ভাঙা ডানার গল্প

মণিদীপা বিশ্বাস কীর্তনিয়া on

  ব্যাপার কি দোয়েল? সহজ একটা উপপাদ্যটা মেলাতেই পারছো না? আর অত ঘনঘন ঘড়ি দেখারই বা কারণ কি? কিছু না স্যার,দোয়েল ঝুঁকে পড়ল খাতার ওপর।কিন্তু দোতালার পড়ার ঘরের ঠিক নীচেই তাদের বসার ঘর থেকে অনেকের টুকরো গলার আওয়াজ,হঠাত হঠাত বেজে ওঠা হারমনিয়াম আর গিটারের শব্দ উঠছে। ছোড়দা কি আজ তাড়াতাড়িই এসে গেল?


           এমনিতেই সোম,বুধ,শনি তার রুটিনটা একটু কঠিন,স্কুল ছুটির পরে পরেই পরেশবাবু স্যার অংক করাতে এসে পড়েন আর সন্ধের পরে আসেন ইংরেজির পশুপতিবাবু স্যার।আসলে নিজেদের বাড়িতেই স্যাররা ব্যাচ করে করে পড়ান। স্রেফ মায়ের কথা ফেলতে পারেননি বলে নিজেদের সময় অ্যাডজাস্ট করে বাড়ি এসে তাকে পড়াতে রাজি হয়েছেন। ফলে ওনাদের সময় পাল্টানোর প্রশ্নই ওঠে না। তবে মঙ্গল আর শুক্কুরবার ব্রততীদি আসেন ভূগোল-ইতিহাস নিয়ে,ওই দুটোদিন সব থেকে ভাল লাগে তার,পড়ার চাইতে গল্প হয় অনেক বেশী,মহাকাশ নিয়ে,সমুদ্র নিয়ে,ইতিহাস নিয়ে,বিভূতিভূষণ নিয়েও।


          অন্যদিন যাহোক সে চালিয়ে নেয় শুধু সপ্তাদুই বাদে বাদে ছোড়দা এসে পড়লেই সমস্যা। গণসঙ্গীত বা নাটকের মহড়া,পত্রিকা বা মনিমেলা তাদের মঞ্জরী ক্লাবের নানান কাজ নিয়ে মেজদা-ছোড়দার বন্ধুরা আসবেই।ঘন ঘন তাদের মিটিং,নানা কাজ নিয়ে বাকবিতণ্ডা চলে আর দোয়েলও তার সাঙ্গোপাঙ্গদের নিয়ে উত্তেজিত থাকে খুব। পাড়া আর ইস্কুল মিলে দোয়েলের দলবলও কিছু কম নেই, এই দু-তিনদিন সকাল বিকেল তাদেরও হরদম এ বাড়িতে আসা-যাওয়া। সবাইকে শিখিয়ে পড়িয়ে, কাজের ভাগযোগ করে করে ছোড়দা কোলকাতা যায় বটে কিন্তু মন থাকে এখানে। শুভাদা,বিনিদিরাও কলকাতার কলেজে পড়ে,তবে বেশীরভাগ দিন ওরা যাতায়াত করে। এখানকার কলেজে পড়ে বলে সজলদা,বাবলাদারা ছোটদের মণিমেলাটা চালায়  তাছাড়াও ছোড়দার লম্বা চিঠিতে থাকে সারা পৃথিবীর মানুষের দুঃখকষ্টর কথা,পড়ে পড়ে কিছু একটা করার জন্য মুখিয়ে থাকে তারা।


           এবারে মেজদা-ছোড়দা আবার ছজন বন্ধুদের নিয়ে এসেছে মেডিকেল ক্যাম্প করতে,পিসবোর্ডের বাক্স করে ওষুধবিষুধ নিয়ে তারা শুভাদা আর বিনিদিদির বাড়িতে থাকছে আর প্রাইমারি ইস্কুলের বারান্দায় বিনে পয়সার চিকিচ্ছে চালাচ্ছে আজ তিনদিন।কালও দুলু স্কুলে যাবার পথে চুপচাপ কেজি দুই চাল আর খানিক ডাল দিয়ে এসেছে। ছজনের জন্য বিনিদি রান্না করছে দুবেলা,দুলুদের মত ছোটোদের দায়িত্ব ছিল রসদ জোগানোর। আজ অবশ্য ক্যাম্প শেষ,তারা ফিরে যাবে মেজদার সাথে,ছোড়দা যাবে সোমবার সকালে। সব মিটিয়ে ছোড়দার আসতে আসতে মোটামুটি তার অংক টিউশান হয়ে যাবে আর ইংরেজি স্যার ডুয়ার্স গেছেন বেড়াতে,বাঁচিয়েছেন বাবা, এ সপ্তায় আসবেন না।কিন্তু এই উপপাদ্যটা আর চশমার ফাঁকে টর্চলাইটের মত স্যারের চোখ…নীচে হারমনিয়মে সা-পা ধরে রাখলো কেউ,তমালদা বোধহয় তবলা বাঁধছে।  


