ওড়না

পার্থ তালুকদার on

— শোন সুশীলা, তুই তোর সাহেবের সামনে কাপড়চোপড় ঠিক কইরা আসবি। আমি খেয়াল করছি তার সামনে আসলেই তোর শরীর ঢলঢল করে। টলটল করে। তোর ওড়নাটা কইলাম সাবধানে রাখিস।
ঠিক আছে ?
— জ্বী আপা।
— আপা ! কিসের আপা ? কার আপা ? তুই আমাকে ম্যাডাম বলে ডাকবি। আরেকটা কথা শোন। তুই ওর ধারেকাছে ভিড়বি না। পুরুষ মানুষকে আমি বিশ্বাস করিনা।
— ম্যাডাম, একটা কথা কইমু ?
— হুম, ক।
— তাইলে কি আপনি সাহেবকে বিশ্বাস না কইরাই এতোবছর ধইরা উনার সাথে সংসার করতাছেন !
— যা। এখান থেকে যা। খুব বেশি কথা বলিস তুই। খুব বেশি পাকনা হইছিস।

সুশীলা তার রুমে এসে ছেড়া কাঁথাটা গায়ে মুড়িয়ে শুয়ে পড়ে। তার ঘুম আসছে না। এপিট-ওপিট করছে। পেটের তাগিদে গত একমাস ধরে এখানে আছে সে। আজ প্রথম সে বাড়ির মহিলার কাছ থেকে এমন অকথ্য কথা শুনলো।

সুশীলার মাও একদিন বলেছিল- মা রে বড় হইছিস, গায়ের কাপড়চোপড় ঠিকঠাক কইরা রাখিস। ওড়নাটা যেন এদিক সেদিক না হয়। মাইয়া মানুষ সুন্দর হয় চরিত্রে। চরিত্রে একবার কালির দাগ লাইগা গেলে মুছা যায়না রে মা। চরিত্রই নারীর অলংকার, অহংকার। চরিত্রবান মানুষের থাকে মনের জোর। পোষাক বাহ্যিক সৌন্দর্যের সহায়ক আবরণ।

সুশীলার মা তখন আকাশপানে তাকিয়ে আফসোস করে বলে, হায় ভগবান, গরীবের মাইয়াডারে তুমি এত সুন্দর কইরা এই দুনিয়ায় ক্যান পাঠাইলে ! ক্যান পাঠাইলে ভগবান!

এই শুনো তুমি, সুশীলার দিকে এমন টগবগিয়ে তাকানোর দরকার নাই। কাজের মেয়ে যত সুন্দরই হোক সে কাজের মেয়েই। তার প্রতি এতো গদগদ হওয়ার দরকার কি !
বুঝতে পারছো ? মনে থাকবে তোমার ?

শংকর তার স্ত্রীর কথা শেষ করতে না দিয়ে বলে- ঘুমাও তো এবার। যত্তসব আজব চিন্তা তোমার।

সকাল বেলা দরজা খুলতেই শংকরের সামনে পড়ে সুশীলা। সুশীলার শরীরে চোখ পড়তেই রাতের কথোপকথন মনে পড়ে তার। আহ… সত্যিই তো ! সুশীলার শারীরের ভাঁজে ভাঁজে কি যেন লুকিয়ে আছে। কি লাবণ্য ! কি দীপ্ত ! আগে তো এসব নজরে আসেনি ! তবে কি স্ত্রীর কথায় তার ঘুমন্ত চোখ জেগে উঠেছে। লুকায়িত পশু কাটুই পোকার মতো মাটি ভেদ করে উঁকি দিচ্ছে।

ধুর.. কী সব ছাইপাশ মাথায় ঘুরঘুর করছে।

সম্বিৎ ফিরে পায় শংকর। চোখ ঘুরিয়ে পাশকাটিয়ে চলে যায় সে।

রাতে আবার শুরু হয় যুগল দম্পতীর কথা কাটাকাটি। কথায় কথায় হাতাহাতি। অকথা-কুকথা। সুশীলার কানে তীরের মতো বিধে মহিলার একটি বাক্য – তাইলে বিয়ে করে ফেলো সুশীলাকে ! বিয়ে করে ফেলো !
শংকর আরো উচ্চবাক্যে বলে – তোর চেয়ে সুশীলা অনেক ভালো, অনেক সুন্দর। প্রয়োজনে ওরে বিয়ে করেই ফেলবো !

সুশীলার ওড়না, জামাকাপড়, শেলাই করা ছেড়া ব্যাগ, অর্ধব্যবহৃত লিপস্টিক, গুটিকয়েক কাচের চুড়ি, কয়েকটা খুচরো আধুলি, সব এলোমেলো ভাবে পড়ে আছে রুমের মেঝেতে । শুধু প্রাণহীন এসব বস্তুর মালিকের খোঁজ নেই !

সুশীলা এক টুকরো আলোর আশায় তিমির রাতকে ছিন্নভিন্ন করে পালিয়ে যাচ্ছে। শনশন করে ছুটে চলছে সে !

কোথায় পালিয়ে যাচ্ছে সুশীলা ? কোথায় মিলবে তার স্বপ্নের আবাস ? কোথায় গিয়ে ঠেকবে তার ক্লান্ত-রুগ্ন দুটো পা।
জানা নেই। কারো জানা নেই। না সুশীলা, না এই সমাজের !

ফেসবুক অ্যাকাউন্ট দিয়ে মন্তব্য করুন


পার্থ তালুকদার

পেশায় ব্যাংক কর্মকর্তা । জন্মঃ  ৫ই নভেম্বর ১৯৮১ইং। সুনামগঞ্জ, বাংলাদেশ । পড়াশুনাঃ বি এস সি (সম্মান), এম এস, বিষয় - গণিত, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। আগ্রহঃ লোকসংস্কৃতি সংগ্রহ ও গবেষণা। প্রকাশিত গ্রন্থঃ ঐতিহ্যের ধামাইল গান (গবেষণা,২০১৫), দীন শরত বলে (জীবনী ও গবেষণা, ২০১৭),খোঁয়াড় (গল্পগ্রন্থ,২০১৮)।

0 Comments

মন্তব্য করুন

Avatar placeholder

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।