পুস্তক আলোচনাঃ চৌথুপীর চর্যাপদ
![chouthupir_chorjapod](https://www.dakshinerjanala.com/wp-content/uploads/2020/08/chouthupir_chorjapod.jpg)
চৌথুপীর চর্যাপদ।
লেখক, গ্রন্থস্বত্ব ও প্রকাশক প্রীতম বসু।
অক্ষরবিন্যাস ও মুদ্রণে রায় এন্টারপ্রাইজ।
মূল্য ৪০০টাকা।
বইয়ের মুখবন্ধে যদিও বলা আছে “সকল ঘটনা ও চরিত্র কাল্পনিক” তবুও শেষ পাতায় ৫০টি গ্রন্থপঞ্জি দেখে বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না ঘটনাক্রমের বাস্তব অনুষঙ্গ। পালযুগের ভাষা, সংস্কৃতি, শিক্ষা, ধর্ম, পোশাক-পরিচ্ছদ, খাদ্য, যুদ্ধবিদ্যা, নৌ-পথ ও নদ-নদীর বর্ণনা লেখক নিপুণ ভাবে প্রকাশ করেছেন গল্পের ছলে। শিবানী দত্তকে উৎসর্গ করা এই উপন্যাস ২০১৭ সালের ২৫শে ডিসেম্বর প্রথম প্রকাশিত হয়। ৪৪৪পৃষ্ঠার টান টান উত্তেজনার ঠাস বুনটে অতীত ও বর্তমান যুগপৎ রুদ্ধশ্বাস যাত্রায় এগিয়ে চলে। পাঠক একবার পড়তে শুরু করলে কিছুতেই শেষ না করে থামতে পারবে না। আর যদি পাঠক ইতিহাসে অনুরক্ত হয় তাহলে তো সোনায় সোহাগা। গল্পের পটভূমি বঙ্গদেশ থেকে তিব্বত হলেও ঘটনাক্রম মূলত বরেন্দ্রভূমির উত্তরেই কেন্দ্রীভূত থেকেছে। ঘটানার সময় কাল সমসাময়িক উত্তরবঙ্গ ও ১২০৫ সালের বঙ্গদেশ।
“গঅণ পদুমা রঅণ আঠাশ পাখুরী
দিবসই ন দিঠঠে আচ্ছই অন্ধারি।”
— চর্যাপদের এই ভাষা আমাদের প্রাচীন বাংলার শৈশবকাল। এই সন্ধ্যাভাষার অনুসন্ধানে বের হয়েছে উপন্যাসের যোজনগন্ধা। উপন্যাসের আনাচে-কানাচে ছুয়ে আছে উত্তরের পাহাড়ি রাস্তা, জল-জঙ্গল, রাজনীতি আর ক্ষমতার পালাবদল। সমান্তরাল ভাবে বর্তমান কাহিনীর সাথে সাথে ছুটে চলে ১২০৫ সাল।
“১২০৫ অব্দের কোন এক সন্ধ্যা। চৌথুপীর সঙ্ঘারামে মরণভয় ছড়িয়ে পড়েছে……। অন্ধকার সঙ্ঘারামের শূন্য প্রাঙ্গণে পদচারণা করছেন মহাস্থবির……তুরুষ্কু সেনারা আক্রমণ করেছে চৌথুপী” – এইভাবেই শুরু হয়েছে উপন্যাসটি। রহস্যের ঠাস বুনোটে গল্প এগিয়ে চলে। সমান্তরাল ভাবে লেখকের তুলির টানে ক্রমাগত স্পষ্ট হয় অতীত ও বর্তমান। সংস্কার, ধর্মীয় চেতনা, দর্শন জড়ির সুতোর মত জুড়ে রাখে অতীত আর বর্তমানকে
গবেষণামূলক এই উপন্যাস নিঃসন্দেহে বাংলা তথা বাঙ্গালীর এক ঐতিহাসিক দলিল।
একটানা গভীর বিষয় থেকে লেখক মাঝে মাঝে ফিরে গেছে সাধারণ হাস্যরসে। সত্যজিতের ফেলুদার গোয়েন্দা কাহিনীতে আমরা যে ভাবে লাল মোহন গাঙ্গুলিকে খুঁজে পাই। এই কাহিনীতে হাফি হাবিলদারকে ঠিক তেমন করেই পাই আমরা। গল্পের ট্রেস রিলিফে খুব কার্যকারি এক চরিত্র।
ঐতিহাসিক এই উপন্যাস আমাদের অনেকগুলি প্রশ্নের সামনে এনে দাঁড় করায়। ইখতিয়ার উদ্দিন মহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির আমলে বর্ধণকোট বলতে ঠিক কোন স্থানকে বুঝি আমরা? আজকের চৌথুপীর লোকেশন’ই বা কোথায়? খিলজি কি কামরূপ হয়ে সিল্করুট ধরেই তিব্বতে গিয়েছিলেন? না কি আলি মেচের সাথে তিস্তার প্রবাহ বরাবর স্বল্প পরিচিত কোন পথে রওনা দিয়েছিলেন উত্তরে? কিভাবেই বা মহাযান ও তান্ত্রিক বুদ্ধবাদ হারিয়ে গেল বরেন্দ্রভূমি থেকে? বুদ্ধবাদের সুত্র ধরে তিব্বতের সাথে বঙ্গদেশের বৈদেশিক সম্পর্কের কথাও আলোচিত হয়েছে বারবার। সব শেষে একথা বলতেই হয়, সময়-শকটে লেখক যে কল্পনার রাজ্যে পরিভ্রমণ করেছেন …… সেই দূরতম ধ্যানবিন্দুতে পৌঁছে পুরাতাত্ত্বিক অবশেষ হয়ত ভাবিকালের ইতিহাসে ফেলে যাবে আলোর বর্নালী।
0 Comments