               প্রিটেস্টতো এসেও গেল,এখনও যদি গানবাজনা,নাটক-থিয়েটারে মন পড়ে থাকে তবে পঁচিশে ডাবল জিরো আটকায় কে? মাথা নিচু করে রাখে সে। ঘটনা সত্যি,ক্লাস নাইনের এক উইকলি টেস্টে সে একবার সব অংকই ভুল করে বসলো। যুব উৎসব চলছিল তখন।গান-কবিতা-ডিবেট সবেতেই প্রাইজ পেয়েছিল সে। তালেগোলে অংকের চ্যাপ্টারটাই করা হয়নি আর স্যার টিউশানিতে এসেই বসিয়ে দিলেন পরীক্ষায়। দুলুর চোখে তখনও প্রাইজের মেডেলগুলো ভাসছিলো আর ভুলভাল সব পাতাগুলো ঘ্যাচঘ্যাচ করে কেটে দিয়েও স্যার ক্ষান্ত হলেন না,লালকালিতে নীচে পঁচিশ লিখে উপরে দুটো শূন্য বসিয়ে বাড়ির সবাইকে ডেকে দেখিয়ে তবে গেলেন।একসাথে সব অংক ভুল করার ক্রেডিট হিসেবে তিনি আরও একটা শূন্য অ্যাড করেছেন এই ঘোষণাও দেন। সে সময় বাবা দাদারাও বাড়িতে।কেলেংকারি আরকি।ঘটনা একটু বেশীই সিরিয়াস কেন না তাদের বড়দা আবার ম্যাথেই এম এস সি,মেজদা-ছোড়দা মেডিকেল স্টুডেন্ট হলেও এইচ এস অবধি অংকে তাদের দারুন রেজাল্ট। মেজদা নাকি মাধ্যমিকের অ্যাডিশনাল ম্যাথেও একশ পেয়ে বসেছিল আর তাদের বাড়ির মেয়ে হয়ে সে কিনা শূন্য পেল তাও আবার দুটো? 


             সবার সাথে মিলে ছোড়দাও ছ্যা ছ্যা করতে লাগল। তুমি কথা বলছ কেন?মা জোর ধমক দিল ছোড়দাকে,যত নষ্টের গোড়াতো তুমি!দেশ উদ্ধার করতে বাড়িতেই ক্লাব খুলে বসেছো। গেল সপ্তাতে বাড়ি বাড়ি পুরনো বই জোগাড় করতে গেছে দল জুটিয়ে,গরিব স্টুডেন্টদের নাকি বিলি হবে সেসব,আবার বলছে সে নাকি টিউশান পড়াতে চায়,ক্লাবের ফান্ডে টাকা দেবে,আরে আগে নিজে ভাল করে শেখো আর শিখবেই বা কখন মণিমেলা দৌড়োও,পত্রিকা কর,তার ওপর গান-নাটক-আবৃত্তি,দিনরাত সংস্কৃতির চচ্চড়ি ওর মাথায় ঢোকাচ্ছো কে?


        কাল থেকে দুলুর মাধ্যমিক অবধি সব বন্ধ!গেল বুলাদির গানের স্কুল আর সুনীল স্যারের গিটার বন্ধ হয়ে।  মার কথার ওপরে কথা চলে না বাড়িতে তবু ভাগ্যিস বাবা বাড়ি ছিল, মাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ছোড়দা এলে রিহার্সেলে বসার আর ছুটির দিনে মণিমেলা যাওয়ার অনুমতিটুকু  পাওয়া গেল তাই।মার আড়ালে ছোড়দাও কিছু কম বলেনি,এ রকম হয় কি করে যাতে বড়রা কাজে বাধা দেয়, নিজের প্রতি দায়িত্ব নেই ইত্যাদি।


                সোমবারে সব টাস্ক ঠিকঠাক না পেলে কপালে দুঃখ আছে বলতে বলতে চারটে নাগাদ স্যর বিদেয় হলেন। দুলু দেখেছে ছোড়দা বাড়ি এলেই স্যার টাস্ক বাড়িয়ে দেন,রাত জাগতে হবে আর কি,সেদৌড়ে এসে বসে গেল সবার সাথে।


                  মিথ্যে কথায় আগুন যে জ্বলে না/পশুরা কখনো স্বপ্নই দেখে না/… ছোড়দা হাত তুলে থামালো,দুলু এই জায়গাটা একা গাতো,জননীগো এসো পাথরের মত নিটোল সত্য বলি/হিমালয় হয়ে ভোরের আকাশে জ্বলি…হ্যা,এখান থেকে আবার কোরাস শুরু,হিমালয় থেকে কন্যাকুমারী কান্নার সুরে তোলপাড় হোক না…শুভা এই জায়গাটা ঠিক রাখবি তুই,আমি চড়ায় ধরব,হারমনি এফেক্টটা আসবে তালে।নে আবার ধর।


               একি মুকুল, তোরা যাসনি ? পোনে পাঁচটার ট্রেনটা মিস করে যাবিতো,মেজদা আছে বলেই ষ্টেশন না গিয়ে চলে এলাম আমি। ছোড়দার কথায় চোখ সবার দরজার দিকে ঘুরে গেল। ফর্সামত রোগা এক ছেলে,কালো ফ্রেমের চশমা পরে দরজায় দাঁড়িয়ে আছে।ওরা চলে গেছে,আমায় অনির্বাণদা বলল এখানে আসতে,আসলে জ্বর চলে এলতো হঠাত।আরে আরে টলছিস কেন?লাফিয়ে উঠে ছোড়দা ধরল তাকে,এত খুব জ্বর রে,সজল,ধরতো ওকে,চ’ আমার ঘরে শুবি চ’,ছোড়দারা ধরে ধরে নিয়ে গেল আর গুলতানি শুরু হয়ে গেল।


      শুভাদা চোখ মটকে বললো,ডাক্তারি করতে এসে রোগে পড়লেন ডাক্তার! বনগাঁ লোকালের ইঞ্জিনের মত কাঁপতে কাঁপতে এল যে,শেষটায় ম্যালেরি ধরল নাকি? তবলায় হাত বোলাতে বোলাতে তমাললদা টিপ্পনি দিল।কুইনাইন ম্যালেরিয়া সারায় কিন্তু কুইনাইন সারবে কিসে গিটারের পিড়িং পিড়িং বন্ধ করে হেঁকে উঠল উদয়দা।উদো,উল্টোপাল্টা উদাহরণ দেওয়া বন্ধ করবি?মাথায়তো কাউডাং,যেখানে যাবি গন্ধ ছড়াবি, কিন্তু ক্লাবের সব কাজেই দেখি একটা না একটা ফ্যাচাং,গত মাসে অনুষ্ঠানের দিন সক্কালবেলা বলা নেই কওয়া নেই কি বৃষ্টিটাই নামল। দুলু-ঋতুরাতো উঠোনে ঝ্যাঁটা পুতে তবে সে বৃষ্টি থামালো। ব্যাঙ পেলে আবশ্য আরও আগে থামত না রে দুলু? এই ঝ্যাঁটা আর ব্যাঙের কেসটা কি দুলু? মনসুরভাই চোখ গোল্লা করে জিজ্ঞেস করল।


