নিঃশব্দ : কণ্ঠ ও কণ্ঠহীন সময়

সুভান দাস on

nihshobdo

কিছু কিছু সময়ে একটা উৎসবের ভেতর থেকে জনপদ খসে পড়ে আচমকাই। ভিড় ফুরিয়ে যায়। মেলা ভেঙে আসে। একা একাই খালি হাতে বাড়ি ফিরে আসে রঙিন বেলুন বিক্রেতা। অসুখের আবহাওয়ায় মানুষ সন্দেহপ্রবণ হয়ে যায়। একটা জনপদ থেকে উৎসব ক্রমশ দূর ও বিন্দু সমান হয়ে যাচ্ছে দেখেও মানুষ ঘরে ফিরে আসে। ফিরে আসতে পারাই জীবন এখন। অসুখের দেশে সুস্থ থাকাই ভালো থাকা। আর কোনও চাহিদা নেই। আর কোনও অভাবের কথা লিখব না আমরা। অভাব বিক্রি হয়ে গেছে বেসরকারী হাতে। কৃষকের লাঙলে এবার কোম্পানীর লোগো বসবে। ট্রেনের নাম হবে হয়তো কোনো বিখ্যাত মোবাইল কোম্পানির নামে। লাখে লাখে পরিযায়ী শ্রমিক হোক কিংবা সাইবেরিয়া থেকে উড়ে আসা পাখি, যারা ফিরে আসতে পারে তারা প্রাণে বাঁচে। বাকিরা পথেই মারা যায়। পথের ধারেই শিয়াল কুকুর কাক সেই দেহ ও চিন্তা ঠুকরে খেয়ে যায়। মাংস ছেঁড়ার কোনও শব্দ হয় না। মৃত্যুর আগে আমাদেরও শব্দ করতে নেই। হাসপাতাল এলাকায় লেখা থাকে সাইলেন্ট জোন। মৃত্যু ঠান্ডা ঘরে ঘুমায় বলে? দেশের ভেতরে যখন একটা আস্ত ঠান্ডাঘর জেগে বসে থাকে তখন আইনের চোখ ঢুলে পড়ে ঘুমে। মুখচোরা এই মুহূর্তগুলোয় মুখ বন্ধ করে হেঁটে চলো শুধু। শব্দের ভেতরে বিপণ্ণ এই বেঁচে থাকারাও এখন অভ্যস্ত এইভাবে বেঁচে থাকায়। এমনকি কথারা বোবায় পেলেও বেঁচে যায় এখন। মানুষ এতটাও ঘরপিয়াসী ছিল না। এখন ঘরে ফিরতে পারলেই খিদে ভুলে যায় মানুষ। ভক্তির কাছে অর্থ জমা রাখে। শিক্ষা তবু খিদের জন্য দুহাত ভরে ধান এনে দিতে পারে না। শিল্প এনে দিতে পারে না নেতা বা নেত্রীসমাজ। ব্যর্থ নেতার অনর্গল কথার নীচে আমাদের শব্দ চাপা পড়ে যাচ্ছে কিন্তু মুখ খুললেই বিপদ। ধর্ম নিয়ে কথা বলতে নেই ভক্তের দেশে। খিদে নিয়ে কথা বলতে নেই ভুখারির দেশে। কর্ম নিয়ে আওয়াজ তুলতে নেই বেকারের। খুব কাছে যাওয়া যে নিষেধ এখন। সংক্রমণ এক ব্যাধি। তাই দলিত থেকে শুরু করে যে কোনও অচ্ছুৎ ভারতবাসী ছোঁয়াচে রোগাক্রান্ত হয়ে মরার আগে দশবার মরে দারিদ্রতার লাথি খেয়ে, অস্পৃশ্যের ঘৃণায়। জলচুরির অপরাধে যখন প্রকাশ্য দিবালোকে নিচুজাতের মেয়েটিকে ল্যাংটো করে প্রহার করা হয়, উপস্থিত মানুষ চুপ থাকে। শব্দ হয় নিঃশব্দের। ইস-ইস… করতে করতে ইশারায় কাঁদে কেউ কেউ। কিন্তু ইশারায় মন পড়া যায়? মনের ব্যথা? মনের নিকটে আসার ক্ষমতা তো মানুষ বহুদিন হল ক্রমশ হারাতে বসেছে, এখন মানুষ, মানুষের নিকটেও আসতে পারে না আর। তবুও প্রকৃত সারস ঠিক মাথার ওপরে এক ফালি আকাশ মুখে করে