আক্ষেপ ও অপেক্ষার শ্বাস, এবং অরুণেশ

নীলাদ্রি দেব on

“জয়পুর থেকে আমার চিঠি যায়
তুমি ডাকপিয়নের কাছ থেকে হাত বাড়িয়ে নিয়েছ সেই চিঠি
আমি ভাবতে পারি, তোমার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে
তুমি পড়তে পারো না, ছানি ফেটে বেরিয়ে আসতে চায় তোমার চোখ
তোমার যুবা বয়সের সেই চকচকে চোখের মণি

মা
আমাদের কোনো দুঃখ নেই আর, কোনো শোক
দুজনেই মরে পড়ে থাকব, দুজনেই
দুই দেশের দু-রকম রাস্তার পাশে
একইরকমভাবে।”
(মাকে)

এই কবিতার সূত্রে অরুণেশ ঘোষের সাথে প্রথম পরিচয়। এরপর কবি গদ্যকার প্রাবন্ধিক অরুণেশকে চিনতে শুরু করি। মানুষ অরুণেশ কেমন ছিলেন, আমি জানি না। জীবনের যা যা পাইনি বলে কষ্ট জমিয়ে রাখি, তার একটি, আমি অরুণেশ ঘোষকে পাইনি। তাঁকে দেখিনি। আমি আমার মতো করে, পাঠকের চোখে এঁকেছি। রেডিও জকির শব্দ পেলেও তাঁকে যেমন দেখা যায় না, মনে একটা ছবি তৈরি করে ফেলেন শ্রোতারা, তেমনি কবিতা/ প্রবন্ধ/ গদ্যের অক্ষরে সাজিয়েছি তাঁকে। কী ভীষণ মায়ায় জড়িয়ে ধরেছেন তিনি। এই মায়াকে শব্দে প্রকাশ করা মুশকিল। তীব্র এক কুয়াশার চাদরের মতো ঘোর বিছিয়ে ধরেন অরুণেশ ওঁর প্রতিটি লেখায়। লেখার মাঝে অবশ করে দেন। লেখার শেষে নিজের মুখোমুখি হই। না, শুধু নিজের মুখোমুখি নয়। একটা সিঁড়ি বেয়ে নেমে যাই। হয়তো উঠে আসি। বিপরীতে দাঁড়িয়ে থাকেন তিনি।

তিনি শুধুই লেখক/ কবি হলে এমনটা হত না। এমনটা মানে অজস্ৰ প্রশ্ন ও উত্তরের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা ছায়াগাছ হতে পারতেন না। যার তলে শোকে দুঃখে ভালবাসায় ভর দুপুরেও দাঁড়িয়ে থাকা যায়। অরুণেশ আসলে সাধক। যে সাধনার সামান্যতম অংশের কাছাকাছি যেতেও অন্যরকম এক সাধনা প্রয়োজন। সৎ থেকে অনন্ত আলোর অক্ষরের কাছে যাওয়ার ইচ্ছে জাগিয়ে রাখার পাশাপাশি তাঁর দিকে যাওয়ার জন্য যোগ্য হয়ে ওঠা প্রয়োজন। একসময় আমার কাছে যা সব কবিতা ছিল, পরে কীভাবে পাল্টে গেল তার ইতিহাস, ভূগোল। মনে আছে, অরুণেশের কবিতা ঊনিশ বছর বয়সের সেই আমাকেও কী প্রবল ধাক্কা দিয়েছিল। কোনো এক আকর্ষণ বারবার টেনে নিয়ে গেছে। কবিতা কী কেন, এসব নিয়ে ভাবতে বসলে অরুণেশ পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। তখন একবারও মনে হয়নি, আমি কোনদিনও হওয়ার গাড়ি যাইনি। অরুণেশকে কাছে থেকে পাইনি। ভাস্কর চক্রবর্তী, প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত, মণীন্দ্র গুপ্ত, উৎপল কুমার বসুর পাশাপাশি অরুণেশ ঘোষ।।। আমাকে ডুবিয়ে নিয়েছেন। বারো সেলের সার্চ লাইট চোখ পেতে নিয়ে বাংলা কবিতার পায়ের কাছে এসে বসেছি। একজন সামান্য কবিতা পাঠক, অনুজ এক কবিতা প্রেমিকের কাছে অরুণেশ কী কেন কীভাবে, ভাবতে বসলে জলস্তর ওঠানামা করে। আমি অনুভব করি চোখ বুজিয়ে দেওয়া স্নেহের স্পর্শ।

