কোথাও কালার টিভি। আর পেইন্টিং-এর মত গাছগুলো দূর থেকে একটানা কালচে সবুজ। ভালো করে তাকালে তারই মাঝে রাস্তার আভাস, তিন চাকা মোটর ভ্যান, কিংবা সাইকেল… আর স্কুল থেকে একসাথে ফেরা। ছবি… আরও ছবি… কখনও পাশে রেল-লাইন উঁকি দেয়, কখনও কোত্থাও নেই।

ঠিক এইখান থেকে, মোটামুটি এটুকু নিশ্চিৎ, লাইন ধরে যেকোনও একদিকে এগোলেই আবার চেনা ভিড়টা পাওয়া যাবে, ফেরার টিকিট। অবশ্য কোনদিকে হাঁটলে স্টেশনটা কাছে পড়বে তা জানা নেই। আর, সব ট্রেন আবার সব স্টেশনে থামেও না। সেই ট্রেন ধরার চিন্তায়– এই রেল-লাইন আঁকড়ানো রোমান্টিসিজ্‌ম বা ফেটিশ বা সাময়িক অথচ তীব্র দুর্বলতা, একের পর এক মন ছোঁয়া ফ্রেম… কোথায় যেন ফস করে উবে যায়! ঘড়ি ছুটছে, চায়ের ধোঁয়া উড়ছে, কয়লা পুড়ছে, লোকজন এদিক থেকে ওদিক দৌড়চ্ছে… পাঁচটা পঁচিশের লোকাল– এসেছে? দাঁড়িয়ে আছে? চলে গেছে?… কোন প্ল্যাটফর্মে দাদা! কোন প্ল্যাটফর্ম!

ওভারব্রিজ থেকেও রেল-লাইনগুলো ফ্রেম বন্দী হয় বটে, তবু ট্রেন সেখানে শেষ কথা… ‘ওই, কী যেন বলে গেল লোকটা? চার নম্বরে? হ্যাঁ?… চার নম্বরে?’

এতগুলো ফ্রেম, এতগুলো রঙিন আর সাদাকালো… এরপর সেই আবার ঘিঞ্জি লোকালয়। লোকালয় থেকে পালিয়ে আসা এই নো ম্যান্স ল্যান্ড কাঁধে হাত রাখা এক বন্ধুর মত। সে জানে, আমি কিছুক্ষণের জন্যই আছি। হয়ত এ-ও জানে, আর কখনো দেখাই হবে না। তাও তার মুখে হাসি, মনে অকৃত্তিম আন্তরিকতা। ‘সেই কত বছর পর দেখা… আয় বস, তোকে এমন লাগছে কেন?’ আমি তো অকৃতজ্ঞ, আত্মকেন্দ্রিক… অস্বস্তি হয়। তারপর অস্বস্তি কাটিয়ে চারিদিকে তাকাই। কথোপকথনের মধ্যে আমিই বেশি বলি। সে শুধু শোনে চুপ করে। দুটো হাত ধরে শুধু শোনে। অনেকদিনের জমানো কথা। কাউকে যা বলা হয়ে ওঠেনি। ইচ্ছে হয়নি বলতে। 

দৈত্যের মত অতিকায় বৈদ্যুতিক টাওয়ারের পেছন দিকে সূর্যটা নামতে নামতে গাঢ় কমলা হয়ে আরও কিছু ছবি দিয়ে যায়… কন্ট্রাস্ট বাড়ালেই সিঁদুরে আকাশ। সিঁদুর… সিঁদুরে মেঘ… ঘর পোড়া গরু। ঘর পোড়া নয়… ঘরে ফেরা গরুদের লালচে-কালচে ছবি, সেও ভালো… লাইনের পাশে। লাইন পার হতে হতে একসঙ্গে। সিগন্যালও লাল… ট্রেন ছুটে আসার আশঙ্কা নেই।

