লোহারগড়ের চম্পা

অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায় on

lohargorer_champa

আমি মানুষটা একশো শতাংশ শহুরে। আম-জাম-কাঁঠাল এই সমস্ত চেনা গাছগুলোকেও ভালো করে দেখিয়ে না দিলে চিনে উঠতে পারি না। জঙ্গল বলতে আমার কাছে কেবল গাছ আর গাছ। কোনটার যে কি নাম একশোবার করে তাকে চিনিয়ে দিলেও আমি মনে রাখতে পারি না। আমার এই অহংকারকে নিজগুণে মার্জনা করবেন। আজ আমি আপনাদেরকে বৃক্ষতত্ত্বের কথা শোনাতে বসিনি। লোহারগড়ের চম্পার কথা শোনাতে বসেছি। গাছ আর চম্পা, আমার কাছে সমার্থক। কেন সমার্থক সেই কথাই শোনাবো।

লোহারগড়। জায়গাটার নাম কাল্পনিক। আজকের মধ্যপ্রদেশ-ছত্তিশগড় সীমান্তে অবস্থিত কোনও একটি ছোট্ট জনপদ বলে মনে করে নিতে পারেন। স্বাধীনতার আগেকার সময়ে লোহারগড় সেখানকার কোনও একটি করদ রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ধরা যাক সেই রাজ্যটির নাম ছিল শক্তি। (ইতিহাসের পাতায় আপনারা শক্তির নাম পাবেন। এই নামে সত্যি সত্যিই একটি করদ রাজ্যের অস্তিত্ব ছিল। অধুনা ছত্তিশগড়ের সবচেয়ে ক্ষুদ্র আয়তনের করদ রাজ্যটিরই নাম ছিল শক্তি।) সে যা হোক, কাজের সুবাদে বছর দশেক আগে আমাকে এই লোহারগড়ে গিয়েই কিছুকাল থাকতে হয়েছিল। কাজ বলতে, পেশাগত ভাবে আমি একজন চাটার্ড এ্যাকাউন্ট্যান্ট। যদিও, সেই সময় আমি সবেমাত্র চাটার্ড এ্যাকাউন্টেন্সীর এন্ট্রান্স পরীক্ষাতে কোনোরকমে উত্তীর্ণ হয়ে এই কলকাতাতেই সরবোন এ্যান্ড বিহারীলালের কোম্পানিতে আর্টিকেলশিপ করবার জন্য নাম লিখিয়েছি। সরবোন এ্যান্ড বিহারীলাল অনেকদিনের পুরানো কোম্পানি, যদিও এই কিছুকাল আগেই তার কলকাতার অফিসটিতেও তালা পড়েছে বলে শুনেছি। মাপ করবেন, আমার আর্টিকেলশিপের সময় অবধি অন্তত কোম্পানির দুরবস্থা সম্পর্কে তেমন একটা কিছু টের পাইনি। আজ পর্যন্ত যতটুকু জেনেছি যে, সরবোনের বংশধরেরা অনেককাল ধরেই ব্যবসা থেকে সরে আসবে আসবে করছিল। সম্প্রতি বিহারীলালের বংশের প্রতিনিধিরাও সেই একই পথ ধরায় কোম্পানি খুব সম্ভবত হাত বদলাতে চলেছে। এখন সরবোন এ্যান্ড বিহারীলালের ভবিষ্যৎ নিয়ে অধিক বাক্যব্যয় করবো না।

এই সরবোন এ্যান্ড বিহারীলালের কাজ ছিল মূলত কাঠ নিয়ে। মধ্যপ্রদেশ, উড়িষ্যা, ঝাড়খন্ড, ছত্তিশগড়ের বিস্তীর্ণ অরণ্যভূমি থেকে কাঠ চেরাই করে প্লাইউড এবং অন্যান্য কাঠের যোগানদার হিসেবেই এই কোম্পানি কাজ করতো। এই কোম্পানি প্রায় স্বাধীনতার সময় থেকেই কাজ করে আসছিল। চারটি রাজ্যের রাজধানীতে চারটি বড় অফিস ছিল। হেডঅফিস ছিল আমাদের কলকাতায়। আমার এক পরিচিত বন্ধুর মামার সুবাদে এই কোম্পানিতে ঢুকতে পেরেছিলাম। শুরুতেই ছত্তিশগড় সেক্টরের দায়িত্ব দিয়ে আমাকে পাঠানো হয়েছিল। বলা হয়েছিল ছত্তিশগড়ের যে চার-পাঁচটি ক্যাম্পে সেই সময় কাঠ চেরাই চলছে, সেই ক্যাম্পগুলিতে গিয়ে সমস্ত হিসেবপত্র ঠিকঠাক রয়েছে কি না সেই সম্পর্কে আমাকে একটা বিস্তারিত রিপোর্ট দিতে হবে। কাঠ চেরাই সারাবছর ধরে চলে না। বনদপ্তরের নিয়ম মতো বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়েই কেবল জঙ্গলের কাঠ কাটা যায়। তখন সময়টা মে মাসের মাঝামাঝি। তুমুল গরম চলছে। এমন একটা পরিস্থিতিতে ছত্তিশগড় যেতে হবে শুনলে সচরাচর কেউ আহ্লাদিত হয় না। কিন্তু জঙ্গলের কথা শুনেই আমি খানিকটা হলেও আগ্রহ দেখিয়েছিলাম। হাজার হোক আমরা যে ‘চাঁদের পাহাড়’ পড়া মানুষ।

