এক টুকরো ‘রোদ’– অরুণেশ ঘোষ

দেবাশিস মহন্ত on

২০০২-০৩ঃ

সালটা বেশ মাতাল বা বলা যেতে পারে উত্তাল। চারদিকে তরুণরাও উদ্দাম। বিশ্বাস হয় না।বালুরঘাটে সাধনামোড়ে ভাষাদিবস-এর অনুষ্ঠানে প্রায়  একশ তরুণ-তরুণী কবিতা পড়ছে। রীতিমতো চমকে দেওয়ার মতো ব্যাপার। সসমসাময়িক রাজনৈতিক দলও বোধহয় ঘাবড়ে গেছিল। বুদ্ধিজীবী মহলে কানাঘুষো শুরু হলও; তাহলে কী বালুরঘাট এখন কবিতার শহর। নাটকের কী হবে?

          বালুরঘাট কলেজে একসঙ্গে বেশ কয়েকটা লিটিলম্যাগ ছেলেপিলেদের হাতে হাতে ঘুরছে। এত কবিতা! এত ঝাকড়া চুলের তরুণ লিখছে! তরুণীরা কথা কইছে কবিতায়!বিস্ময় জাগে!তবে কী জোয়ার এল গাঙে?

এক টুকরো ‘রোদ’– অরুণেশ ঘোষঃ

          এমনই মাতাল সময়ে ত্রিমোহিনী-র কিছু যুবক মিটিং ডাকে। পত্রিকা হবে। কবিতা হবে। আমরা অনেকেই মিটিং-এ যোগ দিলাম। ব্লু-প্রিন্ট তৈরি হলও। প্রস্তাব হলও পত্রিকার নাম হবে- ‘রোদ’। আহা! মাত্রাহীন ‘রোদ’। তার লোগোও ছিল মাত্রাহীন।ঠিক হলও পত্রিকার উদ্বোধনে  আসবেন- কবি অরুণেশ ঘোষ, সঙ্গে কবি নিত্য মালাকার। শুরু হলও দিনগোনা…

           মনে আছে, মেরুন রঙের লোগোতে ছাপা ‘রোদ’ পত্রিকা আমি মালদা-র কোনও এক প্রেস থেকে আনতে গেছিলাম। তার গন্ধ আজও লেগে আছে।

জীবনানন্দ আর অরুণেশ-এর  সঙ্গে দেখাঃ

            পত্রিকা প্রকাশের দিন  খুব ভোরের দিকে কুচবিহার রকেট থেকে আমরা জীবনানন্দ, অরুণেশ ঘোষ আর নিত্য মালাকারকে রিকশা চাপিয়ে বালুরঘাট মিউনিসিপ্যালিটির ‘ক্ষণিকা’-য় নিয়ে আসি।বালুরঘাট তখন সাইকেল-রিকশার শহর।

         অরুণেশ’দা তাঁর সঙ্গে জীবনানন্দকেও নিয়ে এসেছিলেন। বলা ভালও জীবনানন্দে তখন তিনি লীন। কারণ, বেশ কিছুদিন আগে কচুপাতা রঙের মলাটে ছিমছাম একটা বই, তাতে ক্যালিগ্রাফি করে লেখা ‘জীবনানন্দ’ বেরিয়েছে। ইতিমধ্যে ঐ বই আমি পড়ে ফেলেছি কয়েকবার। এমন লেখা, যে দু-পাতা পড়তেই থমকে থাকি অনেকক্ষণ। মন ভরে থাকে বিষণ্ণতায়…

         সেই তাঁকে যখন পেয়েছি এত কাছে আর কী ছাড়া যায়। তার আগে তার কবিতা পড়েছি অল্প-বিস্তর। শুনেছি হাংরি জেনারেশনের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ কথা। উৎসুক ছিলাম কখন তাঁর সঙ্গে একটু কথা হবে। সাহস পাই না।স্নান করে পরিপাটি হয়ে বসলেন। আহা!কী শান্ত এক মানুষ। চোখদুটো গভীর কিন্তু এতটুকু অহং নেই। কী সাধারণ কাছের এক মানুষ, কবি অরুণেশ…

           আমি তাঁকে ভয়ে ভয়ে বললাম– আপনার ‘জীবনানন্দ’ বইটা পড়েছি। পড়ে মনে হয়েছে যখন আপনি বইটা লিখেছেন তখন হাতের কাছে কোনও রেফারেন্স বই রাখেননি।সহজ-সরল স্রোতের ধারার মতো লেখা যেন বয়ে চলেছে। মনে হচ্ছে যেন- জীবনানন্দের সঙ্গে  আপনি নিজেই ঘুরে বেড়াচ্ছেন আর লিখছেন তাঁর জীবন… তাঁর যাপন…দুঃখ…ব্যথা। অরুণেশ ‘দা আমাকে জড়িয়ে ধরলেন,বললেন– তুমি কী করে জানলে, যে লেখার সময় হাতের কাছে আমি কোনও রকম রেফারেন্স বই রাখিনি। যা মনে হয়েছে আমার উপলব্ধিতে…আমার অনুভূতিতে…আমি তাই লিখেছি। বললাম– এত ঝরঝরে গদ্য যা কোথাও আটকাচ্ছে না, তা তো একরকম ঘোরের মধ্যেই লেখা সম্ভব। সেই সুঠাম ভাওয়াইয়া দেশের লোক আমার পিঠ চাপড়ে দিয়েছিলেন।তাঁর জীবনানন্দকে নিয়ে লেখা ‘জীবনানন্দ’ বইটা আমার পড়া সেরা জীবনানন্দ।

