নূপুর
ডাইনিং টেবিলের ওপর ফোনটা একবার রিং হয়ে থেমে গেল কিছুক্ষণ পর আবার এইভাবে প্রায় ছয়বার ফোনটা রিং হয়ে গেল। পাশের ঘর থেকে মহুয়াদেবী বলে উঠলেন
– কি হলো নুপুর কোনটা তখন থেকে বেজে যাচ্ছে ধরছিস না কেন ?
– ও কিছু নয় মা মিতু হয়ত ফোন করেছে আমিতো রান্নাঘরে তাই ফোনটা ধরতে পারিনি।
– নিশ্চয়ই খুব দরকার নইলে এত বার ফোন করবে কেন ?
– না মনে হয় সেরকম কিছু নয়। কাল অষ্টমী সকালে ওরা সবাই মিলে বেরোনোর প্ল্যান করেছে তাই হয়ত ফোন করছে। গতবার যাইনি না ওদের সাথে তাই এবার খুব জেদ করছে। ফোন ধরলেই আবার ঘ্যান ঘ্যান করবে তাই ………|
– তাই কি ? তাই ফোনটা ধরছিস না তাই তো ? যত্তসব।
মলয় বাবু – আহা ওর ফোন ধরতে ইচ্ছে করছে না ধরে নি তাতে তুমি অত বিরক্ত হচ্ছ কেন ?
– তুমি থাম তো। ইচ্ছে করছে না তো কি ? ফোনটা ধরে বলে দিলেই তো হয়।
নূপুর মাথাটা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে।
মলয় বাবু -দে মা খাবার হয়ে গেছে খেতে দিয়ে দে। চল মহুয়া খেতে চল।
- তুমি যাও।
- আহা অত রাগ করলে চলে !
- না রাগ করব কেন। ও যাক না ঘুরে ফিরে আনন্দ করে আসুক।
- মা আমি কিন্তু যেতে চাই নি। ওরা জোর করছে বার বার , না করা সত্বেও শুনছে না বলে আমি ওদের কারো ফোনই ধরছি না। আজ তিন বছর হল তুমিও যেমন মা দুর্গার মুখ দেখনি আমিও কিন্তু দেখিনি।
- তা যাও না এবার বন্ধুদের সঙ্গে মা দুর্গার মুখ দেখে এস গে যাও।
- আহ মহুয়া এবার কিন্তু বেশি হচ্ছে। যা মা তুই খেতে দে মার কথায় রাগ করিস না।
রাতের ডিনার শেষ করে নুপুর নিজের ঘরে গেল ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে সমীরের চারটা মিসড কল আর নিতুর দুটো। উফ ওরা কেন কিছুতেই বুঝে না আমি ওদের সঙ্গে পুজোতে বের হতে পারব না পুজো যে আমার জন্য না। ভাগ্যিস মা ইংরেজি পড়তে পারে না নইলে সমীরের নাম দেখলে তো আর রক্ষে থাকত না। ওরা সকলেই নিজেদের প্রেমিকদের সাথে বের হবে আমি ওখানে গিয়ে কি করবো। আর ওই সমীর দাও কিছুদিন ধরে বড্ড জ্বালাচ্ছে এরকম চলতে থাকলে কলেজ ছেড়ে দিতে হবে আমাকে। এদিকে মলয় বাবু ঘরে গিয়ে মহুয়াদেবী কে বললেন
– কেন মেয়েটাকে এভাবে বলো তুমি?