বিলাসপুর থেকে প্রায় আধবেলার বাসজার্নি করে যখন লোহারগড়ে গিয়ে নামলাম, বাস থেকে নামতেই মনে হল বিরাট জঙ্গলটা যেন খপ করে আমাকে গিলে খেতে আসছে। অথচ, বড় রাস্তার উপরেই একটা চায়ের দোকান আর সেই দোকানটার সামনেই বাসটা আমাকে নামিয়ে দিয়ে গেল। দুপাশে কেবল ঘন জঙ্গল, আর জঙ্গল বলতে কেবল গাছ আর গাছ। শাল আর বোধহয় দু’একটা শিমুল গাছ ছাড়া আর কোনও গাছেরই নাম আমাকে জিজ্ঞেস করলে বলতে পারবো না। কিন্তু সেই ভরা গ্রীষ্মের গোধূলিতে যখন প্রথম লোহারগড়কে দেখলাম, হলুদ, সবুজ আর লালের যে এতরকমের বিভিন্ন শেডস হতে পারে প্রথমে বিশ্বাস হচ্ছিল না। অসম্ভব গরম আর তেমনই লুয়ের দাপট। তবুও বাসে আসতে আসতে জঙ্গলের যে রূপ দেখেছি, বাস থেকে নামতেও তেমনই যেন একটা অদ্ভুৎ গা ছমছমে ভাব টের পেলাম। ক্যাম্পের সুপারভাইজার শত্রুঘ্ন আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। বড় সাহেবের লোক আমি, কাজেই খাতির যত্নের বহরটা ভালো ভাবেই টের পাচ্ছিলাম। ক্যাম্পে পৌঁছতে আরও মিনিট কুড়ি জঙ্গলের পথ দিয়ে হাঁটতে হল। দেখলাম স্রেফ আমার জন্যই আলাদা করে একটা তাঁবুর ব্যবস্থা হয়েছে। শুনলাম নাকি খানিক দূরের একটা গ্রাম থেকে ইঁদারার মিষ্টি জল নিয়ে এসে ধরে রাখা হয়। একটা নাকি নদীও আছে। ‘রানিং ওয়াটার’ না জুটলেও জলকষ্ট তেমন নেই। রাত্তিরে আমার জন্য চাপাটি আর মুরগীর মাংস হচ্ছে। সাহেবের কড়া হুকুম আমার যেন এতটুকুও অসুবিধে না হয়। খোলা আকাশের নীচে স্নান করতে হবে কি না এই ভেবে একটু দোনামোনা করছিলাম। আজীবন শাওয়ারের ধারায় স্নান করে অভ্যস্ত। দেখলাম আমার জন্য একটা মেকশিফট স্নানের জায়গাও বড় গামছা আর কাপড় দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। আমি কোনোমতে হাসি চেপে স্নান করতে গেলাম। নিজেকে যেন বেশ কেমন একটা গল্পের নায়কের মতোই মনে হচ্ছিল। কেবল সঙ্গে একজন সুন্দরী রূপসী নায়িকারই অভাব বোধ করছিলাম। চম্পার সাথে আমার তখনও দেখা হয়নি। তার অবশ্য খুব একটা দেরী হল না।