             আরে আমাদের বাড়িতে বকুলদি থাকে না?বকুলদির মা এসেছিল সেদিন,তা বৃষ্টির জন্য কেবলই ঘরবার করছি দেখে বকুলদির মা বলল উঠোনে একটা ঝ্যাঁটা পুতে পাশে একটা ব্যাঙ চিত করে শুইয়ে রাখতে। ব্যাঙ অবশ্য পেলাম না।


       সবাই মিলে হাহা হিহি হচ্ছিল খুব,ছোড়দা হন্তদন্ত হয়ে এসে বলল জ্বরতো দেখি তিনের কাছাকাছি।প্যারাসিটামল খাইয়ে দিলাম,দুলু তুই আর ঋতু ওপরে গিয়ে মাথাটা ধুয়ে দেতো,তোদের আজ রিহার্সেলের দরকার নেই।কাল সকাল সাড়ে দশটায় বোসবো গানটা নিয়ে।এখন পুরনোগুলোই ঝালিয়েনি আমরা।আজ সারাদিন ধরে অপেক্ষা করছে সে গানের জন্য কিন্তু ক্লাবের সবাই বড়দের, বিশেষ করে ছোড়দার কথাতে চলে। সে আর ঋতু উঠে রোগীর কাছে গেল।


               জল আনল বালতিতে,কেটলি ভরল,মাথার নীচে পলিথিন রাখল,মাথাটা আর একটু নীচে কর ঋতু,শুনছেন মাথাটা আর একটু ঝুলিয়ে দিন আপনার, কিন্তু কোনও উত্তর পাওয়া গেল না। ঋতুই টেনে টেনে মাথাটা নামালো খানিক।ঠাণ্ডা জলে বেশ করে মাথা ধুয়ে,হাত-পার তালু ভিজে গামছা দিয়ে মুছে দিল তারা। এই রে,কেলো করেছে দুলু।কি হয়েছে? বালিশটা না ভিজে গেছে বেশ,বড়দি জানতে পারলে সব্বনাশ। হেডমিস্ট্রেস বলে মাকে সবাই বড়দি বলেই ডাকে।আর দারুণ ভয় খায়।সাতটা বাজতে গেল,মা মনে হয় আজ আর আসবে না। ডি আই অফিসে গেছেতো। দেরি হলে মা বারাসাতে ছোট মাসির বাড়ি থেকে যাবে বলছিল।


      বালিশটা আলমারির মাথায় খবরের কাগজ চাপা দিয়ে রাখল দুলু।কাল চুপচাপ রোদে দিয়ে নিলেই হবে। সাতটা বাজলো নাকি রে? দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ঋতু লাফিয়ে উঠল। সাড়ে ছটায় পড়া আছে,এখান থেকে সোজা যাব বলে বই নিয়ে বেরিয়েছি,না পেলে বাড়িতে লোক পাঠাবে স্যার,আমি যাই রে,কাল সকালে আসবোখন।


              ঋতু চলে গেলে একাই মাথার নীচে শুকনো বালিশ দিল সে,লেপটা ভাল করে টেনে দিল আর তখনই ছেলেটা লাল চোখ খুলে বলল বমি পাচ্ছে খুব। উঠতে পারবেন? মাথা নাড়ল ছেলেটা আর দুলু দৌড়ে গিয়ে দোতালার ছাদে উপুড় করে রাখা একটা ভাঙা বালতি নিয়ে এল। মাথাটা দুদিক থেকে চেপে রাখল সে,আস্তে শুয়ে দিল আবার। ভিজে গামছায় মুখ মুছে দিল। বাথরুমে গিয়ে বালতি পরিস্কার করে,ঘরের মেঝেতে গড়িয়ে পড়া জল মুছে নিল। তারপর মিডি স্কার্ট ছেড়ে ভাল করে স্নান করে লম্বা ঝুলের সুতির ফ্রক পরল সে।দুলু দুধ খেয়ে যা,রান্নাঘর থেকে বকুলদি চেঁচালো।


                 একটা বাটিতে দুমুঠো মুড়ি আর দুটো বিস্কিট নিয়ে গ্লাসে একটু গ্লুকোজ তৈরি করল সে,এ সব কি ওই জ্বরের রুগির জন্য? তা নিজের দুধটাইতো খেলি না,বকুলদির কথায় সে আবার পিছিয়ে এসে দুধের গ্লাস শেষ করল।এত বড় চুল ভেজালি এখন,শুকুবে?উত্তর দিল না সে।


