লকডাউন এবং

মানস চক্রবর্ত্তী on

lockdown_ebong_kobita

কী মজা কাল থেকে লক ডাউন ।

এটাই ছিল তাদের সমস্বরের কলকলানী । ওদের ঘরের দখিন দিকের দেয়াল জুড়ে সমুদ্র । সমুদ্র থাকলে যা হয় সব সময় ঢেউ , গর্জন , আর উথলনো হাওয়া । চুল উড়োয় , বসন উড়োয় , ঘরটা সন্ধে থেকে আর ঘর থাকে না ।

লক ডাউন এর প্রথম দিন তারা আঁকতে বসলো । প্রথমে হি । সে সী’র মাথার চুল আঁকতেই সারা বেলা কাটিয়ে দিলো । সমুদ্রের জল তখন গরম । মার্চের রোদ । উত্তরের পাহাড় থেকে থেকে থেকে প্রাক্তন হীমেলী আসছে । অবগাহনের পর কেমন যেন গায়ে কাঁটা দেয় । ওদের উত্তরের দেয়ালটা এবড়ো থেবড়ো , পাহাড় , ঝর্ণা , আর ফার্ণ আঁকা ।

সী বোল্লো দেখি চুলটা কেমন আঁকলে , বলে ঝুঁকে পড়লো পায়ের দিকে সেখানে অবিকল জয়ন্তী বইছে , ওটুকুই তাদের আর্শি , তাদে ঘরে তা ভিন্ন আর কোনো আয়না ছিল না কোনদিন ।

অ্যাই খোলা চুল থাকবে ? সী’র চোখে অনন্ত জিজ্ঞাসা ।

চলো এবার খাই । আজ তো সবে লকডাউন ওয়ান , দ্য ফার্স্ট ডে । ওরা খাবে এখন । এই ফাঁকে চলো একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসি । বাইরে গো , বাহির হতে আরো বাহির , মেঘ আঁকা ছাদে চলো আমরা দাঁড়াই । ওই দ্যাখো গলির মুখে কারা কোথাও যেতে চাইছে আর কারা যেন যেতে দিচ্ছে না । এরা বলছে ,ওপারে আয় উপার্জন , আমরা ওপারে যাবো নাহলে বালবাচ্ছা খাবে কি ; ওরা বলছে না খেলে মরে না , ভাইরাসে মরে । এরা বলছে , ভাইরাস বড়লোকদের মারে , ভাইরাস এরোপ্লেনে চড়ে এসেছে , আমাদের কুঁজি ঘরে সে ঢুকতে লাইড়বে না ।ওরা বলছে , এখন প্লেন থেকে নেবে ভাইরাস প্লেন ল্যান্ডে ঘুরছে ,কাউকে ছাড়বে না । এরা নাছোড় ওরা নাছোড় । ব্যারিকেট । গোপন যুদ্ধের গেরিলা আয়োজন ।

হি এখন কপাল এঁকে একটা কুমকুমের টিপ দিলো সী’কে । দুটো চুল উড়ে উড়ে এসে পড়ছে কপালে তার । উথাল বাতাস কীকরে সামলাবে সে । তার আঙুলইতো তুলি । সী বোল্লো , উঁহু , সাজ হচ্ছে না , আঙুলে কি আটা আছে যে চুল আটকে থাকবে ! হি তখন জিভ দিয়ে আঁকলো তার কপাল । গর্জন তেল মাখানো মনে হচ্ছে এখন । চকচকে । তারপর ভুরু । উঃ উঃ । কী নিখুঁত সে শৈলী । সী আঁকড়ে ধরে আছে হি’র গলা । ছড়িয়ে আছে সী’র তনুখানি জয়ন্তীর জলে । সী মৃদু কোঁকাচ্ছে । হি তার অপরূপ ভাস্কর্য রচনা করে চলেছে । ভুরু কিছুটা আঁকে আর কপালের চুল নড়ে যায় । তা ঠিক করতে না করতে আবার ভুরু সরু মোটা মনে হয় ।

সী গোঁঙায় । শুনেছো তো । জলে তার পা ছপছপ করছে । নুড়িগুলো সরে যাচ্ছে । সী’র গলা জড়িয়ে আসে । সে অস্ফূটে বলে , আমার শীত করছে । ভিজে গেছি যে ।

