চৌথুপীর চর্যাপদ – এক অনন্ত অন্বেষণ

তুষার কান্তি দত্ত on

chothupir_chorjapod

গঅণ পদুমা রঅণ আঠাশ পাখুরী
দিবসই ন দিঠঠে অচ্ছই অন্ধারি

ভাষাটা চর্যাপদের ভাষা। আমাদের প্রাচীন বাংলাভাষার শৈশবের কাল। পুরোটাই সন্ধাভাষা। আর এর হরফ, সংকেত লিপির মত। এই ভাষায় লেখা তথ্যের অনুসন্ধান করার অর্থ অন্ধকারে সাপ খোঁজা। গত চব্বিশ ঘন্টায় ইন্টারনেটে “চৌথুপি” খুঁজতে গিয়ে নাস্তানাবুদ অবস্থা। কিছুই খুঁজে পাচ্ছি না। একবার বাংলাদেশে যাচ্ছি তো একবার উত্তরবঙ্গ ঘুরে বেড়াচ্ছি। ওয়েবপেজ, উইকিপিডিয়া, গুগল ম্যাপ, ব্লগ, সোস্যাল নেটওয়ার্ক সবকিছু খুঁজলাম। নাহ, কোথাও এই নামে কোনো তথ্যসূত্র নেই।

“১২০৫ অব্দের কোন এক সন্ধ্যা। চৌথুপীর সঙ্ঘারামে মরণভয় ছড়িয়ে পড়েছে ……। অন্ধকার সঙ্ঘারামের শূন্য প্রাঙ্গণে পদচারণা করছেন মহাস্থবির” …… তুরুষ্কু সেনারা আক্রমণ করেছে চৌথুপী – এই ভাবেই শুরু হয়েছে উপন্যাসটি। রহস্যের ঠাস বুনোটে গল্প এগিয়ে চলে। সমান্তরাল ভাবে লেখকের তুলির টানে ক্রমাগত স্পষ্ট হয় অতীত ও বর্তমান। সংস্কার, ধর্মীয় চেতনা, দর্শন জড়ির সুতোর মত জুড়ে রাখে অতীত আর বর্তমানের কাঠামোকে। গবেষনামুলক এই উপন্যাস নিঃসন্দেহে বাংলা তথা বাঙ্গালীর এক ঐতিহাসিক দলিল।

জলপাইগুড়িতে বিশ্বজিৎ আর কালচিনিতে অরিন্দমকে ফোন’ও করলাম আজ সকালে। কিন্তু জায়গাটা ট্রেস করার মত অথেন্টিক কিছু পেলাম না। তবে জায়গাটা করতোয়া নদীর খুব কাছে। মূল উপন্যাসে আত্রেয়ীর নামও বারে বারে এসেছে। সুত্রধর প্রীতম বসু লেখাতে স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন জায়গাটা বরেন্দ্রভূমির’ই অন্তর্গত। জায়গাটা ভীষণ ভাবে চেনা চেনা ঠেকছে। অথচ খুঁজে পাচ্ছি না।

সন্ধাভাষার মত ইতিহাসের সেই স্থানটা কি শুধুমাত্র লেখকের কল্পনায় ? বাস্তবে যার অস্তিত্ব নেই! কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া এ এক স্থানের সত্ত্বা। যেন এক স্পেস-টাইম ডাইমেনশন। কৃষ্ণগহ্বরে ডুব দিয়ে তার কার্য-করণের সম্পর্ক হারিয়েছে। ছিল অথচ আজ কোনো অস্তিত্বই নেই! চৌথুপী যে দেবিকোট নয় এটা পরিস্কার। আবার জায়গাটা মহানন্দা ও করোতোয়া নদীর মাঝামাঝি একটা জায়গা সেটাও ঠিক। তবে গঙ্গার তীরে গৌড় কিম্বা পুনর্ভবার তীরে কোটিবর্ষ, দেবকোট, বা করতোয়ার তীরে শিলদ্বীপ
কিম্বা মহাস্থান যে এটি নয়, তা বইয়ের আলোচনাতে পরিস্কার। দিনাজপুরের দক্ষিণে কিছুতেই এই জায়গার অবস্থান হবে না। ওদিকে ছিল গৌড় রাজ্য। একইভাবে পূর্বদিকেও হবে না। পুর্বদিকে ছিল কামরূপ রাজ্য।

বাংলাদেশের একটা উইকিপিডিয়া পেজ বলছে ষষ্ঠ থেকে সপ্তম শতকের মধ্যে কোন এক সময় ভিটাগড় ছিল বরেন্দ্রভূমির একটি প্রচীন দূর্গ শহর। বাংলাদেশের উত্তরে রংপুর সাব-ডিভিশনের অন্তর্গত পঞ্চগড় জেলা’তে এই ভিটাগড় । ঐতিহাসিক সিল্করুটের পথেই অবস্থিত ছিল এই শহর। তিব্বতের সাথে পৌন্ড্রবর্ধন সাম্রাজ্যের যা ছিল যোগসূত্র। “চৌথুপীর চর্যাপদ” উপন্যাসের অনুষঙ্গ যে বাঙলাকে জুড়েছে তিব্বতের সাথে তা একশ শতাংশ ঠিক। কিন্তু বর্তমানের চৌথুপী শিলিগুড়ির কাছাকাছি কোনো একটা লোকেশন। গল্পে তেমনটাই উল্লেখ আছে। শিলিগুড়ির আশেপাশে বলতে কান্দারানে দমনভিটি, ময়নাগুড়ির কাছে জটেশ্বরের মন্দিরের ভগ্নস্তূপ, কালচিনির কাছে নল রাজার গড়। কিন্তু এই জায়গাগুলো যে চৌথুপী নয়। লেখাতে তাও স্পষ্ট। তাহলে চৌথুপী কোথায়?