            শুনছেন? জল খাবেন একটু? ছেলেটা তাকালো।মুড়ি-বিস্কিট পড়ে রইল তবে জলটা খেল আস্তে আস্তে।ঠিক হয়ে যাবে।কপালে পুরনো কাপড় দিয়ে জলপটি লাগিয়ে ছোড়দার টেবিল থেকে চটি একটা বই বার করে পাতা ওলটাতে লাগল, বুদ্ধদেব বসুর ‘তপস্বী ও তরঙ্গিণী’। আর ছোড়দা এসেই, জলপটি কেন? তোকে যে বললাম মাথা ধুয়ে দিতে। দিয়েছিতো।থার্মোমিটার দেখি।যাক,একশ হয়েছে তার মানে কমছে,ছোড়দা বলল। কেমন লাগছে মুকুল? বেটার। কিছু খাবি? উহু,জিভে কিচ্ছু ভাল লাগছে না,জলটাও মিষ্টি লাগছে।জিভ ঠিক আছে,আমি জলে গ্লুকোজ দিয়ে দিয়েছিলাম আপনার বমি হলতো,মুড়ি খেলে আপনার নুনটাও খাওয়া হয়ে যেত। দেখেছিস,আমাদের দুলুও কেমন ডাক্তারি শিখে ফেলল ছোড়দা আদর করে গালটা টেনে দিল তার।আর বমি পাচ্ছে? না,ঘুমঘুম পাচ্ছে। ঘুমো তালে।


     দুলু,আমি একটু বেরোচ্ছি,ঝামেলা হয়েছে একটা,না মিটলে বিনিদের কাজে অসুবিধে হবে। খেয়াল রাখিস একটু,মাতো আসবে না আজ,ফিরে একসাথে খাবো।চা খেলি না ছোড়দা ? দিলতো বকুল।


          কোন ক্লাস তোমার? টেন। আমি মুকুল,প্রলয় মানে ইয়ে পুলুর সাথেই থার্ডইয়ার,তোমার নাম দুলু? আমার স্কুলের নাম দোয়েল।এখনতো ভাল আছেন আপনি,আমি পাশের ঘরে পড়তে যাই তালে? জল খাব আর একটু,এমনি জল। দুলু জল এনে দিয়ে ঘরের কোণে একটা ধূপ জ্বেলে দিল। সন্ধেবেলার পুজো? না,সেতো নীচের ঘরে বকুলদি জ্বেলেছে প্রদীপের সাথে,আসলে অসুখ করলে মন খারাপ করেতো,ভাল গন্ধে সেটা কেটে যায়। বাবা,দোয়েলপাখি কত কি জানে,বকুলদি কে? বলতে বলতেই বকুলদি এল,দুলু, শোনতো এদিকে,রুটি করবো নাকি ওনার জন্য,বাইরে এসে নিচু গলায় জিগ্যেস করল দিদি। জ্বরেতো ভাত খায় না,গলা খাটো করে জিজ্ঞেস করলো বকুলদি।এখন সব খায়,মেজদা বলেছে না? তাও তুমি দুটো রুটিও করে রাখো,যেটা ভাল লাগবে,খাবেন।


              দোয়েলপাখিই কি বাড়ির ম্যানেজার? না না,মা কাজে গেছে আর বাবাতো প্রতি সপ্তা আসতে পারে না তাছাড়া বকুলদিই আমাদের সব দেখাশুনো করে। ঘেমে যাচ্ছি খুব। ভিজে গামছায় সে মুছিয়ে দিল মুখ।ফ্যান চালিয়ে দিল আস্তে। জ্বর কমছেতো ওইজন্য। তোমাদের এখানটায় বাড়ির মত গন্ধ একেবারে। এটাতো একটা বাড়িই।


      দোয়েল,শোনো। যেতে গিয়েও ফিরল সে,কিছু লাগবে? তুমি এখানেই বই পড় না।পুলুটাও চলে গেল, একা আসলে..  বইখাতা নিয়ে এল সে ছোড়দার টেবিলে। তোমাদের নাটকের রেকর্ডিং শুনিয়েছিল পুলু,দু-তিনটে কবিতা ছিল আর একটা গান,তোমার গলায় না? দুলু হাসল। শোনাবে? না।আচ্ছা বেশ।পড় তুমি।আর তখনই রান্নাঘরে কি একটা বাসন ঝনঝন করে উঠল, হাওয়া উঠল এমন,জানলা দরজা ঠাস ঠাস করে পড়তে লাগল,বকুলদি চিলেকোঠার দরজা দিতে ছুটল,আর সে দৌড়ল নীচে। বৃষ্টি এল জোর। ঝুম বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে ছোড়দা ফিরলে খেয়েদেয়ে অংক নিয়ে বসতে বসতে রাতের মধ্যে রাত নামল আরও।


               পরদিন মা ফিরল,গানের রিহার্সেল চলল,জ্বর দুবার ওঠা-নামা করল,আর সন্ধের পরে চায়ের সাথে মার বানানো নোনতা সুজি নিয়ে সে গেল ছোড়দার ঘরে।জানিস পুলু,জ্বর নিয়ে তোদের বাড়ি উৎপাত করলাম ঠিকই কিন্তু রবিঠাকুরের একটা গল্পের লাইন খুবসে পড়া হয়ে গেল।         


       “বালিকা এক মুহূর্তেই জননীর পদ অধিকার করিয়া বসিল…”। পোস্টমাস্টার? দুলু বলে উঠল। হ্যা,দোয়েলপাখি,পোস্টমাস্টার।কাল এত যত্ন  করে সব করছিলে তুমি, ওই লাইনটাই মনে আসছিল।তবে গান বা কবিতা শোনাতে বললে,দোয়েল এত গম্ভীর ‘না’ বললো,বুঝলি, ভয় খেয়ে গেলাম। বলিস কি? দুলুর গানতো থামতেই চায় না। ন্যাড়ার মত সবাইকে ডেকে ডেকে গান শোনায়! মোটেও কক্ষনো আমি ন্যাড়ার মত করি না। ছোড়দা হা হা করে হেসে গান ধরে আষাঢ় সজল ঘন আঁধারে/ভাবি বসে দুরাশার ধেয়ানে… আর সে গেয়ে উঠল,…আমি কেন তিথিডোরে বাঁধারে/ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে… দুজনে একসাথে যখন গাইছিল ঋতুর দুধারে থাকে দুজনে/মেলে না যে কাকলি ও কূজনে/আকাশের প্রান করে হু হু হায়…মুকুলদা চুপ করে থাকল।তারপর বলল ভরাট মেঘের সাথে দোয়েলপাখির চিকন শিস ধূপের ধোঁয়ার মত উঠছিল তা বেশ বেশ।


