মহাসম্মেলন

শ‍্যামাপ্রসাদ সরকার on

mohasonmelon

বুদ্ধের পরিনির্বাণের পরে একটিমাত্র বর্ষাঋতু এতদিনে সবেমাত্র অতিক্রান্ত হইয়াছে। সুরচঞ্চলা বর্ষা ঋতুর নুপূর নিক্কণের ছন্দ বৈশালী হইতে কুশীনগর কিংবা পাটলীপুত্র বা রাজগৃহ’তে আসিয়া যেন গত একটি বৎসরে স্তিমিত হইয়া গিয়াছে। তাহার কারণ আর কিছুই নহে, আর্যাবর্তের অন্তঃস্থল যেন সেই মহাপতনের শোকাবহতাকে এক নিদারুণ আচ্ছন্নতার মত সঙ্গী করিয়া অদ‍্যপি বজায় রাখিয়াছে। শাক‍্যপুত্রের দেহাবসানের সাথে সাথে আসমুদ্রহিমাচলের এই ঔদাসীন‍্য আজকাল সহজেই দৃষ্টিগোচর হয়।

“ধম্ম” কথাটি যাহা এই কিছুকালের মধ‍্যেই জনসাধারণ কিংবা ক্ষমতাবান শ্রেষ্ঠী বা নৃপতিদের হার্দ‍্যিক অভ‍্যন্তরে যে স্বাভাবিক প্রবণতার এক অনন‍্য সাধারণ বৈশিষ্ট্যে পরিগণিত হইয়া গিয়াছিল তাহা আজকাল লোকে সহজে আর স্মরণ করিতে পারেনা।
………….

কিছুপূর্বে যে বর্তমান মগধপতি “অজাতশত্রু” তাহার পিতার বৌদ্ধধর্মের প্রতি সংবেদী আচরণের বিরোধাভাস করিয়া শ্রমণদিগকে দমন করিতে কেবল পছন্দ করিত তাহারও যেন মনপবনে কি অজানিত কারণে আজকাল দোলা লাগিয়াছে আর তাহা বেশ দেখিতেও পাওয়া যাইতেছে বলিয়া রাজসভায় এক গোপন ও গূঢ় সমাবেশ বসিয়াছে। তাহার বিষয়টি কেবল মগধ নৃপতির সাথে বসুমিত্র ও কয়েকজন বিশিষ্ট সভাসদ জ্ঞাত হইয়া রাজানুগত‍্যকে সম্মান দেখাইতেছেন।

মহাকালের ধর্মই যে সতত পরিবর্তনশীলতা তাহা সেই ঋষিকল্প রাজপুত্রটি শাক‍্য বংশের রাজধর্ম হইতে সাধারণ‍্যে নামিয়া আসিয়া বুঝিতে সক্ষম হইয়াছিলেন তাই তিনি পরবর্তীতে “পঞ্চশীল” রচনা করিবার জন‍্য তদ্গত ও চিত্তসমাহিত “বুদ্ধ” হইয়া উঠিতে পারিয়াছিলেন। আজ এতকাল পরে সে সবই পন্ডিতপ্রবর ঐতিহাসিকেরা তাহার কার্যকারণ লইয়া নানা তত্ত্ব ও তাহার উপর পুনরায় পান্ডিত‍্যগম্ভীর তত্ত্বের ভার চাপাইতে সুখ পায় বলে আমি অতি ক্ষুদ্রমতি নর তাহা আজ অকারণ আলোচনা করিব কোন স্পর্ধায়? আমি যে মহাশ‍্রমণ কৌন্ডিণ‍্যের পরিকর ও লিপিকার হইয়া সঙ্ঘে থাকিতে পাই ইহাই তো যথেষ্ট। তিনি একদা আমাকে শ্রাবস্তীতে বন‍্য ভল্লুকের আক্রমণ হইতে রক্ষা করিয়া নবজীবন দান করিয়া বাঁচাইয়াছিলেন। সেই দূমূর্ল‍্য মহাজীবনের আসঙ্গলাভই আজ আমার ভবজীবনের পাথেয় হইয়া উঠুক, এর বেশী আর কিছু চাহিব না।
…………..
সপ্তাহকাল পরে মেঘবলয় কিঞ্চিৎ ক্ষীণ হইয়া আদিত‍্যদেবকে উজ্জ্বল চিত্তে প্রকাশ হইতে দিয়াছে বলিয়া জনগণ যেন ইদানিং কিঞ্চিৎ হৃষ্টমনা। বিস্ময়ের ব‍্যাপার এই যে মগধরাজ অজাতশত্রু আচম্বিতে বৌদ্ধবিরোধিতার বীজ পরিত‍্যাগ করিয়া সম্প্রতি শ্রমণদিগের অনুগামী হইবেন বলিয়া তাহা বলিতেই মগধে এই গোপন সভার আয়োজন করিয়াছেন। পূর্বের ভ্রমাদির সংস্কারে মধ‍্যবয়সী রাজপুরুষ অজাতশত্রু এখন বড়োই উন্মুখ।

