একজন টিকটিকি (পর্ব – ২)

শুভ্রদীপ চৌধুরী on

ekjon-tik-tiki

সুরেশ মন্ডলের বয়স ছিয়াত্তর।

তিনি পিরোজপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান নবীন মন্ডলের বাবা। প্রধানের বাবা হিসেবে মানুষজন তাকে একটু বাড়তি খাতির যত্ন করেন।কেউ কেউ প্রণাম করার নামে তার পা জড়িয়ে ধরে গড়াগড়ি পর্যন্ত দেয়। এই সময় তিনি চোখে মুখে বিরক্ত ভাব ফুটিয়ে তোলেন।ভাঙা গলায় বলেন, “ছিঃ ছিঃ, এমন করতে নাই।”
সত্যিটা হল তিনি এমন কিছু হলে খুব আনন্দ পান।দিনটা ভাল হয়ে যায়। বুকভরে শ্বাস নিতে ইচ্ছে করে।
ঠিক এই কারণেই সকালে বগলে ক্র‍্যাচ নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বাড়ির বাইরে আসেন সুরেশ মন্ডল ।জানেন কেউ না কেউ তাকে দেখতে পেলেই ছুটে আসবে।তারপর জিজ্ঞেস করবে, “চলেন বকুলতলার বাঁশের মাচায় আপনাকে বসিয়ে দিয়ে আসি।” আজ যেমন বাড়ি থেকে বেরুতেই ছুটে এল যোগেন।

সবাই জানে তিনি দিনের বেশিরভাগ সময় কোথায় বসে থাকেন।চৌরাস্তার মোড় থেকে খানিকটা দূরে একটা ঝাঁকড়া  বকুল গাছ আছে।সেই গাছের নীচে বাঁশের মাচা বানিয়ে দিয়েছে পাশের গ্রাম কুন্দপুরের এই যোগেনই। ছেলেটার হাতের কাজ দারুণ।সে মাঝেমধ্যেই প্রধানের কাছে আসে। টুকটাক ফাইফরমাশ খাটে আর  সরকারি আবাস যোজনার একটা ঘরের জন্য তদবির করে।প্রতিবার যে এসেই ঘরের জন্য ঘ্যানঘ্যান করে এমনটা নয়।ফাইফরমাশ কাজকর্ম শেষ হলে মাথা নীচু করে খুব লজ্জা পেয়েছে এমন গলায় বলে, “প্রধান সাহেব আমার বিষয়টা একটু মনে রাখবেন। আজ আসি।”এইটুকুই।
যোগেনের সবচেয়ে বড় গুন হল,বিনে পয়সার কাজের ব্যাপারে তার মুখে না নেই। মুখ দেখলে মনে হয় সে যেন এই কাজটির জন্যই হাঁ করে বসে ছিল। এখন কাজ পেয়ে সে খুব খুশি হয়েছে।শুধু তাই নয়, কাজ না পাওয়া অব্দি সে ছটফট করতে থাকে।
যোগেনের কাঁধে ভর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সুরেশ মন্ডল বললেন, “এবার বিয়ে কর,বয়স তো কম হল না রে তোর।”
যোগেন হাসল, “সামনের মাঘের দিকে বিয়া করার ইচ্ছা আছে। ভেতর ভেতর মেয়ে দেখাশুনা করতিছে আমার এক কাকা।তবে কাকার কথা হল আগে ঘর চাই।ঘর না থাকলে মেয়ে দিবে কে?তাইনা?”
সুরেশ মন্ডল বিষয়টা ঘুরিয়ে দিতে বললেন, “আষাঢ় মাস চলতিছে খাতা কলমে আর পঞ্জিকায়, এদিকে আকাশে চড়চড়ে রোদ্দুর।বৃষ্টির নাম গন্ধ নাই। এবার চাষবাস হবে বলে মনে হয় না ।”
যোগেন আকাশের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে বলল, “আজ বৃষ্টি হবে,মিলায়ে নিয়েন।বিশ্বাস করলেন না?”
সুরেশ মন্ডল তার কথার উত্তর দিলেন না। আলফাল কথার উত্তর হয় না।এর চেয়েও বড় কথা তিনি প্রধান সাহেবের বাবা সুতরাং সব কথার উত্তর দেওয়া তার মানায় না। সব কথার জবাব দেবে সাধারণ মানুষ। যে মানুষ যত কথা বলে তার ক্ষমতা তত কম।ক্ষমতাবান মানুষেরা সাধারণের সংগে হু,হাঁ, পরে শুনছি, ব্যস্ত আছি এসব বলবে এবং কেটে পড়বে।এটাই নিয়ম এর বাইরে গেলেই গোলমাল।
অথচ তিনি নিজেই অনেক কথা বলে ফেলেছেন বলে নিজের প্রতিই বিরক্ত হলেন। মাচায় বসার পর তিনি যোগেনকে হুকুমের সুরে বললেন, “পীরতলির দুবিঘা জমির আজ ঘাস সাফ করে দে। ভেতরবাড়িতে কোদাল আছে নিয়ে যাস।”