জলপাইগুড়ির কাছে গরালবাড়ি যদি আজকের চৌথুপীর লোকেশন ধরে নি, তাহলে বিষয়টা দুয়ে দুয়ে চার হয়। আবার বলে রাখা ভালো পুরোটাই আমার অনুমান নির্ভর। গরালবাড়ি আর ভিটাগড় কাঁটাতারের এপার ওপার। সীমান্তের একদিকে বাংলাদেশ অন্য দিকে ভারত। অতীতের চৌথুপী সময়ের ধূলিধূসর যাত্রাপথ পেরিয়ে আজ এক ব্লক-জোনে।

যারা এই উপন্যাসটি পড়েছেন তাদের কাছে জানতে চাইবো অতীতের চৌথুপী সত্যিই আজ কোথায়? আর যারা পড়েন নি এখনও, তাদের বলবো এক্ষুনি পড়ে ফেলুন …… ঘুরে আসুন টাইম মেশিনে, ইতিহাসের এক রুদ্ধশ্বাস যাত্রায়! একবার পড়তে শুরু করলে দু-তিন দিনের জন্য অবশ্যই মুক্তি পাবেন প্যান্ডেমিকের ভয় থেকে।

Choupathir charjapod 1
ছবি- রাবাংলা থেকে রালং মনস্ট্রী যাবার পথে একটা পাহাড়ি রাস্তা।
thanks to দেবাদৃতা ঘোষ ও Pritam Majumdar.

চৌথুপী -২

দৈশিক ভূগোল বা spatial Geography তে কোন স্থান মানেই, তার অবস্থান। আর অবস্থানের ক্ষুদ্রতম অংশের টেকনিক্যাল নাম বিন্দু। ইদানিং স্যাটেলাইট ইমেজারিতে তাকে আমরা পিক্সেল বলেও ডাকি। যা কিনা ছোট হতে হতে অসীমে বিলীন। শুন্যের কাছাকাছি একটা মাত্রাক্রম। কিন্তু শূন্য নয়। দার্শনিক ভাবে কিন্তু আবার বিন্দুর কোন অস্তিত্বই নেই, পরস্পরছেদি দুটো সরলরেখা ছাড়া। পৃথিবীতে কোন জায়গার অবস্থান খুঁজতে গিয়ে মানুষ খ্রিস্টজন্মের তিনশো বছর আগে থেকেই শুরু করেছে লাইন টানাটানির কাজ। খ্রিস্টীয় ১৫০অব্দে জ্যোতির্বিদ টলেমি ২৭টি মানচিত্র নিয়ে প্রকাশ করেন তার বিশ্বমানচিত্র। ভ্রমণকারীদের কাছ থেকে পাওয়া এই মানচিত্রে দেশ-পরিচয় ছাড়াও ছিল দ্রাখিমারেখা আর অক্ষাংশের মান। মানচিত্রের এই বই থেকে জানা যায়, টলেমি ক্যানারী দ্বীপ বা ফরচুনেট আইল্যান্ডের কাছে ০ডিগ্রী দ্রাঘিমা রেখাটি টেনেছিলেন। আফ্রিকার মরোক্ক থেকে ৬২মাইল দূরে আটলান্টিক মহাসাগরে অবস্থিত ক্যানারী দ্বীপ মহাদেশীয় পাত সীমানায় কতগুলি আগ্নেয় দ্বীপমালার সমষ্টি। টেকটনিক প্লেট মুভমেন্ট ছেড়ে আবার দ্রাঘিমাতে ফেরা যাক। যদিও টলেমি নিরক্ষরেখাকে সমান্তরাল রেখাগুলির মধ্যবর্তী রেখা বলেই গন্য করেছিলেন। কিন্তু দ্রাঘিমা নিয়ে টলেমির সমস্যা ছিল। উত্তর দক্ষিণে প্রসারিত এই রেখাগুলির সঠিক গন্তব্যটা কি? তা তার জানা ছিল না! অর্থাৎ উত্তর ও দক্ষিণ মেরু বিন্দুর ধারণা ছিল না সে আমলে।

এরপর ঘটলো আরও মজার ঘটনা। টলেমি পরবর্তী মানচিত্র আঁকিয়েরা ০ডিগ্রী দ্রাঘিমাকে সরিয়ে নিয়ে গেলেন নিজেদের ইচ্ছে মত। ফলে পুরনো পৃথিবীর মানচিত্রে ০ডিগ্রী দ্রাঘিমা যেমন টানা হয়েছে আজোরেস এবং কেপ ভার্দেতে তেমনই রোম, কোপেনহেগেন, জেরুজালেম, সেন্ট পিটার্সবার্গ, ফিলাডেলফিয়া, প্যারিস …… কোথায় না! আসলে মুল-মধ্যরেখার কল্পনা একটা ভাবনাত্মাক বিষয়। সকলের মান্যতায় এই “ধরে নেওয়াটাই” সবচেয়ে বেশী জরুরী। ঠিক যেমন একটা বিশেষ পরিমান ভরকে আমরা এক কেজি বা বিশেষ দুরত্বকে এক কিমি বলে মেনে নিয়েছি। ঠিক সেই রকম।

১৮৮৪ সাল। স্থান ওয়াশিংটন, আমেরিকা। বিশ্বের ২৬টি দেশের প্রতিনিধিরা এসেছেন এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে। লন্ডন শহর থেকে সাত মাইল দূরে গ্রিনিচ নামে ছট্ট একটা শহর। সেখানে রয়েছে দেশের পুরনো রাজকীয় মানমন্দির। আলোচনায় ঠিক হলো এখন থেকে গ্রিনিচের উপর দিয়ে উত্তর থেকে দক্ষিণে মেরুবিন্দুদ্বয় সংযোগকারী রেখাই হবে মূলমধ্য রেখা। বলা বাহুল্য, ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ক্ষমতার জোরেই এই মর্যাদা অধিকার করে। যদিও পরবর্তী ২৭ বছর ফরাসিরা এই সিদ্ধান্ত মেনে নেননি। ১৯১১সালের আগ পর্যন্ত ফরাসি দেশে প্যারিসই ছিল ০ডিগ্রী দ্রাঘিমা রেখা।

সবাই হয়ত ভাবছে এতশত প্রস্তাবনার কারণ কি? এসব তো সবারই জানা। তা ঠিক! কিন্তু গৌরচন্দ্রিকার উদ্দেশ্য একেবারেই আলাদা। এবারে মূল বিষয়ে ফেরা যাক। “চৌথুপীর চর্যাপদ”। ১২০৫ অব্দ। কাহিনীর শেষের দিকে প্রীতম বসু বলছেন চৌথুপীর সংঘারামের প্রচুর প্রাচীন পুঁথি(তৎসহ চর্যাগীতি) গন্ধকালী নামে একজন বিদুষী ভিক্ষুনী তুরস্কু আক্রমন থেকে বাচানোর জন্য কোন এক স্থানে লুকিয়ে রাখছেন। কিন্তু জায়গাটা কোথায়?