পরম কারুণিকের এও এক বিচিত্র লীলা বটে।

কুশীনগরে গৌতম বুদ্ধের মৃত্যুকালে তাঁহার অতিপ্রিয় শিষ্য মহাকশ্যপ তাঁহার নিকট উপস্থিত ছিলেন না। কুশীনগর যাত্রাকালে একজন সন্ন্যাসী তাঁহাকে গৌতম বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণের এই সংবাদ জানাইলেন। সুভদ্র নামক সেই প্রবীণ ভিক্ষু এই সংবাদপ্রচারে সেদিন কাহাকেও হতাশ ও ক্রন্দনরত হইয়া দুঃখপ্রকাশের পরিবর্তে আনন্দ প্রকাশ করিতে বলিলেন। ভিক্ষু সুভদ্রের এইরূপ বিচারে অবিনাশী পরমাত্মার স্বরূপ সংক্রান্ত সনাতন বৈদিক ধর্মের ছায়া দেখিতে পাইলেন বলিয়া অন‍্য সকল ভিক্ষু শিষ‍্যগণ মহাকশ্যপ স্থবিরের সহিত গৌতম বুদ্ধের শিক্ষা ও ধম্মের পবিত্রতা রক্ষার ব্যাপারে আশঙ্কিত হইয়া পড়িলেন। গৌতম বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণের পর তাঁহার শিক্ষা যাতে অবলুপ্তির পথে না চলিয়া যায় সেই উদ্দেশ্যে সকলে এক সঙ্গীতির আহ্বান করিলেন।প্রথমে এই বৌদ্ধ সঙ্গীতি সম্ভাব‍্য ন্যাগ্রোধ গুহা অথবা গৃধ্রকূট পাহাড়ের ইন্দ্রসালা গুহায় করিবার কথা তুলিলেও শেষে বুদ্ধচিত প্রণেতা কবিবর অশ্বঘোষের কথা সকলে মানিয়া রাজগৃহের নিকটবর্তী সপ্তপর্ণী গুহাতে হইলেই সর্বদিক রক্ষা পাইবে বলিয়া তাহাই অবশেষে স্থির হইল।
………….

মহাশ্রমণ কৌন্ডিণ‍্যের পরামর্শমত আমি এই সঙ্গীতিসভার বিবরণ লিখিয়া রাখিব ইহা স্থির হইবার পরে ভূর্জপত্রগুলির সাথে মসী ও লেখনীগুলিকে সানন্দে তৈয়ারী করিতে লাগিলাম।

এদিকে সভাস্থলে এক গোলযোগ আরম্ভ হইল।
প্রকৃত অর্হৎ রূপকল্প না হইয়া উঠিতে পারার জন‍্য বাকী ভদন্তদের সহিত একাসনে বুদ্ধের অন‍্যতম শিষ‍্য আনন্দের অংশগ্রহণের ব্যাপারে শ্রমণশ্রেষ্ঠ মহাকশ্যপেরও বেশ আপত্তি ছিল। তাঁহাদের অভিযোগগুলি হইল সঙ্ঘে নারীদের প্রবেশের ব্যাপারে আনন্দের অতি সক্রিয়তা, গৌতম বুদ্ধের মৃত্যুশয্যায় তাঁহাকে জলপান না করানো, আর গৌতম বুদ্ধের মৃতদেহে সবার প্রথমে প্রজ্ঞাপারমিতা সহ অন‍্য সকল নারীদের দ্বারা স্পর্শ করানো… ইত্যাদি।

আনন্দ স্মিতমুখে ইহার উত্তর করিতে অসম্মত হইয়া মহা সঙ্গীতি সভা ত‍্যাগ করিতে উদ‍্যত হইলেন।
…………
আমি সামান‍্য লিপিকারমাত্র। তাও বোধিবৃক্ষের সমৃদ্ধতম শাখাটির এই অপমান আমার বক্ষে আসিয়াও বিঁধিল। আমি কাতর চক্ষে মহাশ্রমণ কৌন্ডিণ‍্যের দিকে চাহিয়া রইলাম।

মহাকারুণিক অন্তরালে থাকিয়া বোধহয় ইঁহাদের বালখিল‍্যপনা দেখিয়া যেন ঈষৎ মৃদু মৃদু হাসিতেছিলেন।

আনন্দ তাঁহার সংগ্রহের সুত্তপিটকের পাঁচটি অধ‍্যায় যাহা এইসকল প্রশ্নের প্রতি উত্তরের আকারে উপস্থিত করা সম্ভব তাহা কৌন্ডিন‍্যের হস্তে মেলিয়া ধরিলেন আর নিশ্চুপে বিদায় যাচনা করিলেন।

গৌতম বুদ্ধ তাঁহাদের “ধম্মচক্কপ্পবত্তন সুত্ত ” সম্বন্ধে যবে শিক্ষা প্রদান করিয়াছিলেন সেই পাঁচটি দিবস অবসানের পরে তাঁহার সেইসকল শিষ‍্যদিগদের “অনাত্তলক্ষন সুত্ত” সম্বন্ধেও শিক্ষাদান করিয়াছিলেন। আর বুদ্ধের নিকট সেইসকল শিক্ষালাভের ফলে তরুণ কৌণ্ডিণ‍্য তখন অর্হৎ হিসেবে আলোকপ্রাপ্ত হইয়া উঠেন।

