নাগরিক রুচির ভরসা ফিরিয়ে দিক বিকল্প চাষাবাদ: বাংলা ব্যান্ড

শান্তনু মিশ্র on

অন্ধকারের তলপেট থেকে উঠে আসে বিকল্প শব্দ… সুর… রক, মেটাল ইত্যাদি ইত্যাদি… যাবতীয় খোঁড়াখুঁড়ি শেষে জন্ম নেয় বাংলা ব্যান্ড। শহর মফস্বল নগর মহানগর অপেক্ষায় থাকে বিকল্প শ্লোগানের।
আজও থাকে? নাকি ছিল একটা সময়?
আচ্ছা এত এত গানের দল থাকতে আরও নতুন দলের জন্ম হয় কেন?
এত এত ব্যান্ড বা গানের দল কেন? তারা কী বলতে চায়? কেন চায়? তাদের অবস্থান কী?
জয় গোস্বামী জানেন। তাই তিনি লেখেন, “অস্ত্র ফ্যালো অস্ত্র রাখো গানের দুটি পায়ে”। Gun এর চেয়েও গান যে অনেক বেশী ক্ষমতা রাখে। হয়তো এই কারণেই বিকল্প চর্চার কথা মাথায় রেখে যথেষ্ট যত্নে গড়ে ওঠে একেকটি বাংলা ব্যান্ড। বেশ ঝাঁঝালো নাম নিয়ে শুরু হয় তাদের জার্নি।
অল্পবিস্তর নিজেদের লেখা গানের ভার বয়ে বেড়ায় দলগুলি। আজই জানলাম সেগুলির নাম O.C.। না অফিসার চয়েস নয়। Own Composition।
যাই হোক, তারপর একদিন মানে কোনও একদিন তারা আর বইতে অস্বীকার করে নিজেদেরকেই। নতুন লেখা, নতুন সুর আর হয়ে ওঠে না। তবে গান থেমে থাকে না। নিজেদের পুরোনো লেখা, সুর দেওয়া গানগুলির পাশাপাশি বানিজ্যিকভাবে সফল হিন্দি অথবা বাংলা গানই তখন হয়ে ওঠে ব্যান্ডের মূলধন।
এটা বোধ হয় খুব পরিচিত ঘিষাপিটা একটা ছবি। যাই হোক, প্রতিষ্ঠানের থাবা নিশ্চিন্তে হজম করা দলগুলির উদ্দেশ্য বদলে যায়। অলটারনেটিভ মিউজিক, গানের বিকল্প বিন্যাস ইত্যাদি নিয়ে সময় নষ্ট করাটাও তাদের রুচিতে বাধে। “আমরা বাংলা ব্যান্ড” এই পরিচয়ে শুরু হওয়া জার্নি শেষ হয় অর্কেষ্ট্রায়। সিন্ধু থেকে কী করে যেন বিন্দুতে এসে ঠেকে। অথচ হওয়ার কথা উল্টোটা।
আমরা যারা মৌসুমী ভৌমিক শুনি। কবীর সুমন জানি। রূপম ইসলামের মাথা ঝাঁকানোকেই ব্যান্ডের চরিত্র হিসেবে ধরে নিই না। পরিবর্তে তার শব্দে কাব্য খুঁজে পাই, মুগ্ধ হই… তারা বাংলা ব্যান্ডের নামে অর্কেষ্ট্রা হজম করবো কেন? এ তো মিথ্যাচার। এ তো চক্রব্যূহের বন্দীদশা কিংবা চোরাবালির গ্রাস।
আমরা তো জানি, বলতে হলে নতুন কথা চেনা পথের বাইরে চলতে হয়। লেখার ক্ষমতা আছে, ক্ষমতা আছে সুর দেয়ারও… তা হলে কেন অকারণ তেলা মাথায় তেল দেওয়া? আসলে “ভাবছ লোকে দিচ্ছে তোমায় হাততালিটাই”, তাই তো?