৪৩১পাতায় চর্যাপদের ব্যাখ্যায় “গঅণ -পদুমা -রঅণ -আঠাশ –পাখুরী/ পুচ্ছত উত্তর তহি” এই বাক্যবন্ধের মানে দাঁড়ায় ২৮.৯০উত্তর কোন অক্ষাংশ। গঅণ মানে শুন্য। রঅণ মানে রত্ন- নবরত্ন- মুক্তা, মানিক্য, বৈদুর্য্য, গোমেদ, বজ্র, বিদ্রূম, পদ্মরাগ, মরকত, নীলকান্ত। তারপর আঠাশ পাখুরী একসঙ্গে। লিখলে সংখ্যাটা হয় ০৯(২৮)। বামাবর্তে সাজালে দাঁড়ায় ২৮৯০। ২৮.৯০ডিগ্রী উত্তর কোন স্থান। পুচ্ছত উত্তর তাহি- এই “উত্তর” প্রশ্ন-উত্তরের উত্তর নয়। এর মানে উত্তর দিক। মানে নর্থ। পুরো মান’টা উল্টো দিক থেকে। বিজয়গুপ্তের “পদ্মাপুরাণের” স্টাইলে বামাবর্তে গোনা। উত্তর দিক নিয়ে কোন সমস্যা নেই। সে আমলে ভারত জ্যোতির্বিদ্যায় অনেক উন্নত ছিল। মহাকাশ, নক্ষত্রদের অবস্থান, চন্দ্রের পরিক্রমা, এসব ভারতীয় পন্ডীতদের নখদর্পনে ছিল। রাতের আকাশে ধ্রুবতারার অবস্থান দেখে অক্ষাংশের মান বলা অসম্ভব ছিল’না। তাছাড়া চৌথুপী সংঘারামে যে মানমন্দির ছিল, তাও স্পষ্ট ভাবে উপন্যাসে বলা আছে। কিন্তু সমস্যাটা দ্রাঘিমা নিয়ে।

চৌথুপীর চর্যাপদের ৪৩৩পাতা আমাদের বলছে
“পুচ্ছি জোই পুবে দিঠঠে চান্দ গঅণে/ হস্তি অঙ্গ পীছে পোথী সিদ্ধে তিহুঅণে”। বিস্তারিত ব্যাখ্যায় না গিয়ে এটুকু বলা যায় এর মানে হলো ৮৮.০১ডিগ্রী পূর্ব কোন একটি স্থান। গুগল মানচিত্রে ২৮.৯০উঃ/৮৮.০১পূঃ দিয়ে সার্চ করতেই ২০৭১কিমি দূরে তিব্বত মালভূমিতে আশ্চর্যজনকভাবে শাক্য মনস্ট্রী ভেসে উঠলো কম্পিউটারের স্ক্রিনে। কি আশ্চর্য! বইতেও এই শাক্য সঙ্ঘারামের কথাই বলা হয়েছে। প্রচুর পরিশ্রম করে যে এই উপন্যাসটা লিখতে হয়েছে সেটা স্বীকার করে নিয়েই দ্রাঘিমার খচখচানিটা কিছুতেই কাটাতে পারছি না। দ্রাঘিমার এই মানটা “বর্তমান মান”। অর্থাৎ ১৮৮৪ সালে গ্রিনিচের মানমন্দির কে মুলমধ্য রেখা ধরে নিয়ে যে গননা, সেই গননায় সঠিক। তাহলে অতবছর আগে এই হিসেবটা গন্ধকালীর(চর্যাগীতি কবি) পক্ষে লিখে রাখা অসম্ভব। লেখক(কাহিনীতে)অবশ্য বলেছেন – “পরবর্তীকালে কেউ ওই পুঁথিতে লঙ্গিচুডের মাপটা লিখে গেছিল …… হাতের লেখাটা মিলিয়ে লিখেছিলেন বটে কিন্তু কালি মোটেই মোটা আর উজ্জ্বল না। দেখে বোঝা যায় এটা পরবর্তী সংযোজন”। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো ফ্রান্সিস ইয়ংহাসবেন্ডের নেতৃত্বে ইংরেজরা প্রথম তিব্বত আক্রমন করে। সালটা ১৯০৪। আর এই সময়েই তিব্বত প্রথম পাশ্চাত্য সংস্কৃতির মুখোমুখি দাঁড়ায়। এত দিন লাসা(তিব্বত)ছিল নিষিদ্ধ নগরী। ১৯০৪এর আগ পর্যন্ত তিব্বতের সাথে যতুটুকু বৈদেশীক, সামরিক, প্রতিরক্ষা বা সামাজিক সম্পর্ক ছিল, তা ছিল মূলত মঙ্গল, চীন বা বঙ্গদেশের সাথে। তাহলে টেকনিক্যালি “পুচ্ছি জোই পুবে দিঠঠে চান্দ গঅণে/ হস্তি অঙ্গ পীছে পোথী সিদ্ধে তিহুঅণে”। এই লাইনটা যদি কাউকে লিখতেই হয়, তবে তাকে ১৯০৪ সালের পরবর্তী কোন সময়েই যে লিখতে হবে, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। তাহলে কে লিখলেন দ্রাঘিমার মাপ? তিব্বতের কোন লামা? কে তিনি? তবে কি ১৯শতকেও তিব্বতে চর্যাভাষার প্রচলন ছিল? কারণ এই সময়ে বাংলায় একজনও সন্ধাভাষায় কথা বলে না। পালযুগ নেই। বৌদ্ধধর্ম (মহাযান ও বজ্রযান) কালের প্রবাহে হারিয়ে গেছে। চলছে ইংরেজ শাসন …… হিন্দু-মুসলিম দ্বৈরথ।