পত্রিকা প্রকাশঃ

           তখন ভাবতাম আমি যা লিখছি তাহাই শ্রেষ্ঠ। সবাই তা শুনে হাততালি দেবে।দিয়েছিল হাততালি অনেকে, তবে অরুণেশ’দা যখন কবিতা  পড়লেন, তাঁর ক্লাস ছিল আলাদা। কি তাঁর অনুভব… আর গভীরতা…বোধ। সবাই যেন ডুব দিয়েছে নিধুঁয়া পাথারে…।ত্রিমোহিনী লাইব্রেরী-হলে মুহূর্মুহূ উঠছে হাততালির শব্দ।আর ঠিক তারপরেই কবিতা পড়েছিলেন — ‘ছুঁতোরের স্বগতোক্তি’-র লেখক নিত্য মালাকার। অসাধারণ তাঁর কবিতা মুগ্ধ করে রেখেছিল শ্রোতাদের। ঐ পুরো অনুষ্ঠানটি একটা ক্যাসেটে রেকর্ড করা হয়েছিল। আমি উদ্যেগক্তাদের বলেছিলাম কপি নেব, পরে আর নেওয়া হয়নি।

সুখ-দুঃখের সাথিঃ

          একটা মজার কথা বলি।পত্রিকা প্রকাশ অনুষ্ঠান থেকে ফিরে, ‘ক্ষণিকা’-য় আড্ডা দিতে দিতে অরুণেশ’দা বেশ খানিকটা পানাহার করে ফেলেছিলেন। সেই ভাদ্র মাসের গরমে আমরা অনেকে ধরে তাঁকে ট্যাপকলের তলায় বসিয়ে রেখেছিলাম অনেকক্ষণ।তারপর আবার কবিতা নিয়ে আড্ডা চলেছিল অনেকক্ষণ।

          এর কিছু দিন পর ‘উত্তর দক্ষিণ ‘ পত্রিকায় অরুণেশ’দার ধারাবাহিক গদ্য  ‘আমার কবিতাযাত্রা’ প্রকাশ পেতে শুরু করে। সেই সূত্রে তাঁকে অনেকবার ফোন করেছি ল্যান্ড-লাইন নম্বরে। যখন অসুস্থ থাকতেন, বলতেন লেখা দিতে দেরি হবে।তবুও আমরা তাঁর লেখার অপেক্ষায় থাকতাম।

          খবরের কাগজে যেদিন  পড়ি– স্নান করতে গিয়ে পুকুরঘাটে পড়ে ছিলেন, বিশ্বাস হয়নি।এমন একজন সুঠাম-সুপুরুষ-হ্যান্ডসাম মানুষ; তাঁর এমনটা হতে পারে না।তবুও মনকে বুঝিয়েছি,আস্তে আস্তে বিশ্বাস করিয়েছি।

          কবি অরুণেশ ঘোষ এমন একজন মানুষ যিনি কোচবিহারের ঘুঘুমারি থেকে বাংলা কবিতাকে শাসন করতেন। যতদিন বাংলা কবিতা থাকবে, তাঁর লেখা নতুনভাবে বারে বারে উদ্ভাসিত হবে।আগামী প্রজন্ম কে ফিরে আসতে হবে তাঁর লেখার কাছে। জোনাকিপোকা হয়ে তাঁর কবিতা বেরিয়ে পড়বে সন্ধেবেলা…

          অরুণেশ’দা…হ্যাটস অফ…বস।


ফেসবুক অ্যাকাউন্ট দিয়ে মন্তব্য করুন


দেবাশিস মহন্ত

জন্ম- ১ জানুয়ারি, ১৯৭৯। পশ্চিমবঙ্গ-এর দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার বালুরঘাটের কাছে একটি প্রান্তিক গ্রাম তিওড়-এ। প্রথম লেখা প্রকাশিত হয় স্কুল ম্যাগাজিনে। সিরিয়াসলি লেখালেখির শুরু শূন্য দশকের শুরুতে। বিভিন্ন লিটিল ম্যাগাজিনে। ২০০২ সালে প্রকাশিত হয় প্রথম কবিতার বই – ‘আলো নিভে গেলে’। তিনি বলেন – “ কবিতাই একমাত্র সাধনা। কবিতাই শিহরিত করে জানিয়ে দেয় এই চরাচরকে, চারিদিকে ঘটে যাওয়া ঘটনাকে। এখনও লিখে চলেছি নিরন্তর। যা লিখতে চাই তা আর পারলাম কই। শুধু অতৃপ্তি …অতৃপ্তি … অতৃপ্তি …। শুধু অপেক্ষা সেই নিরাকারের। তাকে আকার দেব বলে পারে বসে আছি একা। বিশ্বাস করি - কবিতাতেই একমাত্র মুক্তি ...।“ বর্তমানে স্বাস্থ্যদপ্তরে কর্মরত।

0 Comments

মন্তব্য করুন

Avatar placeholder

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।