যোগেন কাজ পেয়ে অন্যদিনের মত খুশি হয়ে হনহন করে চলে গেল।
ফুরফুরে একটা হাওয়া আসছে উত্তর দিক থেকে। সুরেশ মন্ডল বাঁশের মাচায় টানটান হয়ে শুয়ে পড়লেন । কিছুক্ষণের মধ্যেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলেন।

মাথার উপরে দপদপ করে জ্বলছে সূর্য। যোগেন কাজ শেষ করে আলের উপরে বসে আছে। এমনি এমনি বসে নেই সে অপেক্ষা করছে বৃষ্টির। আর কিছুক্ষণের মধ্যে বৃষ্টি নামবে।একটু আগে সে যা দেখেছে তাতে নিশ্চিত হয়েছে। এসব তার চোখেই পড়ে। তার কাছেই যে বারবার আসে। আজ সসকালে যেমন এসেছিল।অন্যকেউ সহজে দেখতে পায়না। বললে বিশ্বাস করে না।
একটু আগে যোগেন যা দেখেছে তা এইরকম,  উত্তর দিক থেকে উড়ে এল ফড়িংটা।তার মাথার উপরে বেশ কয়েকবার পাক খেল।এর মানে সে ভিজতে চলেছে। মুখের সামনে পাক খেলে হত ঝড়। ঝড় না হয়ে বৃষ্টি আসছে এটা খুবই আনন্দের কথা।
কেউ তার কথা বিশ্বাস করবে না। তাই আগ বাড়িয়ে কাউকে বলতে ভরসা পায় না।দেখতে দেখতে মুছে গেল রোদের তেজ।ধীরেধীরে এগিয়ে আসছে কালো রঙের মেঘ।সে জানে বৃষ্টি থামার মিনিট খানেকের মধ্যে সেই ফড়িংটা তার সামনে এসে কয়েক পাক খেয়ে উড়ে যাবে। প্রতিবার আসে, যেন বলতে চায়, দেখলে তো কেমন মিলে গেল! 
দুবছর আগের এক সকালের ঘটনা।দিনটা যোগেন  ভুলতে পারে না।ছিপ ফেলে বসেছিল নবু হালদারের পুকুরের পাড়ে। ফাতনার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই চোখ যায় জলের উপরে একটা ঝোপের দিকে। একটা কালচে রঙের পোকা উঠে এসে বসল পদ্মপাতায়।কিছুক্ষণের মধ্যে তার রঙ পালটে গেল। কালচে রঙ হয়ে গেল সাদাটে।ফাতনা থেকে যোগেনের  মনযোগ ছিনিয়ে নিল পোকাটা। বেশ কিছুক্ষণ হাঁ হয়ে বসে থাকার পর সে বুঝল পোকাটা মরে গেছে। মিনিট পনেরো বাদে সে বড়শি তুলে অন্য পাড়ে যাবার সময় দেখল পোকাটা মরেনি। সে আসলে ঘাপটি মেরে মরার মত পড়েছিল।এবার আশ্চর্য কান্ড হল। পোকাটার পিঠের কাছটা উঁচু হয়ে উঠতে লাগল। এর পর যোগেন মন্ত্রমুগ্ধের মত ঝুঁকে দেখতে লাগল পোকাটার ঘাড়ের দিককার কিছুটা জায়গায় লম্বালম্বি ফাঁক তৈরী হয়েছে।সেই জায়গা দিয়ে বেরিয়ে এল একটা মাথা। দু’তিন মিনিটে সে বুঝল পোকাটা আসলে  ফড়িং হয়ে গেল। সেদিনটা ছিল অদ্ভুত।এমন একটা ঘটনা তার চোখের সামনে ঘটে গেল  তবু সে কাউকে বলতে পারল না। বিকেলের দিকে সে যখন মাঠে হাবুল মন্ডলের জমিতে কাজ করছিল সে সময় একটা ফড়িং তার সামনে এসে খান কয়েক চক্কর দেয়। সে বুঝতে পারেনি। বুঝতে পারার কথা নয়। একটু বাদে আকাশ কালো হয়ে এল। বৃষ্টি আসবার কিছুক্ষণ আগে আবার ফড়িংটা ফিরে এল। চক্কর কেটে ফিরে গেল। সেই শুরু। এসব যে ঝড় বৃষ্টির পূর্বাভাস তা বুঝতেই সময় লাগল মাস সাতেক। 