উড়ে যায় দুইবেলা। এর মাঝখানে বেশ কিছু খিদে সারি সারি শুয়ে থাকে ধর্মতলায়, মন্দির ও মসজিদ প্রাঙ্গণে। মধ্যরাতের ফুটপাতে শুয়ে থাকে পোয়াতি পাগলী। নির্জন রেলস্টেশনে শুয়ে থাকে সারারাত। নির্ঘুম রাত ঝুঁকে থাকে পথকিশোরীর আধখোলা বুকে। যেন জ্যোৎস্নার হামাম থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে রাস্তায়। জলই একমাত্র খিদে ভুলিয়ে রাখতে পারে মানুষের। অসুখের দিন পেরিয়ে লিঙ্গের দুধস্নান থেকে কালো ঠাকুরের তেলস্নান, অন্ধের জরাগান থেকে রাস্তাবন্ধের দিনগুলি সেজে ওঠে নতুন পোশাকে, প্রদীপের শিখায়। জাতীয় মন্দিরে, জাতীয় ধর্মে, বিজাতীয় ধর্মের ভেতরে যদিও গোঙায় তবু মিডিয়া চুপ। স্বদেশ জানতে চায় স্লোগানে রাত্রিকালীন আহার ঠান্ডা হয় পাতে। তবু রাতের গল্পে ঢুকে পড়ে কিছু মহাসড়ক কিন্তু একটিও পথিক নেই সেখানে। কিছু অন্ধ অভিনেতা (রাষ্ট্র নেতাও) আছে যাদের শুধু মঞ্চ আছে মন নেই। একজন বোবা রাজা ও তার পুরোহিতদের মন্ত্র আছে কিন্তু মন নেই। বধিরপ্রজা থেকে বামুন চাঁদ সকলেরই মুখের সেলাই খুব কাঁচা। ধনতন্ত্র, দলতন্ত্র এবং গনতন্ত্র এই ত্রিবেণী সঙ্গমে ডুব দিচ্ছি রোজ। এদিকে পকেট ফাঁকা হতে হতে আবার পুরনো কথার প্রসঙ্গ ওঠে সন্ধে গড়ালেই। অনেক কিছু বলার বাকি থাকে যখন, কিছুই আর বলা হয়ে ওঠে না। শ্বাস ফুলে ওঠে ঘন-ঘন। অনেক কিছুই বলে ফেলা উচিৎ মনে হয় যখন তখনও শ্বাসনালীর ভেতরে গুমোটের (পিস্তলেরও) দানার মতো কিছু ঘুরপাক খায়ে সারাগায়ে, ধুলোর সমীকরণ আঁকে বা আটকে থাকে। আয়ু বায়ুর কাছে এসে ফিকে হয়। হতাশও হয়। বাতাসে মিশে থাকা জটিল এক দ্বিধা আমাদের মনে করিয়ে দেয় এ শরীর নশ্বর, ভঙ্গুর, জরাগ্রস্ত, ভয় ও জলের মতো পাতলা, ধুলোমাখা নোংরা চুলের উন্মাদ-পাগলা। তাকে গ্রহণ করিব না বর্জন করিতে চেয়েও বর্জন করিতে পারিব না এসব ভাবতে ভাবতে এমন অবস্থায় হাতের রেখা ধুতে ধুতে ভাগ্য থেকেই মুছে যাচ্ছে ক্রমশ নিজস্ব হকের কথা। আর যখন একটাই কথা গলার কাছে এসে দীর্ঘদিন আটকে থাকে, কিছুতেই শ্বাস নিতে পারে না, কিছুতেই বলতে পারে না জল দাও, কিছুতেই-কিছুতেই…। তখন মৃতের আর কোনো স্বদেশ থাকে না। কাঁটাতারও থাকেনা। সমস্ত কাগজ খায়ে চতুষ্পদ। মানুষ খায় বিষ। বিষ যেহেতু রুটির টুকরোর চেয়ে সস্তা। গলা বদ্ধ হয়ে যাওয়া প্রতীকগুলো কিছুতেই আর বলতে পারে না কেন আলো আর বিষ এক; কেন বিষ আর ঘুমের কোনো তফাৎ নেই; কেন বমিকে ঘেন্না করে সবাই, কেন ঘেন্না হলে থুতু ছুঁড়ে দিই আমরা? কেন ডোমে বা মেথরে ছুঁয়ে দিলে স্নানই একমাত্র শুদ্ধাচার। কত কি বলার থাকে