চৌথুপী – ৩

1940 সালের অবিভক্ত E.B Railway -এর একটি প্রকাশনা আমাদের জানাচ্ছে—-
“জলপাইগুড়ি শহর হইতে নয় -দশ মাইল পশ্চিমে ভিতরগড় নামক একটি প্রাচীন দুর্গের ধ্বংসাবশেষ আছে…. ইহাতে পর পর চার প্রস্থ বেষ্টনীর মধ্যে গড় ও চারিদিকে পরিখা এবং দুর্গের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত ভগ্ন প্রাসাদের পার্শ্বে একটি প্রকান্ড নির্মল সলিলা দীঘি বিদ্যমান আছে। দীঘিটি “মহারাজ দীঘি” নামে পরিচিত। এবং ইহাতে দশটি ঘাটের ভগ্নাবশেষ দৃষ্ট হয়”
গুগল মানচিত্রও আমাদের একই লোকেশন দেখাচ্ছে। জলপাইগুড়ি শহর থেকে 15কিমি(9.321মাইল) দক্ষিণ-পশ্চিমে বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া জনপদ, গরালবাড়ি। এটাই অতীতের ভিতরগড়ের লোকেশন।
বাগডোগরা এয়ারপোর্ট থেকে দূরত্ব 55কিমি। দেড় ঘন্টাতেই পৌঁছে যাওয়া যায়। এয়ারপোর্ট থেকে এটুকু দূরত্ব গাড়ি ভাড়া করে যাওয়াই যেতে পারে। গল্পের শুরুতে তাই যোজনগন্ধাকে(প্রধান চরিত্র) আমরা দেখি বাগডোগরা এয়ারপোর্ট-এ নেমে এই লোকেশনে রওনা দিতে।

ক্ষেত্র সমীক্ষায়, বাংলাদেশের পুরাতাত্ত্বিক ও সংষ্কৃতিক মন্ত্রণালয় আমাদের জানাচ্ছে
“Bhitargarh the biggest fort of Bangladesh is situated at the northern most border land of Panchagarh district. In plan it is almost a trapezoid and none of its four wings is equal in length to another. Vast plain land is enclosed by an earthen rampart with an attached moat on all sides. The existing average height of its rampart is 4.25m and the breadths are 13m. It’s 2.828km on northern wings has an inlet, locally known as kalduar(door of horror) in its middle sector.”

তাহলে কি এই কালদুয়ারেই যোজনগন্ধার বাবা কোন একদিন হারিয়ে গিয়েছিল?
এই লুকনো পথ দিয়েই কি তবে পুঁথি গুলো তিব্বতের শাক্য সংঘরামে চলে যায় কোন এক দিন?
এই লুকনো সুড়ঙ্গই কি তবে ছিল সঙ্ঘারাম থেকে পালানোর গোপন পথ?

The fort contains another smaller trapezoid in its middle sector which is also encircled by earthen rampart containing 2.52m thick walled core. It is also encircled by a wide moat. The bricks used in construction of the walled-core are of square size and the mortar is mud. Other places of interest inside the fortification are as follows –

  1. Maharajar dighi 2. Maharajar bari
  2. Maharajar jachai bari 4. Maharajar bhita 5. Hatisur

“সঙ্ঘারামের ঠিক পেছনে এক বিশাল এলাকা জুড়ে ডহর, মানুষ সমান শর, হোগলা, বনঝামা, আশশেওড়া, বেতসের জঙ্গলে ভরা। নিম্নভূমির তিনদিন ডাঙ্গর পাড়। কিন্তু একদিকে কোনো পাড় নেই। সেদিকটা খালের সঙ্গে সংযুক্ত, খালের জল প্রবেশ করে ডহরে কাদাভরা ছোটো ছোটো জলাভূমি সৃষ্টি করেছে সেখানে একদল দীঘলগ্রীব কোরাপাখি তিরতিরে জলে মালিনী মাছ পোকা এসব খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে।
একসময় এটা একটা বিশাল দিঘি ছিল। নাম বজ্রদিঘি……”
— পৃষ্ঠা১৪৯, চৌথুপীর চর্যাপদ

তাহলে অতীতের সেই বজ্রদিঘি’ই কি আজকের মহারাজা দিঘি?

“এই দিঘিটা আসলে আত্রাই নদীর পরিত্যক্ত খাত। পালযুগে বাংলার নৌ-বাহিনীর জগতজোড়া খ্যাতি ছিল। নৌযুদ্ধে প্রবল পরাক্রম পালরাজাদের কেউ হারাতে পারত না। পালরাজাদের যুদ্ধবিদ্যা বিশারদরা এই পরিত্যক্ত খাতকে এক বিশাল গভীর দীঘিতে রূপান্তরিত করেছিলেন…..বহি:শত্রুর আক্রমনের সময় নৌসেনার অধ্যক্ষ নাকাধ্যক্ষ্যের আদেশ হলেই ‘হী হী’ নিনাদে নৌসেনারা এই জলপাটক খুলে রণতরী নিয়ে দ্রুত নদীতে এসে পড়ে শত্রুকে আচমকা আক্রমণে পর্যুদস্ত করত। অপূর্ব ছিল তাদের প্ৰযুক্তি।”
— পৃষ্ঠা ১৫০ ,চৌথুপীর চর্যাপদ

দুয়ে দুয়ে চার। অতীতের সেই ধূসর চর্যাপদের শহর(চৌথুপী) আজকের ভিতরগড় বা গরালবাড়ি। সন্ধ্যা ভাষায় লেখা সেই লোকেশন অনেক চেষ্টার পর খুঁজে পেয়েছি। সময়-শকটে লেখক যে কল্পনার রাজ্যে পরিভ্রমণ করেছেন …… সেই দূরতম ধ্যানবিন্দুতে পৌঁছে পুরাতাত্ত্বিক অবশেষ হয়ত ভাবিকালের ইতিহাসে ফেলে যাবে আলোর বর্নালী।