আসলে জাপটে ধরা এক বাতাসের নাম অরুণেশ। স্পষ্ট ও প্রবল কথোপকথনের নাম অরুণেশ। সেই শব ও সন্ন্যাসী, গুহা মানুষের গান, কাল কবীরের দোহা, পশুরাও অন্তর্লীণ হাসে থেকে শুরু করে র‌্যাঁবোর মাতাল তরণী, কবিতার অন্ধকার যাত্রা।।। কিংবা জীবনানন্দ, সন্তদের রাত, জীবনের জার্নাল আর নাটক, বর্বরের তীর্থযাত্রা। আমি বারবার নত হয়েছি। জীবন জেনেছি, চিনেছি। চাঁদ তারা ফুল পাখির গমগমে শব্দেও প্রশ্নে স্থির হতে, উত্তরে স্থির হতে এমন সব সূক্ষ্ম অথচ জোড়ালো সময়ের স্বর, আগামীর স্বরও যে চুম্বকের মতো টেনে রাখে, মনে প্রাণে বিশ্বাস করেছি এমন সব পাঠে।
বারবার মনে হয়েছে, নাটক দেখতে দেখতে একদিন একটা নাটকের ভেতরে ঢুকে পড়লাম। যে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করছিলেন, সংলাপের শেষে একসময় সে মঞ্চের পেছনে চলে যায়। কিন্তু নাটক চলতে থাকে। আমি মঞ্চের নিচে দর্শকের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। সামনে থেকে একটা আলো। আলোর পরে দেয়াল। এরপর ছায়া। ব্যাকস্টেজ। সেখানে দাঁড়িয়ে সংলাপ বলছেন অভিনেতা। নাটক চলছে। মঞ্চে কেউ নেই। আবার আছেও। নাটক চলছে। বসে থাকা প্রত্যেক দর্শকের হাঁটু সরিয়ে, পায়ের পাতা মাড়িয়ে আমি প্রত্যেকটি চেয়ারের সামনে দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। এগিয়ে যাচ্ছি পেছনের দিকে। ঐ তো, ঐ তো অরুণেশ। কখনো অভিনেতার সংলাপ শুনে ভাবছি আমাকে ডাকছেন। পেছন থেকে ছুটে আসছি স্টেজের সামনে। এসে দাড়িয়ে পড়ছি। সংলাপের বিপরীতে ছুঁড়ে দিচ্ছি প্রশ্ন। উত্তর না পেয়ে এগিয়ে যাচ্ছি আবারও এক্সিট লেখা দরজাটির দিকে।
হঠাৎ ভাবছি, আমি তো অরুণেশকে দেখিনি।

আবারও প্রত্যেকদিন এই নাটকের রিহার্সেলেই এসে দাঁড়িয়েছি।
এখনও কবিতায় প্রতিটি শব্দ লেখার আগে ও পরে ফিসফিস করি, অরুণেশ আছেন। তোশকের গায়ে পোশাক জড়ানোর বাহানায় আক্ষেপের গায়ে অপেক্ষা জড়িয়ে রাখি। বিশ্বাস করি, একদিন দেখা হবে।
আর আমার জার্নালে লিখে রাখি খসড়া প্রতিবেদন।

এবং অরুণেশ…
অরুণেশের দিকে হেঁটে যেতে যেতে হয়তো পথ হারিয়ে ফেলি। চৌমাথায় উল্টে যাওয়া ট্রাফিক পোল। কাক এসে বসে। আমাদের মধ্যবর্তী দূরত্বের দিকে ঠেলে দিই উলবল। আমি তো হাওয়ার গাড়ি যাইনি কখনো। তবে কেন? গলি কেন গিলে নিতে থাকে? পৃষ্ঠা ও পাঠকের সংখ্যার মাঝে লাল বাতি জ্বলে ওঠে। দুপুরের খাওয়া সেরে মুখোমুখি বসি। কাটা ও কবিতা বেছে নরম জল গিলে নিই। প্রচন্ড রোদে গলে পড়তে থাকে বিজ্ঞাপনের ফ্লেক্স। নিচু হয়ে আসে। ছুঁয়ে দেয়। কবিতার দিকে হেঁটে যেতে যেতে হয়তো পথ হারিয়ে ফেলি।

না দেখা হওয়া ক্যাপ্টেন। শ্রদ্ধা আপনাকে।


ফেসবুক অ্যাকাউন্ট দিয়ে মন্তব্য করুন


নীলাদ্রি দেব

জন্ম 14 এপ্রিল 1995, কোচবিহারে। শারীরবিদ্যা নিয়ে স্নাতক স্তরে পড়বার সময় থেকেই সক্রিয় ভাবে কবিতাচর্চ, কবিতার পাশাপাশি ব্যক্তিগত গদ্য, নিবন্ধ নিয়মিত লিখছেন লি'ল ম্যাগ, ওয়েব ম্যাগ, দৈনিক পত্রপত্রিকায়। বর্তমানে শিক্ষকতার সাথে যুক্ত। আছেন 'বিরক্তিকর' সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীতে। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ- ধুলো ঝাড়ছি LIVE (2016), জেব্রাক্রসিং ও দ্বিতীয় জন্মের কবিতা (2019), এবং নাব্যতা (2019)। কবিতায় তীব্র বাঁচতে চান. ভালবাসেন লোকজীবন, প্রকৃতির কাছে গিয়ে দাঁড়াতে। কেন লেখেন? "প্রতিদিন এত মানুষের সাথে থাকার পরও, কেন জানি না, আমি ভীষণ একা। একা থাকা কেউ সবার আগে টার্গেট করে নিজেকে, আমিও। আমি খুঁড়ি, বাইরে থেকে হয়তো মনে হয় কবিতা লিখছি।"

0 Comments

মন্তব্য করুন

Avatar placeholder

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।