একজন গলি সংগ্রাহকের আত্মকথা

সমস্ত জীবন ধরে আমি আদতে কিছু গলি সংগ্রহ করেছি। মাঝ দুপুরে রেলগাড়ি থেকে নেমে অথবা রাতের বেলা কোনও অচেনা অজানা জায়গায় এক একটা গলি আমাকে টেনে নিয়ে গেছে। কিছু গলি শুরু হয়ে অপর গলি বা রাজপথে মেশে। কিছু গলির একটা না মেশা আছে। অন্ধের মতো সে দাঁড়িয়ে থাকে নিজেরই শেষ প্রান্তে।
গলি সংগ্রহ করতে করতে একদিন বুকের ভেতর এই ফাঁকা জায়গাটা ভর্তি হয়ে যায়। মিলেমিশে একাকার হয়ে গেলে মাঝেসাঝেই খুব বিপদ হয়। মনে থাকে না কোন গলির শেষে শুধুই অন্ধকার আবার কোন গলির শেষে নতুন কোনও আলো।
গলি সংগ্রহ করার কোনও বিশেষ পুরস্কার নেই।সমস্তটাই তিরস্কার। আরও বেশি একা হয়ে যাওয়া। যে বোঝার সে বোঝে একজন গলি সংগ্রাহক জীবনে কতখানি নিঃসঙ্গতা নিয়ে বাঁচে।
জীবনে আমার মতো এমন গলি সংগ্রাহক আর কিছু কিছু মানুষকে পেয়েছি।
তাদের দিয়ে কিছুই তেমন করে হয়নি। তাদের অফিসে ছুটি কাটা যায়, কোনও জায়গায় সময়ে পৌঁছতে পারে না, এমনকী প্রেমিক প্রেমিকার বাহুলগ্ন হয়েও তাদের ভেতর গলিগুলো কিলবিল করে ওঠে।
সে যে কি ভীষণ কিলবিল, যার হয় সে জানে।ধীরে ধীরে কাজ চলে যায়,দূরে সরে থাকে সম্পর্কগুলো আর সকলেই একসুরে বলে
— ওর দ্বারা কিছুই হবে না।
কিছু না হওয়ার একটা বিপদ তো আছে। তাই অবশেষে স্থির করেছি এতদিনের সংগ্রহ করা গলিগুলো আমি বিক্রি করব। এতে করে বুকটি হাল্কা হবে। তীব্র নেশার কবল থেকে বের হয়ে এসে আমি আবার সুস্থ সামাজিক একটি জীবনযাপন করতে পারব।
গলিগুলো ফেলে দেওয়াও যেত। কিন্তু ফেলার উপযুক্ত জায়গার বড় অভাব। আমাদের শহরে এত মানুষ, বসতি, আলো সেখানে এই গলিগুলো আঁটিয়ে দেওয়া খুব কঠিন। নর্দমাগুলো ভরে গেলে জল নিকাশের অসুবিধে হবে। কলকাতায় পর্যাপ্ত পরিমাণে জঞ্জাল ফেলার জায়গাও নেই।ফলে, এই গলিগুলো নিয়ে কী করব এমন ভাবনায় অস্থির হয়ে হয়ে এই গোটা কলকাতা শহরে আমি ঘুরে গেছি।
যত ঘুরেছি তত বুকের ভেতর জমা হয়েছে আরও আরও গলি। ফেলে দিতে চাই বলে তো আর পুরনো নেশা কেটে যায় না। বারবার নিজেকে আটকিয়েও চলে গেছি নেশার কাছে।
বুকে ফেটে যায়, তবু এ নেশা চলে যায় না।জমতে থাকে, জমে জমে আরও কমে আসে কথা। নির্জন হয়ে যায় সামান্য আত্মাটি আমার।