তথ্যসূত্র:

চৌথুপীর চর্যাপদ
Archaeological survey report of greater Dinajpur District
A travelogue on historical documents and legends
Google Map
Communities and Micro Heritage in Bhitargarh, Bangladesh ‘

চৌথুপী -৪

তিব্বতের পথে ………
1206 সাল। খিলজি তিব্বত আক্রমণের প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছেন। প্রায় দশ হাজার সেনা সহ উপস্থিত হিমালয়ের দক্ষিণ প্রান্তে। এখান থেকেই তরাইয়ের গহীন জঙ্গল শুরু। দক্ষ পথ প্রদর্শক ছাড়া এগোনো কিছুতেই সম্ভব নয়। এই অঞ্চলের একজন উপজাতি প্রধান আলী মেচ। যিনি কিনা সদ্য সদ্য ইসলাম কবুল করেছে। তিনিই এই অভিযানের পথ পদর্শক। উত্তরের এই যাত্রাপথে খিলজি কামরূপের রাজাকেও আমন্ত্রন করেছেন। যদিও কামরূপের রাজার তাতে সম্মতি নেই। বিরাট সৈন্যদল নিয়ে বখতিয়ার খিলজি উত্তরবঙ্গ ও সিকিমের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করে এসেছে ১৫দিনের দুর্গম পথ। ট্রান্স হিমালয় পার করতেই চুম্বি উপত্যকা। তিব্বতের টেকনিক্যাল প্রবেশ দ্বার। শীতল উপত্যকা। রাতের তাপমাত্রা হিমাঙ্কের কাছাকাছি। গাছপালা নেই বললেই চলে। রুক্ষ পাহাড়। ইতস্তত পাহাড়ের গায়ে চাপ চাপ বরফ। উঁচু উঁচু শৃঙ্গ। খরস্রোতা নদী। যদিও এতটা পথ প্রতিরোধহীন ভাবেই চলে এসেছে সৈন্যরা। কিন্তু তিব্বতের মূল ভূখন্ডে পা রাখতেই বখতিয়ার টের পেল যে তিনি ফাঁদে আটকে গেছে। ইতিমধ্যে গেরিলা স্টাইলে তিব্বতের সৈন্যরা খিলজিকে আক্রমণ শুরু করেছে। অবস্থা প্রতিকূল অনুমান করে খিলজি পিছু হঠতে থাকে। ক্ষুধার্ত সৈন্যরা খাদ্যাভাবে তাদের ঘোড়াগুলিকে পর্যন্ত জবাই করছে। বিপর্যস্ত সৈন্যরা নির্মম ভাবে ফিরে আসছে হিমালয়ের দক্ষিণ ঢাল বরাবর। ইতিহাস বলছে দশ হাজার সৈন্যের মধ্যে শেষ পর্যন্ত একশ জন সৈন্যই নাকি দেবীকোটে ফিরতে পেরেছিল। ফেরার সময় নদীপথে পুনরায় তাদের সাথে কামরূপের সৈন্যদের চোরাগোপ্তা লড়াই হল। খিলজির বিশাল বাহিনীর অনেক সৈন্য স্রোতের আবর্তে হারিয়ে গেল ব্রহ্মপুত্রে।

ট্রান্স-হিমালয়ের সিল্ক রুট, Tea Horse Road নামেও পরিচিত। সম্ভবত এই পথ ধরেই বখতিয়ার খিলজি তিব্বত আক্রমন করেছিলেন। ৬১৮ সালের ১৮ই জুন চীন সম্রাট গাউজু “তাং রাজবংশের” প্রতিষ্ঠা করেন। এই শাসনকাল ছিল কলা, সাহিত্য, বিশেষ করে কাব্য সাহিত্য এবং কারিগরী উৎকর্ষতার স্বর্ণ যুগ। এ আমলেই চীনে বৌদ্ধ ধর্ম সাধারণ মানুষের ধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। তাং রাজবংশের আমলে এই পথে প্রথম বানিজ্য শুরু হয়। এই পথ দিয়ে চা আসতো চীন থেকে আর ঘোড়ার চাহিদা মেটাতো মধ্য এশিয়া। মূলত ঘোড়া আর চা’য়ের ব্যাপারীরা এই পথ অনুসরণ করত বলেই এই পথ ‘টি হর্স রোড’ নামে পরিচিত। তাং রাজবংশের আমলে এই পথ প্রসিদ্ধ লাভ করলেও, এই পথের উত্তরে সদ্য আবিষ্কৃত কিছু সমাধি আজ থেকে চার পাঁচ হাজার বছর পূর্বেও এই পথে মানুষের আগমনের সাক্ষ্য বহন করে। এই পথে শুধু ব্যবসা বানিজ্যই হত না, বরং তিব্বত ও চীনের সাথে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংস্কৃতি, লোকাচার, প্রচলিত ধ্যানধারণা ও ঐতিহ্যের আদান-প্রদান চলত।
জেলেপ লা গিরিপথ, জুড়ে রেখেছিল তিব্বতকে ভারতের সাথে। জেলেপ লা গিরিপথ অতিক্রম করেই বখতিয়ার খিলজি চুম্বি উপত্যকার ইয়াডং-এ ঢোকে। জেলেপ লা গিরিপথ ছিল মধ্য এশিয়ার সবচেয়ে প্রাচীন স্থল পরিবহন পথের কেন্দ্রবিন্দুতে। জেলেপ লা অতিক্রম করলেই ইতিহাস বিখ্যাত চুম্বি উপত্যকা। এখান থেকেই শুরু তিব্বতের মুল ভুখন্ড। একদিকে ভূটান অন্যদিকে সিকিমের সীমানা। মাঝের ত্রিকোনাকৃতি খাঁজটিই চুম্বি ভ্যালি। এখান থেকে আরোও উত্তরে কাংবুজিয়াং। কাংবুজিয়াং হয়ে রাস্তা চলে গেছে লুওগিয়াও তে। লুওগিয়াও এ রাস্তা দুভাগে বিভক্ত হয়েছে। একটি সোজা উত্তরে লাসা’য় চলে গেছে অপরটি উপন্যাসে বর্নিত খাম্বা(বর্তমান নাম কাম্বা) পর্যন্ত চলে গেছে। কাম্বা জং-এর অবস্থান সিকিমের ঠিক উত্তরে। সিকিম বর্ডার থেকে দুরত্ব মেরেকেটে ২০কিমি। আর চোর্তেন নাঈমা পর্বত শৃঙ্গের অবস্থান সিকিমের উত্তর পশ্চিমে তিব্বত ভারত সীমান্ত লাগোয়া। তবে প্রাচীন সিল্করুটে লাসা যাওয়ার পথ অবশ্য ইয়াডং থেকেই আলাদা হয়ে গেছে। যদি বখতিয়ার খাম্বা-জং আক্রমন করে থাকে(উপন্যাসে বর্নিত)তবে তাকে এই পথই অনুসরণ করতে হয়েছিল।