রাত্তিরে খেতে বসে দেখলাম একটি মেয়ে পরিবেশন করছে। বয়স আন্দাজ বাইশ-তেইশ। কৃষ্ণাঙ্গী, বেশ মাজাঘষা চেহারা। স্পষ্ট দুটি আঁখিপল্লব মেলে সে যখন একটিবার আমার দিকে চাইল, মনে হল সে যেন আমার বহুদিনের পরিচিত। কেবল ওই একটি চাউনিতেই সমস্তটা যেন সহজ করে নিল। ভাঙা ভাঙা দেহাতি হিন্দিতে সে জিজ্ঞেস করলো, “আর কিছু লাগবে বাবু আপনার ?” আমি না-সূচক ঘাড় নেড়ে চাপাটি ছিঁড়তে শুরু করলাম। খেতে বসেছিলাম আমরা তিনজন। আমি, শত্রুঘ্ন আর ক্যাশিয়ার মাখনলাল। একজন চৌকিদার গোছের লোক আছে, নাম হনুমন্ত। ফাইফরমাশ খাটে আর ক্যাম্প অফিসটাকে পাহারা দেয়। সে আমাদের খাওয়া হয়ে গেলে পরে খাবে। কাল সকাল থেকে কাঠ কাটা শুরু হবে। হনুমন্তের সঙ্গে তখন মজুরদেরকে কাঠ কাটাতে নিয়ে যাবে শত্রুঘ্ন। আমি আর মাখনলাল বসে বসে হিসেব মেলাবো।

একদিন প্রচন্ড গরম পড়েছে। রাত্তিরে কিছু করেই ঘুম আসবে না বুঝতে পারছিলাম। ততদিনে লোহারগড়ে আমার দু-সপ্তাহেরও বেশী সময় কেটে গেছে। গ্রামটাকেও এরমধ্যে দেখে এসেছি একদিন। জানতে পেরেছি যে চম্পার মা নেই। বাবা দশরথ আর মেয়ে চম্পাই কেবল গ্রামের একপাশে একটি চালাঘর বেঁধে বাস করে। দশরথ নাকি বুনো ওষধি গাছগাছড়া থেকে জড়িবুটি ওষুধ বিক্রি করে। চম্পা কাঠ কাটাইয়ের ক্যাম্প পড়লে বাবুদের ফাইফরমাশ খেটে দেয় অথবা মেয়েদের দলের সঙ্গে ভিড়ে জঙ্গল থেকে ঘাস কেটে আনে। সেই ঘাস আঁটি হিসেবে বিক্রি হয়। সংসারটুকু চলে যায় একরকম। সেদিন রাত্তিরে ঘুম আসবে না বুঝেছিলাম। শত্রুঘ্নকে তাই বলে রেখেছিলাম হ্যাজাক লন্ঠনটা যেন না নেভায়। খুব গরম লাগলে লন্ঠনটা সঙ্গে নিয়ে নদীটার ধারে গিয়ে বসবো। নদী বলতে নেহাতই ছোট্ট ধারা একটি। আমাদের পদ্মা-গঙ্গা-মাতলার সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার মতো কিছু নয়। ক্যাম্প থেকে মিনিট পাঁচ সাত জঙ্গলের পথে হাঁটলেই তার ধারে গিয়ে পৌঁছনো যায়। এমনি সময় এই রাস্তাতে রাত্তিরবেলা একা চলতে ফিরতে নেই। কিন্তু এখন ক্যাম্প রয়েছে। পূর্ণিমা রাত। আলোয় চারিদিক ফটফট করছে। হনুমন্ত ক্যাম্পের চৌহদ্দিটার বাইরে বসে খইনি ডলছিল। একটু দূরে একটা আগুন জ্বালিয়ে রেখেছে। সাবধানের মার নেই। আমাকে হ্যাজাকটা নিয়ে বেরুতে দেখে কিছু বললো না। কেবল হাত তুলে একটা আশ্বাসের ভঙ্গি করলো। সে থাকতে এই ক্যাম্পের কোনও বিপদ হবে না। জ্যোৎস্নাতে মাখামাখি বনপথ ধরে আমি নদীটার দিকে এগোলাম।