– আচ্ছা তুমি যে পূজোতে শাড়ি টা দিয়েছে কেন পড়ে না ও? সব সময় মনমরা কেন একটু হাসি খুশি থাকতে পারে না? যেন আমি ওকে কত কষ্ট দেই|
– কষ্ট দাও না ঠিকই কিন্তু কথাগুলো ওভাবে না বলাই ভালো|
পরেরদিন অষ্টমী পাড়ার মণ্ডপ থেকে রবীন্দ্র সংগীতের সুর ভেসে আসছে, স্নান করে নুপুর বারান্দায় দাঁড়িয়ে ওই গানগুলো শুনতে শুনতে কোথায় হারিয়ে যায়। পেছনে এসে মহুয়াদেবী ডাকলে তার হুঁশ আসে নুপুর পুজো করতে যায়। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে এগারোটা বাজে মনে মনে ভাবে ওরা সবাই হয়তো এতক্ষণ বেরিয়েছে।সাড়ে দশটায় তো সবার দেখা করার কথা ছিল খুব আনন্দ করবে ওরা| পরক্ষনেই নিজেকে বোঝায়” ওসব আমার জন্য নয়” ফোনে হোয়াটসঅ্যাপ এর বিপ ফোনটা খুলে দেখে ১৬৭ টা মেসেজ পেন্ডিং| ইচ্ছে করলোনা নুপুরের মেসেজগুলো দেখতে।অদেখাই থেকে গেল সব।
হঠাৎ কলিংবেলের আওয়াজ দরজা খুলতেই হুড়হুড় করে নুপুরের বান্ধবীরা একেবারে বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়ে|
- কিরে নূপুর কোথায় তুই? কাকু কাকিমা আমরা নূপুরের সঙ্গে কলেজে পড়ি| এর আগেও অনেকবার তোমাদের বাড়িতে আসতে চেয়েছি কিন্তু আসা হয়নি।নুপুর কোথায় গো? গতবার ও আমাদের সাথে বের হয়নি| এবার বেঁধে নিয়ে যাব|
মলয় বাবু – তোমরা বস না নুপুর পুজো করছে এক্ষুনি আসবে| তোমরা কি খাবে বলো|
– কিছু খাব না কাকু আমরা অঞ্জলি দেবো গো।
ওপর থেকে নুপুর পুজো করে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে ওদের দেখে থমকে দাঁড়িয়ে যায়। নুপুরের ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া মুখ দেখে পরিস্থিতি সামলে নিতে মলয় বাবু বলেন
- ওরা তোর জন্য অপেক্ষা করছে। তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে নে। অঞ্জলি দেবার সময় পেরিয়ে যাবে|
নূপুর চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। একবার শুধু মহুয়া দেবীর দিকে তাকিয়ে মাথাটা নামিয়ে নেয়|
মহুয়া দেবী- যা না ওরা যখন এতবার করে বলছে।
- না মা থাক।
- কেন রে ?এই তোর এক দোষ| আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলেন মহুয়া দেবী মলয় বাবুর গলার আওয়াজে চুপ হয়ে গেলেন।
- চল না নুপুর প্লিজ!
- আমি যাব না রে তোরা আমাকে জোর করিস না|
- বাবা যে শাড়িটা এনেছে ওটা পড়ে যা একটু ঘুরে আয়। বাবার ভাল লাগবে।
- তোমার শরীর ভালো না এখনো রান্না হয়নি কি করে যাই।
- ও আমি সামলে নেব তুই যা।
- নূপুর আমরা কিন্তু অঞ্জলি দিয়ে সবাই একসঙ্গে খেয়ে বাড়ি ফিরব।
- ওরে বাবা না না। তোরা যাস আমি এক ঘন্টার মধ্যে ফিরে আসবো।
মলয় বাবু দুটো পাঁচশ টাকার নোট বের করে নুপুরের হাতে দিয়ে বললেন এই নে তুইও খেয়ে ফিরবি আমি আর তোর মা ঠিক চালিয়ে নেব| এবার তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে নে।
- কিন্তু বাবা।
- কোন কিন্তু নয়। সবকিছুর একটা শেষ আছে। অতীতকে পেছনে ফেলে সামনে তাকা নুপুর। অতীতকে ধরে সারাজীবন বেঁচে থাকা যায়না।
- কিন্তু তোমরাও তো……।
- চুপ কর আর কথা বাড়াস না|
নূপুর বন্ধুদের নিয়ে নিজের ঘরে গেল। মহুয়া দেবী শাড়ির প্যাকেটটা হাতে করে নুপুরের বিছানার উপর রেখে বলল , “ শাড়িটা পড়ে নে।বাবা এনে দিলো ছুঁয়েও দেখিস নি| এবার পড়ে নে|” নূপুর দেখল একটা হলুদ রঙের জামদানি। নুপুর শাড়িটা প্যাকেট থেকে বের করে বুকের কাছে ধরে আর কান্না আটকাতে পারল না। দু গাল বেয়ে জলের ধারা নামতে লাগলো। নুপুরের বন্ধুরা অবাক| তাদের মধ্যে একজনের চোখ যায় নুপুরের ঘরের দেওয়ালে টাঙানো দুটো ফটো ফ্রেম এর দিকে। একি এযে নুপুর! বধূর সাজে? হাতে কুনিটা দিয়ে পাশে বসে থাকা রুমিকে গুতো দিয়ে চোখের ইশারায় ছবিটার দিকে দেখায়। নূপুর শারিটা নিয়ে পাশের ঘরে গেল| মহুয়া দেবী সরবত নিয়ে এসেছেন ওদের জন্য। ঘরে ঢুকতে গিয়ে তার কানে ওদের কথাগুলি এলো। ওরা বলছে,” কিরে এটা তো নুপুরের ছবি তবে কি ও বিবাহিত ? কিন্তু পাশে যে ছেলেটি ছবিতে মালা দেওয়া তাকেই তো মনে হচ্ছে নুপুরের সঙ্গে ওই ছবিতে কি ব্যাপার বলতো ?