             পুলু আর দুলুর গান শুনেই বুঝেছি ডাক্তারবাবুর জ্বর নেমে গেছে,বলতে বলতে বিনিদি আর শুভাদা ঢুকল। অত সাঁতার কাটতে বারণ করলাম দুদিন, কিন্তু পুকুর দেখেই ডাক্তাবাবুর বর্ধমানের গ্রামের কথা মনে পড়ে গেল,বিনিদি হাসছিল। আরে মাঝে মাঝে একটু জ্বরটর হলে বেশ যত্ন আত্যি পাওয়া যায় কি বল দোয়েলপাখি।


   “দোয়েলপাখি”?ওহো দুলুর ভাল নামতো ভুলেই গেছিলাম আমি, কিন্তু মুকুল,আমার বইদুটো  কি পড়া হয়েছে আপনার?হ্যা বিনতা,আন্তন চেকভটা নিয়ে যান তবে বনলতা সেনটা পুলুর কাছে দিয়ে দেব।ঝেঁপে দেবার চেষ্টা করবেন না,বই দিলে আমি কিন্তু  লিখে রাখি। আপনিতো কলকাতা যাতায়াত করেন,আমাদের হস্টেলেও যান বললেন,ঝাঁপবার চেষ্টা করলেও পেরে উঠবো না।ইয়েস স্যার,মনে রাখবেন “পালাবার নেই কোনো গোপন দুয়ার!”,বিনিদির কথায় সবাই হেসে উঠল আর দুলু গেল চা করতে আবার।


           মা,ওমা রিবন কোথায় আমার? নীলপাড় শাদা শাড়িতে স্কুলের ব্যাচ লাগাতে লাগাতে তাড়াহুড়ো করছিল সে পরেরদিন সকালে। আগে থেকে গুছিয়ে রাখো না কেন? মা বকতে বকতে ফিতে খুঁজে আনল,তুমি রেডি হওগে মাসি,আমি দিচ্ছি।বকুলদি তার দুই বিনুনিতে নীল ফিতের ফুল বেঁধে দিলে স্কুল ব্যাগ নিয়ে সে গেল ছোড়দার ঘরে।শাড়ি পরে তুমিতো বড় হয়ে গেলে,মুকুলদার চোখে অবাক ঘনিয়ে উঠতে দেখে লজ্জা পেল সে।


           বনলতা সেন পড়েছো দোয়েল?হাজার বছর আমি পথ হাঁটিতেছি..টাতো? গতবারের কম্পিটিশনেই ছিল।’পাখির নীড়ের মত চোখ’ মানে জানো?না মানে,পাখির বাসা খুব সুন্দর,সে রকম সুন্দর কারো চোখ? না,চশমা মুছতে মুছতে হাসল মুকুলদা।এটা যেদিন বুঝতে পারবে সেদিন তুমি সত্যি বড় হয়ে যাবে।কিন্তু পুলু সেই ভোরে উঠে গেল কোথায় বল দেখি,দুপুরের ট্রেনটা মিস না করি।


     ছোড়দার মাথায় খালি ক্লাবের কথা ঘোরে,তবে ট্রেনের দেরি আছে,চলে আসবে ঠিক। আর তুমি,সকালবেলার রোদে নীলশাদা ডোরাকাটাএক পুঁচকে দোয়েল পাখি,তোমার মাথায় কি কি ঘোরে বল দেখি? মুকুলদা এগিয়ে এসে তার মাথায় হাত ছোঁয়ালো।এত করেছো এই দুদিন,ধন্যবাদ দেওয়াওতো যায় না। ছোড়দার সাথে আসবেন আবার। ভাল থেকো দোয়েল,এরকমটাই থেকো,দুলু হাসল।প্রেয়ারের ঘণ্টা পড়ে যাবে,আমি যাই? আর ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে তার মাথায় বনলতা সেন ঘুরতে লাগল।


              ব্রততীদি, একটা কথা।মঙ্গল গ্রহ না প্রশান্ত মহাসাগর? ওসব না, বনলতা সেনের একটা লাইন,মানে পাখির নীড় দেখতেতো সুন্দর না,অথচ রূপতো দেখার মধ্যেই থাকে দিদি, তাহলে পাখির নীড়ের মত বলছেন কেন চোখ?আলাদা করে শব্দদুটোর ধ্বনিমাধুর্য ছাড়াও নীড় হল পাখির ঠিকানা অর্থাৎ কিনা যে চোখের দিকে তাকালে সেই শান্তির আশ্রয় মেলার অনুভূতিটা হয় সেরকম চোখ বলছেন আরকি কিন্তু লিখছিসতো ১৮৫৭-র সিপাহিবিদ্রোহ আর ১৮৯৯- এ জন্মে নিরীহ জীবনানন্দ কি করে কবিতাসুদ্ধু তার মধ্যে ঢুকে পড়ছেন বল দিকি। আবার কি কোনো ফাংশান নেচে উঠল সামনে?