পাথরে, বালিতে নদীর বুক ভরে রয়েছে। খাতটুকু যথেষ্ট চওড়া। কিন্তু এই ভরা গ্রীষ্মে জল প্রায় নেই বললেই চলে। তিরতির করে এক আধটি রেখার মতো জল বয়ে চলেছে। চাঁদের আলো পড়ে জল আর বালি চিকচিক করে উঠছে। বর্ষায় নাকি এই নদীতেই প্রচুর মাছ পাওয়া যায়। এখনকার এই ক্ষীণ ধারাগুলিকে দেখে সে কথা বোঝবার উপায় নেই। আমি একটা বড় দেখে বোল্ডারের উপরে গিয়ে বসলাম। হাতঘড়িতে সময় দেখলাম রাত প্রায় একটা বেজেছে। তখন লোকজনের হাতে মোটামুটি মোবাইল এসে গেলেও আমার মোবাইলটা ছিল নেহাতই সস্তা দামের একটা নোকিয়া ফোন। তাও সেটা অর্ধেক সময়ই ডিসচার্জড হয়ে থাকতো। হয়তো সেজন্যই লোহারগড়ের ঘাস, মাটি, নদী, জঙ্গলকে সেই সময় আমি অমনি ভাবে উপভোগ করতে পেরেছিলাম। চাঁদ প্রায় মাথার উপরে এখন। পূর্ণিমার জ্যোৎস্নাতে গ্রীষ্মের সেই ভরা জঙ্গলের সৌন্দর্য যে না দেখেছে তার কাছে সেই রূপ ভাষায় বর্ণনা করা চলে না। আমি আপনমনে বোল্ডারটার উপরে কতক্ষণ বসেছিলাম জানি না। খুব অল্প করে একটা হাওয়া দিচ্ছিল। রাতচরা পাখিরা দুটো একটা করে মাথার উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছিল। অনেক দূরে কোথাও যেন একটা শেয়াল ডেকে উঠল। শহুরে আমি প্রথম দিন রাত্তিরে শেয়ালের ডাক শুনেই রীতিমতো চমকে উঠেছিলাম। পরে হনুমন্ত যখন এসে বলেছিল ও শেয়ালের ডাক মাত্র, ভারী লজ্জাতে পড়ে গিয়েছিলাম। সমস্ত জঙ্গলেরই একটা গন্ধ আছে। সে কেবল মাটি, গাছ বা ঘাসের গন্ধ নয়। সে যেন একটা নিঃস্তব্ধতার গন্ধ। সমস্ত শরীর দিয়ে তাকে অনুভব করা চলে। শেয়ালের ডাকটা ক্রমশ হু হু করে মিলিয়ে যেতে না যেতেই আমি চম্পাকে দেখলাম। এতক্ষণ খেয়াল করিনি। সেও যেন কখন আমার অজান্তেই আমার থেকে একটু দূরে একটা বোল্ডারের উপরে এসে বসেছে। এতক্ষণের মধ্যে সেও দেখতে পায়নি আমাকে। এবারে পেলো। ঝকঝকে দাঁত বের করে সে হাসলো একবার আমার দিকে চেয়ে। হাত নেড়ে বললো, তার পাশের বোল্ডারটায় এসে বসতে। একটু সঙ্কোচ বোধ হচ্ছিল বটে, কিন্তু পূর্ণিমার জঙ্গল সব সঙ্কোচকে ভুলিয়ে দেয়।

-“তুমি ভানুমতীর গল্প শুনেছো বাবুসাহেব ?” চম্পা জিজ্ঞেস করলো আমায়, “রাজকুঁয়ারী ভানুমতীর গল্প ?”

ছত্তিশগড়ের এই অজ-জঙ্গলের আদিবাসী কন্যা কি আমাকে ‘আরণ্যক’-এর ভানুমতীর কথা শোনাতে চাইছে ? নিশ্চয়ই তা নয়। এই জঙ্গলের মেয়ে চম্পা, কি করেই বা সে বিভূতিভূষণের কথা জানবে ? আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কোন ভানুমতীর কথা বলছো তুমি ?” –“রাজকুঁয়ারী ভানুমতীর কথা বলছি বাবুজি। শক্তি রাজ্যের রাজা চন্দন সিংয়ের একমাত্র মেয়ে ভানুমতী। শুনেছো তার কথা ?” আমি ঘাড় নেড়ে অসম্মতি জানালাম। চম্পা তার ভানুমতীর গল্প শোনাতে বসলো।

আশ্চর্য সেই পূর্ণিমা রাতটিকে আমি আজ পর্যন্ত ভুলতে পারিনি। যেন বা স্বপ্নের মতো উজ্জ্বল, অথবা যেন স্বপ্নের মতোই অস্পষ্ট বলে মনে হয়। সেই সৌন্দর্যের কোনও তুলনা চলে না। চম্পার মুখে সেদিনকার সেই ভানুমতীর গল্প, আমার নিভৃত শহুরে মনের নির্জন অন্দরমহলটিতে আজীবনের মতো জায়গা করে নিয়েছিল। আজও আমি চোখ বুজলেই দেখতে পাই, সেই নদী, সেই জঙ্গল, সেই অরণ্য-পরিবেশ, আর চম্পাকে। তখন আমার এই আটপৌরে, ধোপদুরস্থ শহুরে জীবনটুকুকে ছাপিয়ে অনেক অনেক দূরে চলে যেতে ইচ্ছে হয়।