বখতিয়ারের হানাদার বাহিনী কোন দিক দিয়ে এগিয়ে গেছে, সে সম্পর্কে সমসাময়িক কাজগুলিতে স্পষ্টভাবে কিছু উল্লেখ করা হয় নি। তবে এ বিষয়ে সন্দেহ নেই যে তিব্বতে যাওয়ার পথে বখতিয়ার কামরূপের রাজার সাথে যোগাযোগ করেছিলেন। দেবীকোট ছেড়ে যাওয়ার সময় তার প্রথম বিষয়টি ছিল পূর্বদিকে অগ্রসর হয়ে কামরূপে পৌঁছানো। প্রখ্যাত পন্ডিত ভট্টশালী বখতিয়ারের তিব্বত আক্রমণে ভূপ্রকৃতিগত (topography and terrain ) দিকটিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। তাঁর মতে তিনটি সাম্ভাব্য পথ দিয়ে বখতিয়ার তিব্বতে যাত্রা শুরু করেছিলেন। মিনহাজের তবাকত-ই-নাসিরি আমাদের স্পষ্ট ভাবে বলছে আলি মেচ মুসলিম সেনাবাহিনীকে বর্ধনকোট নামে একটি শহরে নিয়ে যায়। তবে অতীতের এই বর্ধনকোট শহর বর্তমানে যে কোথায়, কে জানে! উইকি-মানচিত্রে বাংলাদেশে অবস্থিত ঘোড়াঘাটের ১৮কিমি দক্ষিন-পূর্বে বর্ধনকুঠি বলে একটি জায়গার উল্লেখ করলেও বর্তমানের বর্ধনকুঠি আর অতীতের বর্ধনকোট যে এক জায়গা নয়, তাঁর কারণ আলি মেচ একজন মেচ উপজাতির মানুষ। সেক্ষেত্রে তরাইয়ের আশেপাশেই এই বর্ধনকোটের শহরের অবস্থান হবে বলে অনুমান। আলি মেচের সাথে খিলজির প্রথম সাক্ষাৎ কোথায়, সে সম্পর্কেও তবাকত-ই-নাসিরিতে কিছু বলা নেই। তবে উল্লেখ আছে বাগমতী নদীর তীরে বর্ধনকোট শহর। এই বাগমতী যদি আজকের বাগমতী নদী হয় তাহলে কাঠমান্ডু শহর’ই যে বর্ধনকোট সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু কামরূপ থেকে কাঠমান্ডু হয়ে তিব্বত। ১৬দিনে এতটা পথ ঘোড়ায় চরে ট্রান্স হিমালয় অতিক্রম অসম্ভব ব্যাপার। সম্ভবত উত্তরের জলঢাকা, মানস তোর্সা বা অন্য কোন নদী অতীতে বাগমতী নামে পরিচিত ছিল। উপন্যাস বলছে (পৃষ্ঠা-৪০৫) বাগমতী পার হয়ে কামরূপ রাজ্য। সেক্ষেত্রে আজকের ব্রহ্মপুত্র নদ’ও হতে পারে। আবার করতোয়া নদীও হতে পারে। আমার মনে হয় করতোয়া নদী হওয়াটাই বেশি প্রাসঙ্গিক। কারণ এর পর আলি মেচ রাঙ্গামাটির দিকে রওনা হয়।

অনেক অনুসন্ধান করে মনে হলো ইখতিয়ার উদ্দিন মহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির তিব্বত আক্রমণের সাম্ভাব্য যাত্রাপথ ছিল-
মালদা > দেবীকোট > দিনাজপুর > রংপুর > কুড়িগ্রাম > দিনহাটা > কোচবিহার > বর্ধণকোট(?)> রাঙ্গামাটি > কালিম্পং > পেডং > জেলেপ লা গিরিপথ > ইয়াডং > কাংবুজিয়াং > লুয়োজিয়াও > খাম্বা জং