আমরা ফেরত এসেছি নক্ষত্র পুঞ্জিত চালা ঘরে । এখানে ভাত আঁকছে একটা খোকা । তার মাকে সে বলছে ভাত মানে কী গো ? তার মা জানলা খুলে পাশের বাড়ির দিদিমনিকে ডেকে বলছে দিদিমনি খোকা জানতে চাইছে ভাত মানে কি ? সরু গলায় দিদিমনি বোল্লো , ভাত মানে কার্বোহাইড্রেট ।

ও, তা দিদিমনি ভাত কি ভালো ?

না না একদম ভালো নয় । ভাত রোজ খেলে দেশসুদ্ধু লোকের সুগার হবে ।

খোকা বোল্লো দিমনি ছুগার কি ?

চিনি রে চিনি । চিঁচিঁ করছে দিদিমনির গলা । খোকা ততক্ষণে মাছ এঁকেছে । জানলা দিয়ে দিদিমনিকে দেখালো । জ্যান্ত মাছ । লেজ নড়ছে । দিদিমনি আঁতকে উঠে বোল্লো খাস নি খাস নি । ওরা প্রোটিন । গরীব লোক ওসব খেলে তেজ হবে । জ্বলে যাবে । আর খক খক করে কাশতে লাগলো । কিছু পরে ওমা , খোকা আর খোকার মা জানলায় দ্যাখে অ্যাম্বুলেন্স । দিদিমনির বর বেড়াতে গেল । রাত কেটে যাচ্ছে । পুব দিক ফর্সা হচ্ছে । কিন্তু ভোর বেলা যাদের রান্নাঘরে টুংটাং শব্দ হতো , চারটের সবজীর ট্রেনে যার ঘরের লোক টিপিন কোটো হাতে কলকেতা যেতো , আজ কোন সাড়া নেই । আজ লকডাউন ডে টু ।

চা খাচ্ছে হি আর সী সমুদ্রের পাড়ে বসে । ওদিকে পাহাড়ে কমলালেবু আর একটাও নেই । হি চায়ের কাপ রেখে সী কে আঁকতে বোসলো । খুব সুন্দর করে চোখ আঁকছে । নিজের চোখ বন্ধ । সী ‘র চোখের পাতায় জিভ দিয়ে ব্রাশিং করতে অপূর্ব পদ্ম কুঁড়ির মতো ফুটে উঠলো । নাক আঁকলো । টিকালো ঠিক নয় , একটু চাপা । সী বোল্লো ক্যানো গো আমার নাকটা টিয়ার ঠোঁটের মতো করলে না । হী হেসে , একটা চকাস করে চুমু দিলো নাকের ডগায় , বোল্লো দ্রাবিড় রমনী তুমি , শ্রেষ্ঠ কামাচারীনী । নাক আর ঠোঁটের মধ্যে একমাই পথ আঁকলো । কী যত্ন , কী নিখুঁত । নিজে এঁকে নিজেই কামকাতর হয়ে উঠলো ।

বেলা গড়িয়েছে । তাদের ঘরের বাইরে দিয়ে এ সে ও এবং তিনি তাহারা ব্যাগ ব্যাগ মালপত্তর নিয়ে ধপধপ করে ছুটছে । কোথায় ভাই ? এতো প্যাকেট প্যাকেট ভোত্তি কী আচে ? যাচ্চো কোতায় ?

তারা বোল্লো ভিক্ষে করে চাল ডাল আলু তেল ডিম পেঁয়াজ নিয়ে যাচ্চি । খোকা খুকিদের বাড়ি । একেনে কেউ আচে তেমন । ঐ তো দেখিয়ে দিলুম । কিন্তু ও সব তো কার্বোহাইড্রেট , প্রোটিন , ফ্যাট । ওসব কি গরীবদের দেয়া ঠিক ! তারা বিচ্ছিরি করে তাকালো । বোল্লো বাঞ্চোৎ গরীবরা মানুষ লয় ।