“এই যে নদী দেখছো, এর নাম ছিল শান্তি। আর এই শান্তি নদীর ধারেই গড়ে উঠেছিল শক্তি রাজ্য। রূপকথার মতোই সুন্দর। আমার বাপ-দাদাদের মুখে সেই শক্তি রাজ্যের গল্প শুনেছি। এই শক্তি রাজ্যেরই রাজা ছিলেন চন্দন সিং, আর তাঁরই একমাত্র মেয়ের নাম ছিল ভানুমতী।”

কুলকুল শব্দে নদী বয়ে যাচ্ছিল। আমি অবাক হয়ে চম্পার মুখে ভানুমতীর গল্প শুনছিলাম। “তখন লালমুখো সাহেবরা এসে পড়েছে। গোয়ালিয়রের রানী লক্ষ্মীবাইকে ওরা মানতে চাইছে না। ছত্তিশগড়ের সমস্ত রাজ্যেও সেই খবর রটে গেছে। বিদেশী লালমুখোরা ক্রমশ এদেশের রাজা হয়ে বসতে শুরু করেছে। এমনই একটা সময়, ছত্তিশগড়ে কোম্পানির রেসিডেন্ট কালেক্টর হিসেবে নিযুক্ত হয়ে এলেন অতি নৃশংস এক লালমুখো সাহেব অল্ডারম্যান। অত্যাচারের জন্য কুখ্যাত এই কালেক্টর সাহেব যে কত আদিবাসী গ্রামকে পরের পর জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে শেষ করে দিয়েছিলেন তার কোনও হিসেব মেলে না। কিন্তু তিনিও বাধা পেলেন এই শক্তি রাজ্যে এসে। রাজা চন্দন সিং স্পষ্ট ভাষাতে জানিয়ে দিলেন যে কোনভাবেই তিনি ব্রিটিশ কোম্পানিকে তাঁর রাজ্যের এক্তিয়ারে থাকা জঙ্গলের কাঠ চেরাই করতে দেবেন না। বর্ধিত খাজনা দিতেও তিনি অস্বীকার করলেন। অথচ দোর্দন্ডপ্রতাপ অল্ডারম্যান সাহেবও এই চন্দন সিংয়ের বিরুদ্ধে চট করে কোনও ব্যবস্থা নিতে পারলেন না। কেন সে কথা জানো বাবুসাহেব ?” চম্পা আবার জিজ্ঞেস করে আমায়। আমি নিরুত্তর।

“এই অল্ডারম্যানের একমাত্র ছেলে মরিস প্রেমে পড়েছিল ভানুমতীর, আর সেকথা লোক জানাজানি হয়ে গিয়েছিল। এই শান্তি নদীর ধারে ভরা পূর্ণিমার রাতগুলোয় মরিস আর ভানুমতীর দেখা হতো। বাবাকে লুকিয়ে চুরিয়ে শিকারের নামে এই নদীর ধারে এসে মরিস তার ভানুমতীর জন্য অপেক্ষা করতো। ভানুমতীও তার বাবাকে কোনোমতে চোখে ধুলো দিয়ে চলে আসতো এই নদীতে। জানতো শুধু বিশ্বস্ত সখীরা দুএকজন। কিন্তু শেষরক্ষা হলো না। ছেলের এই নৈশ-অভিযানের খবর বাবার কানে পৌঁছলো। ছেলের সঙ্গে একদিন তুমুল বাগবিতণ্ডা হলো অল্ডারম্যানের। ছেলে বললো কেন তার বাবা শক্তি রাজ্যের এইটুকু মাত্র জঙ্গলকেও অন্তত ছেড়ে দিতে পারছেন না। রাজকুঁয়ারী ভানুমতী জঙ্গলকে ভালোবাসতো। তার সঙ্গে থাকতে থাকতে মরিসও এই জঙ্গলের রূপ-রস-গন্ধ-শব্দ-স্পর্শকে ভালোবেসে ফেলেছিল। মরিসকে তৎক্ষণাৎ বিলেতে ফেরত পাঠিয়ে দিলেন অল্ডারম্যান। কাউকে সে খবর জানতে দিলেন না। পরের পূর্ণিমাতে ছেলে মরিসের বদলে শান্তি নদীর ধারে এসে পৌঁছলেন স্বয়ং অল্ডারম্যান।”