গানের শ্রোতা কিন্তু কম নয়। একা একা গুণগুণ করেন না, এমন একটি মানুষও হয়তো খুঁজে পাওয়া মুশকিল। বাঙালির প্রি-ওয়েডিং শৌখিনতায় বাণিজ্য সফল হিন্দি গানের অলটারনেটিভ হয়ে উঠবে না কেন এই বাংলা ব্যান্ড? দশমীর ভাসানে ডিজে-র পরিবর্তে বাংলা ব্যান্ড বাঙালীর শ্রেষ্ঠ উৎসবকে সঙ্গ দেবে না কেন?
হাতে হাত রেখে শেষ অবধি হেঁটে যাওয়ার স্পর্ধা থাকবে না কেন?
আচ্ছা, এমনটা হচ্ছে না কেন! হল না কেন! বাংলা ব্যান্ডের সুসময় কি পেরিয়ে গেল তবে? তবে কি এই প্রশ্ন করার সময় চলে এল- “তুমি কি মরীচিকা না ধ্রুবতারা?”
অথচ যে শব্দবন্ধগুলি অতিরিক্ত হুল্লোড়ে দখল করছে মস্তিষ্ক, সেগুলিকেই বয়ে বেড়াচ্ছে বাংলা নামের ব্যান্ডগুলি। যেন একটি ব্যান্ডের কাঁধেই এ দায়িত্ব বর্তায়। ইয়েস স্যার বলে যেন এ-আদেশ পালন করার কথা তাদেরই।
এতে কিছু শো জুটে যাচ্ছে ঠিকই। কিন্তু সন্দেহজনক হচ্ছে তাদের অবস্থান। স্রোতের সামনে নতজানু এ দলগুলি হয়তো এ-সমস্ত গেয়ে টেয়ে হাততালি কুড়িয়ে নিচ্ছে ঠিকই, কিছু পয়সাও হয়তো… কিন্তু কতদিন?
একটা তথ্য মনে পড়ছে। কোথায় যেন পড়েছিলাম…
বলকান পর্বতমালার কোলে উত্তর বুলগেরিয়ার এক শহর গ্যাব্রোভো। পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ইয়ান্ত্রা নদী। বুলগেরিয়ার দীর্ঘতম শহরও এই গ্যাব্রোভো। বিশ্বব্যাপী এর খ্যাতি হলো রসিকতা আর স্যাটায়ারের আন্তর্জাতিক রাজধানী হিসেবে। তো সেখানকার প্রচলিত একটি রসিকতা অনেকটা এইরকম-
“গ্যাব্রোভোবাসীরা গাধাদের সবুজ কাচের চশমা পড়ায়। যেন, গাধাগুলো ঘাস মনে করে খড়ই খেয়ে ফেলে।”
বিষয়টা হল,
বাংলা ব্যান্ডের শ্রোতা কিন্তু সবুজ চশমা পড়া সেই গাধাটি নন, যিনি বারবার খড়ই খেতে থাকবেন ঘাস ভেবে।
চাই, নিজেদের গান নিয়ে, সুর নিয়ে হৈ হৈ করে বদলে যাক বাংলা গানের মানচিত্র। জয় হোক বিকল্প চাষাবাদের। বাংলা ব্যান্ড অর্কেষ্ট্রার অভাবপূরণ থেকে বিরত থাক… অন্তত আমার শহরের।

ফেসবুক অ্যাকাউন্ট দিয়ে মন্তব্য করুন


শান্তনু মিশ্র

জন্ম: ২৬ ডিসেম্বর, ১৯৮৮,  বাড়ি মালদা। তবে আপাতত ঠিকানা রায়গঞ্জ। কবিতা, গদ্যের পাশাপাশি আগ্রহ রয়েছে থিয়েটার চর্চায়।
সম্পাদিত পত্রিকা: বাউন্ডুলে, চড়াম চড়াম ও অভিসন্ধি ,
প্রকাশিত বই:
স্রেফ একটা ডেটলগন্ধ (কবিতা)
এবং
আবছা আলোর উল্টোপিঠ (নাটক)

0 Comments

মন্তব্য করুন

Avatar placeholder

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।