মহুয়া দেবী – হ্যাঁ ঠিকই ধরেছ নূপুর বিবাহিত। ও আমার একমাত্র ছেলের স্ত্রী।
- মানে তাহলে আপনার ছেলে…।
- ও আর নেই । ও আমাদের ছেড়ে চলে গেছে।বলেই ঢুক্রে কেঁদে উঠলেন মহুয়া দেবী।
নুপুর পাশের ঘর থেকে শাড়ি পড়ে এসে মহুয়া দেবীকে কাঁদতে দেখে খুব সংকোচের মধ্যে পড়ে যায় মহুয়া দেবী নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন,” যাও তোমরা বেরিয়ে পড়ো দেখো অঞ্জলীর সময় হয়তো শেষ হয়ে গেল।”
থমথমে মুখ করে সকলে বেরিয়ে পড়লো। সারা রাস্তা কেউ সাহস করে ওকে কিছু জিজ্ঞেস করতে পারলো না। অঞ্জলি দিয়ে ওরা রেস্টুরেন্টে খেতে গেলো খাবার অর্ডার করে সকলে বসে আছে
নুপুর বললো- মা তোদের সবটা জানিয়েছেন। তোরা আমাকে ক্ষমা করিস। আমি তোদের কাছে সত্যটা গোপন রেখে ছিলাম। আসলে ওনারা আমার শ্বশুর-শ্বাশুড়ি।
তিন বছর আগে আমার বিয়ে হয় সঞ্জীবের সাথে। ও তখন একটা বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করতো। উচ্চ মাধ্যমিকের পরে বাবা মার অমতে বিয়ে করেছিলাম সঞ্জীবকে। আমার বাবা মা আমার সঙ্গে আর কোন সম্পর্ক রাখেন নি। ভালোই ছিলাম জানিস প্রথমদিকে আমার শাশুড়ি মার আমাকে একটু অপছন্দ থাকলেও পরের দিকে উনি মেনে নিয়েছিলেন| আমার শশুর মশাই খুব ভালো মানুষ। উনি স্কুল টিচার ছিলেন। বিয়ের প্রথমবার পুজো প্ল্যান করেছিলাম অনেক পুজোর বাজার করব। তাই সঞ্জীবকে বলেছিলাম তাড়াতাড়ি ফিরতে। অফিস থেকে হাফ ডে নিয়ে বাড়ি আসছিল| আমিও রেডি হয়ে বসে ছিলাম। অফিস থেকে বের হবার সময় ও আমাকে ফোন করে । আসতে অনেক দেরী হচ্ছে দেখে আমি ফোন করতে থাকি ওকে। দু-তিনবার ফোনটা বেজে বেজে কেটে যায়। কিছুক্ষণ পর আবার ফোন করি। এবার ফোনের ওপার থেকে একটা অচেনা কণ্ঠস্বর
- হ্যালো শুনছেন
- হ্যাঁ কিন্তু আপনি কে ? ফোনটা সঞ্জীবকে দিন তো।
- উনাকে তো দেওয়া যাবে না ওনার অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। আপনারা হাসপাতালে চলে আসুন।
বিশ্বাস কর আমার কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না| ফোনটা হাত থেকে পড়ে গেল। বাবাকে চিৎকার করে ডাকলাম। বাবার সঙ্গে গেলাম হাসপাতালে । গিয়ে দেখি সব শেষ । রাস্তা পার হবার সময় একটা লরির ধাক্কায় সঞ্জীবের ওখানেই মৃত্যু হয়েছে।
চোখের জল বাঁধ মানেনা নুপূরের। বলে চলে
পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যায় জানিস। আজও চোখের সামনে ভেসে ওঠে সঞ্জীবের মুখটা| সাদা কাপড়ে ঢাকা সঞ্জীব । বাবা মায়ের একমাত্র অবলম্বন । দিশেহারা তখন আমরা তিনটে মানুষ। বাবা আমাকে আগলে রেখেছেন নিজের মেয়ের মত। আমার শাশুড়ি মা ও মানুষটা খারাপ নন। কিন্তু একটু মুডি এই খুব ভালো আবার কিছুক্ষণ পরেই রেগে যান। বুঝি, আমিও যেমন আমার স্বামীকে হারিয়েছি উনি উনার একমাত্র সন্তানকে হারিয়েছেন। আমি কিছু মনে করি না ওনার কথায়। সারাদিন কাঁদতাম জানিস। খাওয়া-দাওয়া কিছুই করতে ভালো লাগতো না । কারো সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগতো না ।কতদিন যে বাড়ি থেকে বের হইনি। বাবা আমার সাদা শাড়ি পরা সহ্য করতে পারতেন না। তাই হালকা রঙের শাড়ি পড়ি । তোরাও অনেকবার বলেছিস আমি সব সময় কেন এত হালকা রঙের শাড়ি পড়ি।এইজন্যই পড়ি জানিস| আমার জীবন থেকে যে রঙ চলে গেছে রে। আজও বুঝি না কেন এমন হলো ।সঞ্জীবের চলে যাবার পর থেকে পুজোতে আর কোন আনন্দই আমাদের নেই। শুধু পুজো কেন কোনো আনন্দ অনুষ্ঠানে আমরা যাইনা। বাবা আমাকে প্রতিবারই পূজোতে শাড়ি দেন। আমি পড়িনা । পুজোর বাজার করা সহ্য করতে পারি না। এবার দেখছি বাবা এই হলুদ জামদানিটা এনেছেন। এ রঙ সঞ্জিবের খুব পছন্দের বাবা সেটা জানতেন।আসলে আমার মধ্যে ওনারা ওদের সন্তানকে দেখতে চান। সঞ্জীব চাইতো আমি পড়াশুনা করি। পড়াশোনাতে ভালো ছিলাম বরাবর। আসলে হঠাৎ করে বিয়ে করে নেওয়ায় পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেল সেটা ও মেনে নিতে পারত না। বাবা মাকে বলেছিল আমাকে কলেজে ভর্তি করে দেবে| ও চাইত আমিও বাবার মতো স্কুল টিচার হব। বাবা আমাকে কলেজে ভর্তি করতে চাইলেও আমি কিন্তু চাইনি। কিন্তু পরে বাবার কথা ফেলতে না পেরে ভর্তি হয়ে গেলাম। আর তারপর তো তোরা সব জানিস। পেছনে কখন সমীর, রিজু,তাপস এসে দাড়িয়েছে ওরা কেউ খেয়াল করেনি। খাবারগুলো টেবিলে সার্ভ করা হয়ে গেছে। নুপুরের কথা শুনে ওর বান্ধবীদের চোখের জল । এত কষ্ট বুকে চেপে রেখে মেয়েটা সব সময় হাসি মুখে থাকে কি করে?
সমীর – নূপুর তুমি আমায় ক্ষমা করো আমি এসব জানতাম না।
- তুমি কেন কেউই জানতো না। আমিতো কাউকে কিছু বলিনি। তাই প্লিজ সমীরদা তোমার সাথে কোন প্রণয় জড়ানো আমার সম্ভব নয়। তুমি তোমার জীবন থেকে আমাকে মুছে ফেলো| তোমার প্রতি কোন অনুরাগ আমার কোনদিন হবে না।সঞ্জীব আমার অতীত ,বর্তমান, ভবিষ্যৎ। ওকে ছাড়া আমি কাউকে আমার জীবনে স্থান দিতে পারব না
- আমরা তো ভালো বন্ধু হয়েও থাকতে পারি নুপুর ?
- হ্যাঁ তা পারি। তবে ওইটুকুই।
আজ অনেকদিন পর একটু হালকা লাগছে নূপুরের। বাবা-মার কথা ভেবে কখনো একটু কাঁদতেও পারে না ও। বেশিরভাগ রাতগুলোই কেটে যায় বিনিদ্র। আজ অনেকটা হালকা। সঞ্জীব কি খুশি হচ্ছে? নাকি ও ভাবছে ও ফিকে হয়ে যাচ্ছে নুপুরের জীবনে। ওর স্মৃতি আঁকড়েই বেঁচে থাকতে চায় নুপুর। স্কুল টিচার হয়ে সঞ্জীবের স্বপ্ন পূরণ করতে চায়।
0 Comments