সাতমাস বাদে বুঝেছিল সে ফড়িংরা তাকে অনেক কিছু বলতে চায়। কেন চায় সে জানে না।যোগেন ক্লাস সেভেন অব্দি পড়েছে দয়ারাম সরকার স্মৃতি উচ্চমাধ্যমিক স্কুলে। সেই স্কুলের বিজ্ঞান স্যার কে একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে পাকড়াও করল। স্যার সব শুনে ভ্রুকুঁচকে বলল, “তোর কাছে ফড়িং আসে? তারা কিছু বলতে চায়? তোর মাথা-টাথা গেছে।আমায় আর বিরক্ত করিস না যা।”
সেদিন যোগেন পাত্তা না পেয়ে মুখভার করে বসেছিল মাঠে। সে একলা মানুষ। জন্মের পর ওর বাবা কাজের খোঁজে গিয়েছিল দিল্লী।সেসব  একত্রিশ বছর আগের কথা।সেভেনের হাফ ইয়ারলি পরীক্ষার পর তিন দিনের জ্বরে টুপ করে মরে গেল যোগেনের  মা। দুঃখের চেয়ে বেশি ভয় পেয়েছিল সে। একা হবার ভয়। কুন্দপুর তাকে আপন করে নিয়েছিল।মাউরা একটা ছেলেকে যতটা দয়া নয় অনেক বেশি ভালবাসা দিয়েছিল।  স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। পালা করে এর বাড়ি ওর বাড়ি খেয়ে টিপকলের জল গলা অব্দি টেনে ঘুমিয়ে পড়ত কারুর বারান্দায়।নিজের ভাঙা ঘরে তার ভয় লাগত।  সে বুঝেছিল একা থাকার মত ভয় আর কোথাও নেই। দিনের বেলাতেই মনে হত ঘরটা তাকে গিলে ফেলতে আসছে। রাত শেষ হত না কিছুতেই। ঘরে থাকলে লন্ঠন জ্বালিয়ে রাখত। চিমনি কালো হয়ে আলো কমিয়ে দিত। একেকদিন লন্ঠনের শিখা দপদপ করতে করতে নিভে গেলে মনে হত সারা ঘরে চাপচাপ অন্ধকারে মিশে আছে আতংক।  এই ভয় দুম করে  ভ্যানিশ হয়ে যাবে একথা কল্পনা করেনি যোগেন।সেটা সম্ভব  হল সেই পুকুরপাড়ে ফড়িং দেখার পর। কারন, যোগেন এখন  জানে সে একা নয় কাছে পিঠে কোথাও একটা দুটো ফড়িং আছে। ওরা খেয়াল রাখছে সব, কিছুতেই একা হতে দেবে না তাকে।ঝড় আর  বৃষ্টি আসবার মিনিট পাঁচেক আগে ওরা সামনে আসবেই ।
ঝড়ে চারপাক খেয়ে সাঁ করে উত্তরে চলে যায় আবার ফিরে আসে আবার যায়।বৃষ্টিতে শুধু সামনে কিছুক্ষণ বৃত্তাকারে ঘুরতে থাকে।   অন্য কেউ হলে দু’চার দিনে সব্বাইকে বলে বসত। যোগেন তেমন পেটপাতলা না। সে জানে তার মত মানুষের কথা কেও বিশ্বাস করবে না। উলটে হাসবে।মিলে গেলেও হাসবে। বিশ্রি হাসতে হাসতে বলবে,দিনকে দিন তুই তোর মরা বাপের মত ছিটিয়াল হয়ে যাচ্ছিস যোগেন!