“শান্তি নদীর বালি আর পাথরে ভরা বুকের উপরেই ভানুমতীর রক্তাক্ত দেহটা লুটিয়ে পড়েছিল। রাগে পাগল হয়ে গিয়েছিলেন চন্দন সিং। মেয়ের প্রেম কাহিনী তাঁরও সম্পূর্ণ অজানা ছিল না। কিন্তু মেয়ের কথাতে বিশ্বাস করে তিনি ভেবেছিলেন হয়তো বা মরিসকে দিয়েই তার বাপকে সুপথে আনা যাবে। এই জঙ্গল, নদী, পাহাড়ের উপর থেকে কোম্পানির বিষদৃষ্টিকে ঠেকিয়ে রাখা যাবে। সেই আশা পূর্ণ হলো না। তার আগেই সব শেষ হয়ে গেল। তীরকাঁড় নিয়ে, আদিবাসীদের সৈন্যদল নিয়ে অল্ডারম্যানের দলের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন চন্দন সিং। সাহেবদের আধুনিক বন্দুক আর বারুদের সামনে খড়কুটোর মতোই উড়ে গিয়েছিল সে সব। চন্দন সিংকে প্রকাশ্যে তাঁর প্রজাদের সামনে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল। পরে অবশ্য চন্দন সিংয়েরই এক তুতো ভাইকে শক্তির অধিপতি করে বসাবেন কোম্পানির উপরওয়ালারা। লোহারগড়-সহ আশপাশের সমস্ত জঙ্গলগুলোর উপরে একচ্ছত্র আধিপত্য থাকবে কোম্পানির।”

চাঁদ প্রায় অস্তে যেতে বসেছে। চম্পার গল্প শেষ হল। দেখলাম ওর চোখদুটো চিকচিক করছে। “এই বন-জঙ্গল-পাহাড়কে বাঁচাতে গিয়েই ভানুমতীর মরণ হয়েছিল বাবুজি। এই জঙ্গলে ভানুমতীর জাদু আছে। আজকে তোমরা যে এই বনজঙ্গল সমস্ত কেটে সাফ করে দিচ্ছো, ইয়াদ রাখবে একদিন তোমাদেরকেও এর ফল ভুগতে হবে। যেমনটা অল্ডারম্যান সাহেবকেও ভুগতে হয়েছিল।”

-“কি হয়েছিল অল্ডারম্যান সাহেবের ?” আমি জিজ্ঞেস করি।
-“লোকে বলে চন্দন সিংয়ের দলবলের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জেতবার পরেপরেই বিলেত থেকে খবর আসে মরিস সাহেব নাকি গাড়ি এ্যাক্সিডেন্ট করে মারা গেছেন। অল্ডারম্যান সাহেবও সেই খবর পেয়ে বিলেতে ফিরে যান। কিন্তু শোনা যায় যে ফেরবার পথে জাহাজে এক ভয়ঙ্কর ঝড়ের সময় বাজ পড়ে তাঁর মৃত্যু হয়। জঙ্গলের দেবতা তাঁর প্রতিশোধ নিয়েছিলেন।” চম্পার চোখদুটো আবার চিকচিক করে ওঠে। চাঁদের আলোটা ক্রমশ ফ্যাকাশে হয়ে আসছে। “আপনি তাঁবুতে ফিরে যান বাবুসাহেব, অনেক রাত হলো।” চম্পার কথায় সম্বিৎ ফেরে আমার।