যে ঠিকানার নাম ‘সব কিছু একইরকম’, তার থেকে ‘কেউই জানবে না’ মাইল দূরে এই ভাবেই একটা রেল-লাইন চুপচাপ অপেক্ষায় থাকে। রাতের পর রাত… দুপুরের পর দুপুর… ঋতুর পর ঋতু। তার পাশে কিছুক্ষণ ছবি খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ কোনো আগন্তুক এসে পড়ে। বিরক্ত হয়। উদ্দীপনা কমতে কমতে ঝিমোয়। অনামিকা পাখির আচমকা ‘টিহি’ ডাকে চমকে উঠে আবার খোঁজে… খোঁজে… খুঁজতেই থাকে। সেখানে মোবাইল ফোন কখনও সাইলেণ্ট, কখনও একদম সুইচ্‌ড অফ্‌। সূর্য পাটে বসার আগে অবধি রেল-লাইনের অনেকদিনের না বলা কথাগুলো ইচ্ছা-অনিচ্ছায় অনেকটা শোনার পর… দূরে ভেসে যাওয়া উনুনের ধোঁয়া মনে করায়… এবারে ফিরতে হবে, এবারে সময় দেখতে হবে… এগনোর সময়। প্যান্ট ঝেড়ে উঠে পড়ে পকেট হাত দিয়ে মনে পড়ে কিছুকাল আগে তাড়িয়ে দেওয়ার কথা, অথচ এখন দরকার। কোনো অঞ্চলে টাওয়ারই থাকে না, আবার কোথাও হঠাৎ ক্ষীণ উপস্থিতি জানিয়ে দায় সিগনাল। নৈঃশব্দ্যে এসে ফিরে যাওয়া কিছু মিস্‌ড কল, জমে থাকা ম্যাসেজ– “আমাকে এখনো ভালোবাসিস?”… “কী রে? ভালোবাসিস… আমায়?”


ফেসবুক অ্যাকাউন্ট দিয়ে মন্তব্য করুন


জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়

বর্তমানে হায়দ্রাবাদ নিবাসী  হলেও, জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়ের শৈশব থেকে যৌবন সবটাই কলকাতার শহরতলী জুড়ে। জন্ম ২০শে আগস্ট, ১৯৮৬। বায়োটেকনলজিতে বি টেক শেষ করেই কর্মসূত্রে ২০০৮ সালে কলকাতা ছেড়ে বেঙ্গালুরু চলে যান, এবং তারপর হায়দ্রাবাদ। প্রায় দশ বছর হয়ে গেল, কলকাতার বাইরেই জীবন। বাংলা সাহিত্যের প্রতি নিবিড় ভালবাসা থেকেই একসময় লেখার ইচ্ছে জন্মায়। প্রায় সাত-আট বছর উনি একাধিক আন্তর্জাল পত্রিকা এবং মুদ্রিত পত্রিকায় লিখে চলেছেন গল্প, প্রবন্ধ, গদ্য এবং কবিতা। ২০১৩ সালে 'আদরের নৌকা' প্রকাশনা থেকে প্রকাশ পায় ওনার প্রথম গল্প সংকলন 'প্রতিবিম্ব'। এর পর ২০১৫ সালে  'হাওয়াকল' প্রকশনা থেকে প্রকাশ পায় ওনার প্রথম উপন্যাস 'কৃষ্ণঘন যাম'। ২০১৭ সালে 'হাওয়াকল' প্রকশনা  থেকেই প্রকাশিত হয় প্রথম অণুগল্প সংকলন 'টিনিটাস'। ২০১৮ সালের কলকাতা বইমেলায় 'তবুও প্রয়াস' প্রকাশনা থেকে জয়দীপের প্রথম গদ্য সংকলন 'হৃদয়পুর কত দূর?' প্রকাশ পায়। এই লেখার মধ্যেই তিনি আনন্দ খুঁজে পান। আর প্রতিযোগিতামূলক এই জীবনে এই লেখাই তাঁর কাছে একটা রিফিউজ। লেখার প্রতি ভালবাসার টানেই উনি লিখতে চান... যতদিন পারেন।

1 Comment

ARKAYAN BASU · ডিসেম্বর 15, 2021 at 7:44 অপরাহ্ন

এ লেখাকে এক অনন্যস্বাদের গল্প বলতেই পারি আমি।এ লেখা অনুভবের বুনন।কাব্যচিত্র তার অলংকার এবং অবশ্যই অহংকার। stream of consciousness টেকনিকের অসম্ভব সুন্দর প্রয়োগ বাস্তব-অনুভব-কল্পনাকে একইসূত্রে আলোছায়ার খেলায় তরঙ্গায়িত করেছে।’বেশআছিপুর’ প্ল্যাটফর্ম ছুঁয়ে যে ঠিকানা ‘সব কিছু একইরকম’,তার থেকে ‘কেউই জানবে না’ মাইল দূরের যে অপেক্ষারত রেললাইনের গায়ে ভালোবাসার কনে দেখা আলো এসে পড়ে,সেখানেই গোলাপী চুম্বন লুকোনো থাক সেই ছেলেটার শৈশব-কৈশোর ঠোঁটে।এই অনুরণন তো আমরা সকলেই বয়ে নিয়ে চলি আজীবন।ক’জন লিখতে পারি আপনার মতো!শুভেচ্ছা অন্তহীন। লিখে চলুন জলরঙের স্পন্দনকে।♥

মন্তব্য করুন

Avatar placeholder

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।