               কিছুদিন পরে দুলুর চিঠি এল দুটো,ছোড়দা লিখেছে এবারের পত্রিকায় অনুলিখন থাকবে। ভ্যানওলা,চাষি,দিনমজুরদের কাছে গিয়ে তাদের কথা শুনে লিখতে হবে অনুলিখন। বাগানে যে ছাত্তারভাই কাজ করে,দুলু যেন তার কথা লিখতে শুরু করে। অন্য ইনল্যান্ডটা খুলতেই গা ছমছম করে উঠল তার, ডট পেনে আঁকা ছবিতে ছায়াগাছে বসে আছে ছোট এক পাখি আর পাশে লেখা…  গান গাও দোয়েলপাখি/রোদের চিকন ডালে উঁচু হয় হাওয়া/যে সব দুপুর ঝিমিয়ে পড়েছে তার হলুদ অসুখে/নিঃশ্বাস নিক ফের/জলের নরমে এতো থইথই রাত/নীল শাদা ডানার পালকে মিশে ভোর হয় রোজ/এখানে শহুরে রোদ পায়ে করে পার হই/শুধু ছায়ারা দীর্ঘ হয় ঘুমের ভেতর/অচেনা গ্রামের নাম জেগে থাকে দোয়েলের শিসে… নীচে লেখা, দোয়েল পাখিকে অনেক ভালবাসা জানিয়ে মুকুলদা। বারবার পড়ল সে চিঠিটা।


       দুলু-উ-উ,খুব দূর থেকে মা বোধহয় ডাকছে নাকি কাঁচের কোন স্বচ্ছ দেওয়াল ঘিরে আছে তাকে। কি যেন হচ্ছে তার,সবকিছুর ভেতরে থেকেও সে যেন দূরে কোথায় যাচ্ছে।ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে সব,মুহূর্তেই ভরে উঠছে আবার।


          বেশ কিছুদিন ধরে কি লিখবে ভেবেই না পেয়ে লালচে এক বিকেলে খামে করে চিঠির কাগজে মুড়ে কিছু টাটকা বকুলফুল পাঠিয়ে দিল সে।গোধূলির আলোমাখা লাল ডাকবাক্সও বোধহয় শুনতে পাচ্ছিল তার আওয়াজ এত জোর ধুকপুক করছিল তার বুক।আশ্চর্য না পাঠিয়ে শান্তি পাচ্ছিল না অথচ পাঠিয়েও মন খারাপ লাগল খুব।পাপ হয়ে গেল নাকি? সে কি ফেল করবে এবারে?ঘুম আর জাগরণে নিষিদ্ধ কিসের মধ্যে সে যেন ঢুকে পড়ছে রাতদিন।


              আচ্ছা ব্রততীদি, ঘরবাড়ি ভাসায় বলে চীনের লোকেরা হোয়াংহোকে চীনের বিষাদ বলে আবার তাদেরই মধ্যে কেউ  বলে স্বর্গের নদী,তারাদের ছায়াপথ থেকে নাকি নেমে এসেছে সে! আসলে যে যেভাবে দ্যাখে, না দিদি? তানাবাতা আর চিনহুর গল্পটাও অদ্ভুত।আর সব দেশের রূপকথাতেই দেখি চাঁদ,তারাদের দেশের মেয়েরা কিছু বুনছে নয়তো সেলাই করছে ? আবার আকাশ ঢুকেছে মাথায়?ব্রততীদি হাসল। কি জানিসতো, আদিম সেই যুগ থেকে মানুষের খিদে মিটে গেলেই সে চারদিক তাকিয়ে দেখেছে বাতাসের দোলা ,নদীর ঢেউ,তারা ভরা রাত আর মুগ্ধ হয়ে তাকে আঁকতে চেয়েছে,পাথর খোদাই করেছে,সুর বেঁধেছে কোনও তারের যন্ত্রে।বুঝলেন ম্যাডাম,মানুষের ঘুম আর স্বপ্নে তারা ভরে দিতে চেয়েছে সেসব ছবি।


      এখন খাতাটা খোল দিকি,নীলবিদ্রোহ নিয়ে লিখতে দিয়েছিলাম না? নীলবানরে সোনার বাংলা করল এবার ছারখার/অসময়ে হরিশ মোল,লঙের হল কারাগার..এটা দিয়ে শুরু করলি না কেন?জানিস নিশ্চই লঙ হলেন জেমস লঙ।


        আক্কেল দ্যাখ এদের।টিফিনের সময় ফুল কুড়োচ্ছিল তারা। ঋতু বলে উঠল,গেটের একধারে বকুলতো আর একপাশে কদম লাগিয়ে মরেছে!আর ফুলও ফুটেছে এমন,কণা বলল,ছেলেপিলের মাথার ঠিক থাকে? কথা ঠিকই,তাদের স্কুলের সামনে সাইকেলের আনাগোনা লেগেই থাকে আর প্রেয়ারের আগে,টিফিন বা ছুটির সময় তাদের টহল বেড়েও যায়,কাগজের গোল্লা এসে পড়ে লেডিবার্ডের  বাস্কেটে। দুলু দেখেছে বেশির ভাগ একই কথা তাও খারাপ হাতের লেখা আর বানানভুলে ভরা তবে তাই নিয়ে হাসাহাসি আর চাপা অহংকার মেয়েরা ঢেকে রাখে তাদের  স্কুলড্রেসের ভেতর কেননা দিদিমণিদের কড়া নজর,বড়দির রক্তচোখ,গার্জেনকল তারা ভয় পায়।সেকেন্ডটিচার আভাদি বেরোলেই পিনড্রপ সাইলেন্স আর বড়দি হলেতো কথাই নেই, ফাইভের বাচ্চা মেয়েগুলো পর্যন্ত খেলার মাঠে আটেনশন হয়ে দাঁড়িয়ে যায়।