হি এখন ঠোঁট আঁকছে । সত্যিই বসন্ত মাস । লকডাউন ঠেলে ঢুকে পোড়লো । পাহাড়ের গায়ে ব্রহ্মকমল । তার পাপড়ির মতো সী’র ঠোঁট । ওপরের ঠোঁটটি ফিনফিনে আর নিচের ঠোঁট যেন টুসটুসে কোয়া । হি আঁকছে আর চুষছে , চুষছে আর আঁকছে । অবশ হয়ে আছে সী । শিথিল তার হাত পা । সে ভাবছে এ ভাবে তার পায়ের কনিষ্ঠা আঙুলটি অব্দি ভাস্কর্য নির্মাণ শেষ হলে সে কি আর বাঁচবে । প্রকৃতপক্ষে তার চতুর্থবার ইজাকুলেশন সম্পন্ন । প্রায় ঘুমন্ত সী বোল্লো আমাকে নাও ।

আজ মাইকে হাঁকছে দরকারের পোমাণ ছাড়া বার হলেই হাজত । তার আগে দুমাদ্দুম পাছা লাল করে দেয়া রুলের মার । শালা বলে কি? দরকার ! খোকা না খেতে পেলে পেট মানবে ক্যানো । খোকা খুকির মা – বাবা ঘরে বোসে থাকবে ! ওরে ও গু খেকোর ব্যাটারা ঝারা চাল ডাল দে গ্যালো তারা তো তোদের মতো মানষের কাবলা কাটে নে , উঁ বাল ছেঁড়ার খ্যামতা নি খই খাবার জোমড়া । মর তোরা । আমাদের পথে যেতি হবে গতর খাটিয়ে ছাবালপোনদের গেলোনের জোগাড় করতি। কত মারবি মার ।

লকডাউন চলছে । এখন সী আঁকছে । হি’র ডান পা , বাঁ পা । তার পায়ের নখগুলো ভাঙাচোরা । হি বোল্লো এরপর মোজা পড়বো কীকরে । নখ লেগে যে ছিঁড়ে যাবে । ফাইলাল হোক , তখন নখ বড় হয়ে যাবে । সী’র উত্তর । উরু আঁকতে আঁকতে সী বোল্লো কী নাইস এঁকেছি দ্যাখো । এবং হি’র হিত্ব হিতাহিত হয়ে উঠলো যখন সী জীভ দিয়ে নিরীহ মাংসপিন্ডটি আঁকা শুরু কোরলো । অপূর্ব কৌশলে সী হি কে বেড়াতে নিয়ে গেলো মধুভান্ড পদ্মবনে । হি বাধ্য পোষ্যের মতো লক ডাউন করে সেই মোহময় উদ্যানে লকডাউন যাপন করতে মনস্থ করলো ।

কিন্তু চারিদিকের কান্নার রোল তাদের ভাস্কর্য নির্মাণকে স্থগিদ করলো । তারা তারাময় আকাশের নিচে দেখলো অগনন মানুষ ছিন্নজীর্ণ বসন , কঙ্কালসার দেহ , খেতে দাও খেতে দাও তাদের আকাশ বাতাস বিদীর্ণ চিৎকার —


ফেসবুক অ্যাকাউন্ট দিয়ে মন্তব্য করুন


মানস চক্রবর্ত্তী

জন্ম: জয়নগর মজিলপুর । ১ নভেম্বর ,১৯৬১ । বাসস্থানঃ রবীন্দ্র নগর / বারুইপুর পেশা- অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার , সিইএসসি । বই - সাম্প্রতিক দুজন , বিবিধ পংক্তি , ( কবিতা ) ; ছিপ নৌকোয় গলুই থাকে না ( গল্প) । পুরস্কার - যুব উৎসবে । লোকসখা সোসাইটি থেকে জেলার সেরা গল্পকার । পত্রিকা - ভোর ( অণুগল্পের কাগজ ) সম্পাদনা । নানান কাগজে লিখেছেন । কবিতা বেশী । গল্পও ।মুক্ত গদ্য , রম্য রচনা । কিন্তু অর্ডারি লেখা অপছন্দ । লেখালেখির বাইরে সমাজ কর্মী ।

0 Comments

মন্তব্য করুন

Avatar placeholder

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।