খাম অঞ্চল দক্ষিণ তিব্বতের একটি অংশ। আজকে আমরা যাকে তিব্বত অটোনমাস রিজিওন মনে করি, সেই অঞ্চল সহ সিচুয়ান, উত্তরে ইউনান ও গানসুর কিছু অংশ নিয়েই ছিল অতীতের খাম অঞ্চল। ১৯১১ থেকে ১৯৪৯ সালে এটি রিপাবলিক অব চায়নার অংশ হলেও বেশ কিছু ক্ষেত্রে টিবেটান সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টের স্বায়েত্বশাসন ছিল। উঁচুনিচু পর্বত সঙ্কুল ভূপ্রকৃতিই, গভীর গিরিখাত আর বরফাবৃত পর্বত নিয়েই খাম অঞ্চল। জনঘনত্ব খুব কম। সামান্য কিছু উপত্যকায় কৃষি ও পশুপালন নির্ভর জনবসতি। কিছু কিছু ভাষাতত্ত্ববিদ ও নৃতত্ববিদ অবশ্য খাম অঞ্চলেকে “এথিনিক করিডোর অব টিবেট”-ও মনে করেন। যদিও জাতিগত ভাবে লাসার থেকে খাম অঞ্চল আলাদা। তবু বিশ্বাস, ধর্ম সংস্কৃতিতে লাসার সাথে এই অঞ্চলের অনেকটাই মিল ছিল। এই অঞ্চল চুশি গ্যাংড্রুক নামেও পরিচিত ছিল। ছয়টি পর্বতশ্রেনী ও চারটি নদী উপত্যকা দিয়ে ঘেরা ছিল এই অঞ্চল। অবশ্য তাদের সার্বভৌমত্ব প্রায়শই হান চাইনিজদের অধিনে ছিল। খামের এই বিস্তৃন অঞ্চল কখনই একক রাজার দ্বারা শাসিত হয় নি। বরং চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল ছোটছোট গোষ্ঠী ও গোষ্ঠীপতি। তবে বুদ্ধবাদের প্রভাব থাকায় বেশিরভাগ গোষ্ঠীপতিই দলাই লামাকে শ্রদ্ধা করত। এবং প্রায়শই লাসা’র সরকারের সাথে যোগাযোগ করত। খামে ছিল দুই ডজন বা তারও বেশি রাজ্য ও উপজাতি। যারা নিয়মিত একে অপরের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। উপন্যাসে বর্নিত খু-স্তোন সম্ভবত এমন’ই এক উপজাতির রাজা ছিলেন। তবে নবম শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে তিব্বতীয় সাম্রাজ্যের পতনের পর থেকে খামের জনগন আগ্রাসীভাবে আক্রমনকারী দেশগুলির কাছ থেকে তাদের স্বাধীনতা অনেকাংশে অক্ষুন্ন রেখেছিল।

উইকিপিডিয়ার একটি পেজ আমাদের জানাচ্ছে তিব্বত ও ভূটানের সীমান্তবর্তী অরুনাচল প্রদেশের পশ্চিমাঞ্চলে ইয়াং-সাং-চু উপত্যকায় বসবাসকারী অধিবাসীরাই খাম্বা জনজাতি। খাম্বারা তিব্বতীয় বৌদ্ধধর্মের অনুগামী এবং হিংনা তাদের নিজস্ব লিপি। যার সাথে তিব্বতীয় লিপির সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে। মানচিত্র অনুসারে সিকিমের সিনয়লচু পর্বতের ঠিক সোজা উত্তরে এই চোর্তেন নাঈমা পর্বত। লোনাক(Lhonak) শৈলশিরা বরাবর কিছুটা উত্তরে গেলেই চোর্তেন নাঈমা। সিকিম ও ভূটানের মধ্যবর্তী চুম্বি উপত্যকায় যে খাম্বা জনজাতির বসবাস ছিল। এ নিয়ে কোন দ্বিমত নেই। তাছাড়া খাম্বাজং থেকে অরুনাচল প্রদেশের তাওয়াং গুম্ফার দূরত্ব মেরে কেটে ২০০-২৫০ কিমি। দক্ষিন-পূর্ব তিব্বতের এই অঞ্চল জুড়ে একই জাতির লোকেরা অতীতে বসবাস করত।

রেফারেন্স
China trekking
Asia wheeling, Blog archive
Bakhtyar Khilji’s Tibet campaign: Wikipedia
Bakhtyar’s role in the Bengal history by K Rajan
চৌথুপীর চর্যাপদ

চৌথুপী- ৫ (Geo- Location)

In One place Minhaj says that Ali Mech conducted the invading army to Bardhankot in front of which flowed a river three times as big as the Ganges. But in other place, he says that Bakhtyar arrived at the bank of this river where Ali Mech joined him. On this point Bhattasali writes “Muhammad certainly did not require a guide in the territory under his immediate occupation. And the region of Bardhankuthi, if not within the territory of Muhammad, cannot have been far beyond it. Thus the probability In favour of Ali joining Muhammad on the bank of the great river” The large river in front of Bur-dhankot which Minhaj calls Bagmati presents some difficulty. It was thrice as broad as the Ganges. Ravertly in translation of the Tabaqat recognizes that his description suit only the great Brahmaputra river. Blochumanu is of different opinion. He says “according to Minhaj a Urge river flows in front of the town. This can only refer to Karatoya which formed so long the boundary of ancient an Muhommadan Bengal and later, of the Koch and the Koch hajo dominions .”
— লেখক K Rajan

এক জায়গায় মিনহাজ বলছেন যে আলি মেচ হানাদার বাহিনীকে বর্ধণকোটে নিয়ে গিয়েছিলেন, যার সামনে গঙ্গার চেয়ে তিনগুন বড় একটি নদী প্রবাহিত ছিল। আবার অন্য জায়গায় তিনি বলছেন যে বখতিয়ার এই নদীর তীরে এসেছিলেন যেখানে আলি মেচের সাথে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎ হয়। এই বিষয়ের উপর আলোকপাত করে ভট্টশালী লিখেছেন “মুহম্মদের অবশ্যই এই অঞ্চলের তাৎক্ষণিক দখলে কোন গাইডের দরকার ছিল না। আর যদি বর্ধণকুঠি অঞ্চলটি মুহাম্মদের ভূখণ্ডের মধ্যে নাও হয়, তবে এটি তাঁর রাজত্ব থেকে অনেক দূরেও অবস্থিত ছিল না। একই ভাবে বুর-ধণকোটের সামনে বিশাল নদী, যাকে মিনহাজ বাগমতি বলে কিছুটা অসুবিধার সৃষ্টি করেছেন। মিনহাজের মতে এই বাগমতি গঙ্গার চেয়ে তিনগুন প্রশস্ত ছিল। তবাকত-ই-নাসিরির অনুবাদে যদিও বর্তমান ব্রহ্মপুত্রকেই বাগমতি বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। তবে এক্ষেত্রে Blochumanu-এর মত ভিন্ন। তাঁর মতে, মিনহাজের মতে শহরের সামনে একটি উগ্র নদী প্রবাহিত ছিল। নিঃসন্দেহে এটি করতোয়ার নদী। যা পরবর্তীকালে মুহাম্মদ শাসিত বাংলা ও কোচ অধিপত্যের সীমানা তৈরি করেছিল। কোচ হাজো কিংডম না হয়ে এটি সম্ভবত হবে কামতা রাজত্ব। অসমের পশ্চিম দিকে এই রাজবংশের উদ্ভব ঘটে ১২৫৭সালে। তাৎপর্যভাবে ১২০৬সালে খিলজির এই আক্রমণের সাথে আলি মেচের যোগাযোগ নিঃসন্দেহে কোচ রাজবংশের উত্থানেরই ইঙ্গিত বহন করে বলে অনুমান। কামতা রাজবংশের উত্থানের আগে এই করতোয়া নদীই বাংলার সাথে কামরূপের প্রাকৃতিক সীমারেখা ছিল।