ক্ষমতাবান লোকের আলফাল কথাতেও সাধারণেরা হাসে। হাসতে হয়।এমন মানুষ হল প্রধান সাহেব।যোগেন লক্ষ্য করে দেখেছে প্রধান সাহেবের কথা শেষ হবার সংগে সংগে কে আগে হাততালি দিতে পারে তার চাপা প্রতিযোগিতা চলে। মনে হয় বাড়ি থেকে হাজার হাজার হাততালি নিয়ে সকালে প্রধান বাড়ি এসেছে। এসব মানুষ থেকে সে দূরে থাকে। ভিড় একটু ফাঁকা হলে তবেই সে প্রধানের ঘরে ঢোকে। কাজ চায়। প্রতিদিন ঘরের কথা তোলার মত আহাম্মক সে নয়। সে জানে ঘর সে একদিন পাবেই।

সত্যি সত্যিই বৃষ্টি পড়তে লাগল। বৃষ্টির ফোঁটা গায়ে এসে লাগছে মনে হচ্ছে তীরের ফলা। সে চারদিকে ভাল করে দেখতে লাগল। চারপাশ আবছা হয়ে এসেছে। বৃষ্টি এখন হাওয়ার তালে তালে নাচছে। আশেপাশে মাথা গোঁজার মত বড় গাছ খুঁজতে লাগল সে। পেল না। যতদূর চোখ যায় কোথাও বড় গাছ নেই। গাছের কথা মনে হতেই সে চট করে উঠে পড়ল এবং সময় নষ্ট না করে দৌড়তে লাগল। বুড়ো মানুষটা নিশ্চয় এই বৃষ্টির মধ্যে বাঁশের মাচাতেই আটকে আছে। এমনিতেই ওদিকটাই কেউ যায় না। মানুষটার জন্য তার বুকের ভেতরটা টনটন করছে।যোগেন দৌড়ের বেগ বাড়াল।

সুরেশ মন্ডলের ঘুম ভেঙে গেল । কখন যে আকাশ কালো হয়ে বৃষ্টি শুরু হয়েছে তিনি বুঝতে পারেননি। তার একার পক্ষে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বাড়িতে  যাওয়া সম্ভব নয়। চুপকরে গুটিসুটি মেরে বসে থাকা ছাড়া পথ নেই। এসব ভাবতে উঠে বসতে গিয়ে চমকে উঠলেন। বয়স তার চোখ আর কানে এখনও ছাপ ফেলতে পারেনি বলেই তার পায়ের কাছে হাসিহাসি মুখে দাঁড়িয়ে থাকা দীনবন্ধুকে  চিনতে পারলেন। 

দীনবন্ধু একটু এগিয়ে আসতেই সুরেশ মন্ডল চিৎকার করে উঠল, “খবরদার,  আমার কাছে আসবি না দীনবন্ধু। তুই চলে যা। চলে যা তুই।”

দীনবন্ধু হাসল,”অযথা আমায় কেন এত ভয় পান মামা। আমি কি খুব খারাপ মানুষ?”

“কী চাই? কেন এসেছিস আবার?”

“কিচ্ছু চাইনা মামা।ধরে নাও তোমায় দেখতে এসেছি। “

“তুই একটা খুনিআসামি। তোর সংগে  আমাদের আর কোনও সম্পর্ক নাই।তুই চলে যা।”

“তা বললে কেন চলবে মামা। চারদিন আগে যে লোকটা তোমার কাছে আমার সম্পর্কে খোঁজ নিতে এসেছিল সেই জগদীশের  ঠিকানা না জেনে যাই কেমন করে ।”

“কেউ আসেনি আমার কাছে।তুই ভুল খবর পেয়েছিস।”

“কোনটা সত্যি কোনটা মিথ্যে তা আমি  বুঝতে পারি মামা।আমায় মিথ্যে বলে লাভ হবে না।”

ক্রমশ…


পড়ুন, এই ধারাবাহিক উপন্যাসের আগের পর্ব।


ফেসবুক অ্যাকাউন্ট দিয়ে মন্তব্য করুন


শুভ্রদীপ চৌধুরী

শুভ্রদীপ চৌধুরীর জন্ম ১ জানুয়ারি ১৯৮৩। গ্রামের নাম ইদ্রাকপুর। বাংলাসাহিত্য নিয়ে পড়াশুনা। প্রথম গল্প প্রকাশ ২০০৪ সালে। বিভিন্ন সংবাদপত্র ও পত্রিকায় নিয়মিত লেখালেখি করেন। বর্তমানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা সূত্রে বালুরঘাটে থাকেন। অক্ষরে আঁকেন গল্প। লেখকের কথায়, জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত যা শেখায়, "যা মনে করায় তার প্রতিচ্ছবিই আমার লেখা"। যোগাযোগঃ subhradip.choudhury@gmail.com

0 Comments

মন্তব্য করুন

Avatar placeholder

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।