এমন এক রাত ঠিক করেছি নিজের ভেতর এই জঞ্জাল সাফ করব। ফেলে আসব যে কোনও এক জায়গায়। তারপর আমার আর দায়িত্ব কী? মনের ভার কমবে, শরীর আরও ফুরফুরে হবে। সেই ফুরফুরে শরীর নিয়ে আমি এঁটে যাব এই মহানগরে। রাজপথ থেকে রাজপথ, আমার হাতের ঘড়িটা ঠিক সময় জানিয়ে বলবে – সাবাশ।
এমনই এক রাতে, পূর্ব নির্দিষ্ট গলিতে বুক উপুর করে সমস্ত গলি ফেলে দিচ্ছি। অন্ধকার, মানুষজনের তেমন যাতায়াত নেই। শুধু কয়েকটা পথকুকুর অনেকক্ষণ ধরে মাপছে আমাকে। আমি যথাসম্ভব কম শব্দ করে নিজের বুক খালি করে নিতে চাইছি। একে একে রেখে যাচ্ছি এত বয়স অবধি জমানো গলিগুলো। এখন অনেকটা হাল্কা লাগছে আমার। মনে হচ্ছে, এবার সভ্যতায় আমি ফিরে যেতে পারবো।
সমস্ত খালি করে আমি চলে এলাম রাজপথে।নিজেকে আশ্চর্য লাগছে আমার, মনে হচ্ছে এই প্রথম সভ্যতার কাছে পৌঁছতে পারলাম। ভীড় ভাল লাগছে, ভাল লাগছে অর্থহীন চিৎকার। শরীর এত হাল্কা হয়ে গেছে যে মাঝে মাঝেই পা দুটো শূন্যে উঠে যাচ্ছে। এই বিরাট কলকাতার মহাশূন্যের মধ্যে আমি হারিয়ে গেলাম।
ধর্মতলার রেস্তোরাঁয় চিকেন কাটলেট খেতে খেতে মেয়েটির চোখে চোখ গেল। কিছুক্ষণ ভাসাভাসির পর এগিয়ে গেলাম তার দিকে।
নাম জানাজানির পর ফিরতি প্রশ্নে যখন সে আমার ঠিকানা জিজ্ঞেস করল, তখন বুঝলাম এক সর্বনাশ হয়ে গেছে। আমার বাড়ির গলিটিও ফেলে এসেছি সেই নির্দিষ্ট জায়গায়। ফলে, এই মুহূর্তে আমি জানি না, কোথায় আমার বসবাস, কোথায় আমাকে ফিরতে হবে আজ রাতে!
পাগলের মতো দৌঁড়ে গিয়ে দেখি পথকুকুরের দল সেই গলিগুলো নিয়ে টেনে হিঁচড়ে খাচ্ছে। আমি তাদের সঙ্গে লড়াই করে, তাদের ধারালো দাঁতে নিজেকে ক্ষতবিক্ষত করেও ফিরে পেলাম না আমার বাড়ি ফেরার গলিটি। অবশেষে হতাশ হয়ে চলে এলাম শিয়ালদায়। কোন ট্রেন ধরব, কিছুই মনে পড়ছে না। কোন মফঃস্বলে আমার বাড়ি ছিল! কোথায় ফিরতে হবে! কিচ্ছু মনে পড়ছে না, কিচ্ছু নয়।আমার শরীর হাল্কা হয়ে যাচ্ছে খুব, মাটি থেকে ওপরে উঠে যাচ্ছে। আরও আরও হাল্কা হয়ে আমি উড়ে যেতে লাগলাম আকাশে।
আমার পায়ের নীচে গোটা কলকাতা শহর। শুধু মনে নেই কোথায় যেন বসবাস ছিল আমার। কোন গ্রাম? কোন মফঃস্বল।
শুধু দেখি, আমার চারিদিকে অজস্র মানুষ। তাদের চোখে জিজ্ঞাসা, কোন গ্রাম, কোন মফস্বল! তারা উড়ছে, খুঁজে পেতে চাইছে।
তাদের পায়ের নীচে জেগে আছে এক জ্বলন্ত কলকাতা।
0 Comments