আরও প্রায় দিন পনেরো-কুড়ি আমাকে লোহারগড়ের ক্যাম্পে থাকতে হয়েছিল। চম্পার সাথে আমার দুটি-একটি কথা হতো। কোনোদিন বা আমি তার রান্নার প্রশংসা করতাম। সে একগাল হেসে ছুটে পালিয়ে যেতো। কোথাও এতটুকুও প্রগলভতা ছিল না। ওর মধ্যে আমি যেন সেই শান্তি নদীর ছিন্নবিচ্ছিন্ন জলধারাটুকুকেই অনুভব করতাম। কৃষ্ণাঙ্গী, পেলব, সুন্দরী – এক অদ্ভুৎ স্তব্ধতা যেন ওকে ঘিরে থাকতো সবসময়। এরমধ্যে হঠাৎ করেই একদিন আমার ফেরবার দিন ঠিক হয়ে গেল। ভেবেছিলাম আরও অন্তত একটিবার রাতের শান্তি নদীটাকে গিয়ে দেখে আসবো। কিন্তু কৃষ্ণপক্ষ তখন সবে মিটেছে। তার সঙ্গে আবার এর মধ্যে দুএকদিনে কালবৈশাখীর দু’একপশলা বৃষ্টিও নেমেছে। অন্ধকার বনপথে আমার চলার অভ্যাস ছিল না। কাজেই হনুমন্ত, মাখনলাল, শত্রুঘ্নের মিলিত আপত্তিতে আমায় সে মতলব থেকে বিরত থাকতে হল। ওরা সবাই অবশ্য আমার সঙ্গে যেতে চাইছিল। কিন্তু সে তো আর আমার উদ্দেশ্যসাধন করতো না। জঙ্গলের সেই নীরবতাকে চারপাঁচটি হ্যাজাকের আলো আর তিন-চারজন পূর্ণবয়স্ক জোয়ান পুরুষের কোলাহলে বিব্রত করবার কোনও বাসনা ছিল না আমার। এতদিনে যেটুকু জঙ্গলকে চিনেছি, তাতে বুঝেছি যে জঙ্গলকে উপভোগ করতে গেলে তার কাছে একাকী যেতে হয়। মনের ভিতরটুকুতে একটা সম্ভ্রমের ভাব নিয়ে যেতে হয়। নইলে তার বিশালত্বকে, তার স্তব্ধতাকে অপমান করা হয়।

আমার ফেরবার দিন ঠিক হয়ে গেল। সেদিন সব গুছিয়ে নিয়ে ক্যাম্প থেকে বেরুবো, বাস আসবে সেই চায়ের দোকানটার কাছেই। হনুমন্ত, মাখনলাল, শত্রুঘ্নেরা সব এসে দাঁড়িয়েছে। চম্পাকে কোথাও দেখতে পেলাম না। “চম্পা কোথায় ? সে আসেনি আজ ?” আমি জিজ্ঞেস করলাম। “আজ্ঞে না বাবু, আজ তো শুক্রবার। জঙ্গলের আরও ওদিকে তিনচারখানা গ্রাম মিলিয়ে হাট বসবে। বুড়ো দশরথকে নিয়ে সেই হাটে যাবে আজ চম্পা। কাল বলে গেছে আমায়,” জবাব দিল হনুমন্ত। মনে মনে ভাবলাম, সে জানে যে আজকেই আমার ফিরে যাবার দিন। অন্তত একবার বলে যেতে পারতো। কিছু না বলে পঞ্চাশটি টাকা দিলাম মাখনলালকে। বললাম, “চম্পাকে দিও।” টাকাটা হাত পেতে নিল মাখনলাল।

জঙ্গলের পথে আসতে আসতে শত্রুঘ্ন আমাকে বলছিল, “আপনার দিল খুব বড় হুজৌর। আপনি চম্পাকে টাকা দিলেন। আরও অন্য সাহেবরা আসেন বটে, কিন্তু তাঁরা যেভাবে দেন। অনেকটা যেন ভিক্ষে দেওয়ার মতো করে দেন। আপনি আলাদা লোক বাবুসাহেব।” আমি হেসে বললাম, “আমিই বা কি এমন আলাদা ভাবে দিলাম শত্রুঘ্ন ? আসলে মেয়েটাকে দেখে বড় সরল, বড় দুঃখী বলে মনে হয়। কিন্তু মেয়েটার একটা মন আছে। আমাকে ও একদিন একটা গল্প শুনিয়েছিল।”
-“ওই ভানুমতী আর চন্দন সিংয়ের গল্প তো বাবুজি ?”
-“তোমরাও জানো নিশ্চয়ই।”
-“ভানুমতী আর চন্দন সিংয়ের গল্প এখানে সবাই জানে হুজৌর। কিন্তু মজার কথা কি জানেন ? ভানুমতীর গল্পের সঙ্গে চম্পার নিজের জীবনটাও যেন উলটো পিঠে মিলে গেছে বাবুজি। তাই তো ও অমনি করে একা একা ঘুরে ঘুরে বেড়ায়।”

আমরা চায়ের দোকানটার কাছে এসে পড়েছিলাম। বাস আসতে তখনও আধঘন্টাটাক দেরী ছিল। দোকানদারকে বেশটি করে মালাই দিয়ে দু’গেলাস চা করতে বললাম। “কি সেই গল্প শত্রুঘ্ন, বলো আমায়।”