           প্রিটেস্টের ভৌত বিজ্ঞ্বান পরীক্ষা দিয়ে ফুরফুরে হাওয়ায় বাড়ি ফিরে নতুন একটা খাম দেখতে পেয়েই নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এল তার।চিঠির কাগজ খুললে নীলচে,গোলাপি,শাদা খুব পাতলা ছোট্ট ঝিনুকগুলো   ঝুনঝুন করে নীচে পড়ল। চিঠির একপাতায় লেখা …পাখিদের ডানা নিভে এলে/ঢেউয়ের মাথায় চেপে উড়ে আসে যেসব ঝিনুক/প্রাচীন জলের কথা জানে/ বৃষ্টিযুগের কথা নিজেরাই বলাবলি করে/রাতের জোয়ারে ফুলে ওঠা সমুদ্র চুড়োয় /শঙ্খচিলের মত উড়তে চেয়েও দ্যাখে তটভূমি বরাবর/পৃথিবীর ছাদ থেকে ঝাঁপ দিচ্ছে তারা/মরা শাঁসে জেলেরা মুক্ত খুঁজে নিলে/ বিপরীত  স্রোতে পড়ে থাকে ঝিনুকের একঝাঁক বিষণ্ণ ডানা/পাখিদের ভোর জেগে ওঠে… 


       আর উল্টো পাতায় লেখা দোয়েলপাখি,ছুটিতে গোপালপুর এলাম। এত হইচই করছে ঢেউরা,ঝিনুকরা শুধু শুনছে অথচ ফাঁকা তাদের বুক ভরেতো রাখে ওই জলই। উড়তে শেখায় তাদের। তুমি নিশ্চই ভাবছো মুকুলদাটা কি ভুলভাল বলছে,ঝিনুক আবার ওড়ে নাকি? সমুদ্র দেখেছো? শাদা ফেনার ঢেউয়ে চেপে সমুদ্রশাঁখ এতদূর যায় মনে হয় উড়ছে।তোমার বকুলফুলের উত্তরে এই ডানা পাঠালাম। ভাল থেকো।পরীক্ষা ভাল হোক। ভালবাসা জেনো।মুকুলদা।   


     তপ্ত আর হাল্কা হয়ে এল বাতাস।যেন তার কাঁধ ফুঁড়ে বাতাসের ডানা গজাবেএক্ষুনি,উড়ে যাবে সেও।


            একেবারে সিনেমার নামে নাম্বার? খাতায় সাড়ে চুয়াত্তর দেখে স্যার হেঁকে উঠলেন। বাকি অংকগুলো স্যারের ভাষায় যত সিলি মিসটেকে ভর্তি নাহলে ভালই হত।মা অবশ্য কিছু তেমন বকলো না। স্যার চলে গেলে বরং বললো হাতে সময় আছে,ভাল করে পড়ো,হয়ে যাবে।আর শোনো,দুটো কার্ড পেয়েছি। রোববার সকালে সিনেক্লাব পথের পাঁচালি আনছে,বিনিকে বলে দেখো যেতে পারে কিনা,আমারতো সময় হবে না। তাহলে ওর সাথে যেওখন। মা, ওমা এক্ষুনি যাই বিনিদি যদি কাল কলকাতা যায় তালে ওকে পাব না আর ব্রততীদিও আজ এক্সট্রা পড়াবেন বলে গেছেন। তাহলে তাড়াতাড়ি ফিরবে কিন্তু। আচ্ছা। 


             হাল্কা হাওয়ার মত পায়ে বিনিদিদের সিঁড়ি দিয়ে লাফিয়ে সে উঠছিল হটাতই বিনিদির সাথে কার যেন আধচেনা গলার হাসি শুনে থেমে গেল,চিঠি পাওনি?আমিতো গোপালপুর থেকে তোমাকে আর দোয়েলকেও চিঠি দিলাম সেও পেল কিনা জানি না অবশ্য।ছোটদের এত ভাল লাগে,দোয়েলকে দেখলেইতো আমার খুড়তুতো বোন বাবলি,টুনিদের কথা মনে আসে। অমনই অপাপ নীলে ধোওয়া মুখ। বেশ বেশ,কিশোরী মেয়েদেরই শুধু ভাল লাগে তোমার।আরে না,কিশোরীদের দিদিকেও। এখানে না এলেতো জানাই হত না ইচ্ছামতির এক ছায়া ছায়া মফঃস্বলে কবিতার বই হাতে বসে আছে বিনতা সেন যার শুধু পাখির নীড়ের মত চোখই নেই,সে মণিমেলা চালায়,মেডিকেল ক্যাম্পের ছেলেদের রান্না করে খাওয়ায়,যোগমায়া কলেজে বটানি পড়ে আবার বই ধার দিলে পাওনাদারের মত হামলাও করে।আমিতো ফেরত দিইনি ইচ্ছে করেই,জানি বইয়ের টানে সে আসবেই।কি পাজি! আমি জানতামই না। আরও অনেক কিছু জানা তোমার বাকি আছে বিনি।ওসব ক্রমশঃ প্রকাশ্য কিন্ত মহারানী এখন আজ্ঞা দিন,আমি একটু দোয়েলদের বাড়ি থেকে ঘুরে আসি। দুদিন হল আছি,আজ একবার দেখা না করলে মাসিমা আর দোয়েল ভাববে কি?


         তাড়াতাড়ি ফিরবে,খেয়েতো আবার ঘুমোতে যাবে সেই  সজলদের বাড়ি। ও কে ম্যাডাম,আমরাতো ভোরের ট্রেনে একসাথে কলকাতা ফিরছি তখন তোমার সব কথা শুনবো।


             যেমন এসেছিল তেমনই নিঃশব্দে বেরিয়ে আসে দুলু। সাইকেলটা ঘুরিয়ে আমবাগানের ভেতর মাটির রাস্তা ধরে। সারাটা বিকেল এ রাস্তা সে রাস্তা,সে ঘোরে ভুতের মত। দুলু এই দুলু,সন্ধে নেমে গেছে আর নদীর ধারে কি করছিস তুই?দেব কানের গোড়ায়? মুখের কাছে হাত এনেও থমকে যায় সজলদা।কি হয়েছে রে?