কিন্তু বলা হয় কই। নিজেকে বিধাতার মতো সাদায় মুড়ে ফেলে চুপ করে যাই। খুব চুপ করে যাওয়াটাই আমাদের নির্বাণ এখন। বুদ্ধের মতো নিঃশব্দে হেসে ফেলা, হাসি মুখে জুতো মাথায় করে নগর পরিক্রমা করতে করতে লজ্জায় মুখ ঢেকে ফেলা, এসব তুচ্ছ বিজ্ঞাপনী প্রহসন থেকে অচ্ছুৎ কিশোরীর যোনি অবধি ছুঁয়ে যাওয়া মোড়লদের ব্যপারে কেমন দল বল ছল বুঝে বা না বুঝেই তার বোঝা নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি চুপ করে। যুদ্ধের ভেতর যেমন শিশুর মাথা কেটে ফেলে দেওয়ার গল্প লেগে থাকে, কিছু গল্পের ভেতর প্রিয় খেলনা হাতে শিশুদের যুদ্ধে ঢুকে পড়ার দৃশ্য আমাকে নির্বাক করে দেয়। নির্জন রাস্তায় সে মেয়েটি হাঁটতে হাঁটতে এসে দাঁড়ায় লালা ও অন্ধকারের মুখে। অন্ধকার মেয়েটির কামিজ টেনে ছিঁড়ে ফেলার হাত হয়ে সারাগায়ে দুর্গন্ধের আতর ছিটিয়ে দেয়। এত নিঃশব্দ চতুর্দিকে, এত ধ্বনি ও কান্নার মজলিস। কেউ এসে আর জীবন বলে চিৎকার করে ওঠে না। গান থেকে বোবা ও আবেগ ঝরে পড়ে না, ফুলের বাগান ও ভ্রমরের ছিঁড়ে যাওয়া ডানা থেকে পলাতক শব্দ ভেসে আসে। এরপরেও শব্দ গলার কাছে নিঃশব্দের সিম্পফনি গাইতে পারে?  কথা না বললে আয়ু ক্ষয় হয়। ক্ষমতার হাতের ভেতর সেই পথভোলা মেয়েটির কামিজের টুকরো ঝুলে থাকে, কিংবা পুরুষের হাতের ভেতর ক্ষমতার নগ্ন নাচ, ভাঙা বোতলের কাচের ওপর এসে দাঁড়ায়। সব এক? এসবের মাঝেই আমরা ভুলে যেতে পারি কোন আলপথ ধরে দেশ ভাগের স্মৃতি হেঁটে যায়। কোন কুয়োর জলে মা ও সন্তান এক সাথে ঘুমায়, কোন দেওয়ালের গায়ে নকশাল কবির বুলেট বিঁধা বুকের মাংস লেগে থাকে, কোন প্রতিশ্রুতির নামে কোন সহবাসের ফাঁদে জড়িয়ে ফেলে কোন ঠগ, মাথার ভেতরে চড়কির মতো ঘুরতে থাকে এসব জটিল বায়ু। নিঃশব্দ করে আমাদের। বায়ুদোষ কেটে গেলে গলায় তুলসির মালা, বুকের চন্দনের প্রলেপ। আগুনের কাছে এসব নৈশব্দের আহূতি বুকের ভেতর নিরন্তর দহন জারি রাখে। আমরা শব্দ হারাতে হারাতে, আমরা নিজের কাছে একলা দাঁড়াতে দাঁড়াতে কণ্ঠের জোর হারিয়ে ফেলেছি। কথার পরে কথারা এসে বলে না কেমন আছো? ব্যথার ভেতর ব্যথার আঙুল চেপে ধরে না কেউ। বলে না কাঁদো, চিৎকার করে কাঁদো। নিঃশব্দ একটি স্পেস। যা প্রকৃতিতে মানায়, কন্ঠে নয়। আমরা সেটুকুই জড়িয়ে বেঁচে আছি এই নিঃসঙ্গ জীবনে। হে মহামান্য, সময় পেরিয়ে যাওয়ার আগে যেন একবার আমরা চিৎকার করে উঠতে পারি।


ফেসবুক অ্যাকাউন্ট দিয়ে মন্তব্য করুন


0 Comments

মন্তব্য করুন

Avatar placeholder

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।