-“চম্পার বিয়ে হয়েছিল বাবুজি, ওর তখন ষোল বছর বয়স। ওর মরদও এখানকারই ছেলে ছিল। নাম ছিল জিতনরাম। বনবিভাগে চাকরি পেয়েছিল হুজৌর। কিন্তু সুখ সইল না চম্পার কপালে। যেমন বনের জন্তু জানোয়ারদের মারবার জন্য চোরাশিকারিরা আসে, তেমনি কাঠচুরির দলও আসে বাবুসাহেব। জিতনরামের ভয়ডর বলে কিছু ছিল না। জঙ্গল ছিল ওর প্রাণ। চম্পারও তাই। কিন্তু ওই জঙ্গলকে বাঁচাতে গিয়েই কাঠচোরেদের কুনজরে পড়ে গিয়েছিল জিতন। ওই শান্তি নদীর বোল্ডারের উপরেই ওরও লাশ পাওয়া গিয়েছিল একদিন। মাথাটা পুরো থেঁতলে দেওয়া হয়েছিল, চেনাই যাচ্ছিল না ওকে। সেই থেকে মেয়েটাও কেমন যেন হয়ে গেছে। কোনও অভিযোগ নেই, দুঃখের কথা বলা নেই। লোকের বাড়ি বাড়ি খেটে বেড়ায় আর রাতবিরেতে ওই শান্তির পাড়ে গিয়ে বসে থাকে। ভেতরে ভেতরে আসলে বড় দুঃখ ওর।” চুপ করে যায় শত্রুঘ্ন। আমিও চুপ করে থাকি। অল্প হাওয়া দিচ্ছে। সরসর করে একটা শব্দ আসছে জঙ্গলের ভিতর থেকে। বাস আসবার সময় হয়ে গেছে। দূরে হাইওয়ের বুক চিরতে চিরতে সে ছুটে আসছে। জোরালো যান্ত্রিক গর্জনে চারদিক যেন কাঁপাতে কাঁপাতে ছুটে আসছে। শত্রুঘ্নই হাতে হাতে সব মালপত্তর তুলে দিল আমার। জানলার পাশে বসে তার দিকে হাত তুলে বললাম, “আবার দেখা হবে শত্রুঘ্ন, ভালো থেকো তোমরা সবাই।” আমার গলা বুজে আসছিল। আমি জানতাম আর কোনোদিনই ওদের সাথে আমার দেখা হবে না। মুখ ফিরিয়ে একবার জঙ্গলের পথটার দিকে তাকালাম। নাঃ, চম্পাকে কোত্থাও দেখতে পেলাম না। সে হয়তো এখন তার বাপ দশরথের পাশে বসে কোনও খদ্দেরের সঙ্গে জড়িবুটির দরাদরিতে ব্যস্ত। বাস ছেড়ে দিল। শনশন করে দুপাশের জঙ্গল পিছনে সরে যাচ্ছে। অনেকদূরে পিছনে তাকিয়ে একবার শত্রুঘ্নকে দেখতে পেলাম একঝলক। চম্পা আমাকে গাছ চিনতে শিখিয়েছিল। দুপাশের জঙ্গলের রং আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। যতদিন বাঁচবো, নামগুলোকে বুকে নিয়ে বাঁচবো। মনে থাকবে – গেঁও, গামহার, মহুয়া, শিমাল (শিমুল), কুসুম, আরও কত কি … আর মনে থাকবে লোহারগড়ের চম্পাকে।

সে বুঝি এখনও কোনও পূর্ণিমা রাতে, শান্তি নদীর বোল্ডারগুলোর উপরে তার ভানুমতীকে খুঁজে বেড়ায়।


ফেসবুক অ্যাকাউন্ট দিয়ে মন্তব্য করুন


অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়

জন্ম – ১৯৯২, কলকাতায়। ২০১৪-এ পশ্চিমবঙ্গ প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইলেকট্রনিক্স এঞ্জিনিয়রিং-এ স্নাতক, পরে আইআইইএসটি, শিবপুর থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ ২০১৬-এ। বর্তমানে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি গবেষক। নেশা বলতে বই আর বেড়ানো। শখের তাগিদে নানারকম বিষয়ে লিখে থাকেন। পছন্দ বলতে পরিবেশ আর মানুষের গল্প বলা।

0 Comments

মন্তব্য করুন

Avatar placeholder

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।