        দোয়েলপাখি তুমি এখানে আর আমি তোমাদের বাড়িতে বসে থেকে থেকে ফিরে এলাম।মাসিমা কিন্তু খুব চিন্তা করছেন। অন্ধকারের ভেতর মুকুলদা,বিনিদিও এগিয়ে আসে। এই দুলু,কথা বলছিস না কেন? বিনিদি এসে হাত ধরে,কিছুই হয়নি,অংক খারাপ করেছিতো,তাই ভাবছিলাম।দেরি হয়ে গেল,ব্রততীদি বসে থাকবেন।যাই কেমন? সবার দিকে তাকিয়ে অস্পষ্ট হাসল সে আর সাইকেলে উঠে পড়ল।


                  ধীরে সুস্থে আয় তোরা আমি এগিয়ে দি ওকে। সে না করলেও সজলদা চুপচাপ তার পাশে পাশে সাইকেলে এল।আর মাকে বললো  আমাদের বাড়িতেই ছিল মাসিমা,মুকুলদের সাথে পথেই দেখা হল।আপনি চিন্তা করছেন শুনে নিয়ে এলাম।চা হবে না ? দুলু যা হাতমুখ ধুয়ে নে,আমি ততক্ষণ ব্রততীদির সাথে দেখা করে আসি।


               ঘরে এসে  চিঠিদুটো ছিঁড়ে ফ্যালে সে।কুচি কাগজ আর ঝিনুকগুলো এত জোরে চেপে ধরে হাতে তালুতে যেন ফুটে যায় ভাঙা ঝিনুকের টুকরো,সবসুদ্ধু দৌড়ে পেছনের পুকুরে ফেলে আসে সে।আঁজলা ভরে জল নিয়ে বারবার ধুয়ে ফ্যালে চোখ।রগড়ে রগড়ে মুছে তারপর পড়তে বসে।


            রোজকার মত বাড়ি ফেরার আগে গেটের কাছ পর্যন্ত এগিয়ে দিতে যায় ব্রততীদিকে।কি হয়েছে রে?মাথা নাড়ল সে। ঝিনুকরা আসলে উড়তে পারে না দিদি,ভেঙে যায়। ব্রততীদি  চুপ করে রইল।তারপর নরম গলায় বললো,হোয়াংহো নদীকে কেউ বলে দুঃখ,কেউ বলে স্বর্গের নদী,তারাদের ছায়াপথ থেকে নাকি নেমে এসেছে…আসলে যে যেভাবে দ্যাখে তাই না দুলু? ভাঙা ঝিনুক গেঁথেই হয়ত কেউ কেউ বানিয়ে ফ্যালে ছোট্ট জাহাজ,বোতলবন্দী হয়ে পাড়ি দেয় তা আরও অচেনা ঢেউয়ে। আমরা শুধু অপেক্ষাই করতে পারি আরকি। কিসের? যে উত্তর আমরা খুঁজছি তার। দ্যাখ দুলু, ওই যে কালপুরুষের বেল্টের পাশে ছোট্ট তারা লুদ্ধক তার পাশে আরও ছোটো নাম না জানা ওই তারা হয়ত মারা গেছে বহুকাল, আমরা জানি না।কত বছর আগে রওনা দিয়ে আজও যে তারার আলো এসে পৌঁছোয়নি তাকেও জানি না।আলো অন্ধকারে সাজানো এই আকাশের কতটুকু জানি আমরা বল,জীবনও ওরমই রে। আজ যদি কোনও প্রশ্নের জবাব ঠিক নাও মেলে শান্ত হয়ে অপেক্ষাই করতে হবে।কতদিন?যতদিন না  উত্তর মেলে। ঘরে যা দুলু,আমি এলাম।


             অন্ধকারে কি একটা পাখি উড়ে গেল। তারাভরা আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে দোয়েল ভাবল,এরমই হয় তালে? পরের ষ্টেপেই মিলে যাবে ভাবলেও সহজ অংক ভুল হয়ে নাগালের বাইরে চলে যায়?কতদিন ধরে এই একা কান্নাদের ভাসিয়ে দিতে হয় ? জলের ভেতরে তারা জল হয়ে থাকে আরও কতদিন?


    তবু এরপর দেখা হলে সে হেসে উঠবে আগের মতই,গান শোনাবে বেশ।ভাল থাকুন মুকুলদা,জানলার সিটে বসে বিনিদির সাথে চলে যান ভোরের ট্রেনে। আঙুলের একান্ত মেঘ তার আজও  ছোঁয়া বারণ। হাওয়ার ভেতর সে শুধু উড়ে যাবে একলা ওই পাখির মত।


            দূর থেকে আলোজ্বলা তার ঘরের দিকে তাকালো দোয়েল,যেন খানিক বড় হয়ে উঠল ।কোনদিন সে বলবে না আজ বিকেলে বাতাসের ধাক্কায় তার ডানা মুচড়ে গেছে, ভাঙা ডানার ব্যাথা কাউকেতো বলতে নেই…


ফেসবুক অ্যাকাউন্ট দিয়ে মন্তব্য করুন


মণিদীপা বিশ্বাস কীর্তনিয়া

উত্তর চব্বিশ পরগনার বসিরহাটে জন্ম। ন‍্যাশনাল মেডিকেল কলেজ থেকে এম.বি.বি.এস.ডিগ্রি। বালুরঘাট জেলা হাসপাতালে কর্মরত। মূলত কবিতা লেখারই আকাঙ্ক্ষা। শখ বই পড়া। প্রকাশিত বই -'জোনাকির বাতিঘর', 'বিষাদ ও অহংকার'এবং 'দূরে বাজে'।

0 Comments

মন্তব্য করুন

Avatar placeholder

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।