১৭৬২সালে বঙ্গোপ সাগরের উত্তর পূর্বে বাংলাদেশের চট্টোগ্রাম সহ মায়ানমারের আরাকান অঞ্চল, এবং ১৮৯৭ সালের ১২ই জুন আসামের ভূমিকম্পে উত্তরবঙ্গের কমবেশি অনেক নদীর গতিপথ যে পরিবর্তন হয়েছে সেটা বলা বাহুল্য। হিমালয় থেকে আগত প্রধান নদীগুলো ঢাল অনুসারে অনুগামী হলেও, বেশ কিছু নদী জলপ্রবাহের তারতম্য ভূপ্রকৃতির ঢা্ল ও শিলাস্তরের গঠনে সামঞ্জস্য রেখে কালের প্রবাহে পাল্টেছে গতিপথ। নদীর বোঝা হ্রাস এবং উচ্চপ্রবাহে নদিগ্রাস ঠিক কোথায়, কখন, কিভাবে হয়েছে সেটাও ঐতিহাসিক ভাবে অনুসন্ধান করা খুবই মুশকিল। তাই ১৭৭৬ সালে জেমস রেনিলের বাংলার মানচিত্র ছাড়া অতীতের নদী অববাহিকার অনুসন্ধানের বিকল্প কোন পথ নেই। তিস্তা কথাটির উৎপত্তি ত্রি-স্রোতা থেকে। করতোয়া আত্রেয়ী আর পূনর্ভবা এই তিনটি নদীর প্রবাহ’ই ছিল অতীতের তিস্তা। তিস্তার মুল নদীখাত যে অনেকবার পাল্টেছে তা আমাদের জানা। বস্তুতপক্ষে দেবীকোটের একদিকে পূনর্ভবা অন্যদিকে আত্রেয়ী নদী বয়ে যেত প্রাচীন বাংলায়। চৌথুপীতে বর্নিত যে নদীতে খু-স্তোন তিব্বতের পথে রওনা দিয়েছেন এই নদী তিস্তা ভিন্ন অন্য কোন নদী নয়। বর্ধণকোট, চৌথুপী, পঞ্চগড়, গরালবাড়ি কিম্বা ভিতরগড় সম্ভবত একই জায়গা অথবা খুব কাছাকাছি জায়গা সমুহ। বিভিন্ন রাজত্বে যে অবস্থান অল্পঅল্প করে সরে সরে গেছে।

রেনিলের মানচিত্র সংক্রান্ত কিছু বিষয়

১)তিস্তা নদীকে Teestah R এই নামে লেখা।

২)দিনাজপুরের কাছে এই তিস্তা নদী এসে প্রথমে অনেকগুলো ধারায় বিভক্ত হয়। পরে আবার ধারাগুলো পরস্পর যুক্ত হয়ে দুটি মূল ধারায় সৃষ্টি করে। একটি আত্রেয়ী অন্যটি পুনর্ভবা।
৩) বালুরঘাটের নাম ছিল Balloogaut

৪) জলপাইগুড়ির নাম ছিল Jelpigory । শিলিগুড়ি শহরের প্রশ্নই ওঠে না এই মানচিত্রে। তবে জলপাইগুড়ি জেলার ক্রান্তি (Kyranty)শহর কে দেখানো ছিল।

৫) চৌথুপীর অবস্থান যদি আজকের গরালবাড়ি হয়ে থাকে। তাহলে একই জায়গায় রেনিলের মানচিত্রে দূর্গের মার্কিং করা আছে। যা স্পষ্টতই ক্ষয়প্রাপ্ত ধ্বংসাবশেষ সুনিশ্চিত করে।
৬) এই মানচিত্রে দেবীকোট বা গংগারামপুরের অবস্থান না থাকলেও ডুমডুমার অবস্থান আছে
৭) এছাড়া করদহ, পতিরাম, বোল্লা, নয়া বাজার, ফুলবাড়ি এরকম কিছু জায়গা খুঁজে পাওয়া যায় মানচিত্রে। আবার কিছু নদী ও শহরের নাম পাল্টে গেছে কালের স্রোতে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে তিব্বত অভিযানে খিলজি ডংকিয়া-লা গিরিপথ অতিক্রম করেই তিব্বতে ঢুকেছিলেন। জেলেপ- লা গিরিপথ হয়ে নয়।


ফেসবুক অ্যাকাউন্ট দিয়ে মন্তব্য করুন


তুষার কান্তি দত্ত

জন্ম - ১৯৭৩। শিক্ষাগত যোগ্যতা - এম এ, বি এড। পেশা - শিক্ষকতা । বাড়ি - বালুরঘাট, দক্ষিণ দিনাজপুর। ভালো লাগে পাহাড় জঙ্গলে নিজের মত ঘুরে বেড়াতে কখন বন্ধুদের সাথে, কখনো বা একদম একা একা। ট্রেকিং ও অফবিট ট্রাভেলিং-এ সাচ্ছন্দ বধ করেন। সকাল সন্ধ্যে ছাদের বাগানেই কাটে সবুজের সান্নিধ্যে। মন হলেই রঙ তুলি হাতে নিয়ে বিমূর্ত ভাঙ্গা গড়ায় নিবিষ্ট অন্তর্মুখী....

0 Comments

মন্তব্য করুন

Avatar placeholder

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।