এরপর তিনি একদা গৌতম বুদ্ধের নিকট ভিক্ষু হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলে বুদ্ধ “এহি ভিক্ষু” বলিয়া তাঁহার ইচ্ছাপূরণ করিয়াছিলেন বলে আজিকার অর্হৎমূলকল্পটি সূচীত হইয়াছে।

বৌদ্ধধর্মের ইতিহাসে তাই কৌণ্ডিন্য প্রথম ভিক্ষু হিসেবে গণ্য হইয়া উঠিলে পরবর্তীকালে জেতবনে অবস্থিত সঙ্ঘ কৌণ্ডিণ‍্যকেই ভিক্ষুদের মধ্যে সর্বপ্রথম বলে মান‍্য করিয়াছিলেন তাহা আমিও জানিতাম।
…………
আনন্দ সাশ্রুনেত্রে ভ্রাতৃপ্রতীম কৌন্ডিণ‍্যকে আলিঙ্গন করিলে সভাগৃহের পরিবেশ এতক্ষণে পরম প্রীতিতে পূর্ণ হইয়া উঠিল।

অহঃ ! বোধিশ্রেষ্ঠ!

ইহার পর কিয়‍ৎক্ষণ ধরিয়া প্রেমবিগলিত এই দুই বৌদ্ধ নিবিষ্টপ্রাণে অশ্রুবর্ষণ করিতে লাগিলেন।

বিদায়কালে আনন্দ একখানি প্রস্তরনির্মিত পানপাত্র আনিয়া মহাকাশ‍্যপ ও কৌন্ডিণ‍্যকে দান করিয়া বলিলেন যে ইহা বৈশালীতে বসবাসকালে পরমকারুণিক স্বয়ং জলপানের নিমিত্তে ব‍্যবহার করিতেন। আজ উহা এই প্রথম সঙ্গীতি সম্মেলন সভায় ঐশীভাবের জ্ঞানতৃষ্ণা নিবারণে সম‍্যক সহায়ক হউক।

এক্ষণে সকলে বিস্মিত হইয়া আনন্দের দিকে কিয়ৎক্ষণ চাহিয়া থাকিলেন। যে ভিক্ষুক স্বয়ং এই সভাস্থলে কাঙ্খিত নন বলিয়া সদ‍্য অপমানিত হইয়াছেন তৎসত্ত্বেও তিনি এই দুষ্প্রাপ‍্য বস্তুটি সঙ্ঘকে বিনম্র শ্রদ্ধায় দান করিতে কি করে এত সহজে সক্ষম হইলেন?
…………
মূর্খেরা বুঝিল না! ইহাই তো সত‍্যসন্ধানী সেই তথাগতের প্রকৃত পাঠ!

এতক্ষণে কৌন্ডিণ‍্য আলিঙ্গন দৃঢ়তর করিয়া আনন্দকে স্থানত‍্যাগে নিবৃত্ত করিলেন ও বুদ্ধের পাদুকা স্পর্শ করিয়া মূল অর্হৎ এর সম্মান তাঁহাকে দিতে কুন্ঠাবোধ করিলেন না আর তাহা ঘোষণা করিতে সামান‍্য বিলম্বের জন‍্য ক্ষমা যাচনা করিলেন। সভাগৃহ এক্ষণে স্বয়ং বুদ্ধের নামে প্রতিধ্বনিত হইয়া উঠিল।

আমার দুটি চোখ তখন এই অমৃতপুরুষের প্রেমময়তায় ক্রমে ভিজিয়া যাইতে লাগিল। চিৎকার করিয়া বলিয়া উঠিলাম,
” ধন‍্য বুদ্ধ! ধন‍্য তথাগত! আপনি নশ্বরদেহ ত‍্যাগ করিয়াও আজ এইসকল ঘটনা বিবৃত করিতে দিয়া এই সামান‍্যতম লিপিকারটিকেও যে আশীর্বাদ করিতেছেন তাহা সকল যেন আজি হইতে পরম সত‍্যভাষণ হিসাবে ভাবীকালের জন‍্য চিহ্নিত হইয়া উঠুক ! “

এরপর সঙ্ঘের অন‍্যতম অর্হৎ প্রবীণ ভিক্ষু উপলির ভূমিকা সমৃদ্ধ অর্হৎমূলকল্পের বিবরণটি সুত্ত ও বিনয়পিটক প্রচলনের সহিত ঐক‍্যমতে এই সভাগৃহে গৃহীত হইয়া সঙ্গীতি সমাবেশটিকে সার্থক করিয়া তুলিল।
…………
সহস্রাব্দের পর সহস্রাব্দ একদিন অতিক্রান্ত হইয়া যাইবে। আমরা কেহই আর ধরাধামে জীবিত থাকিব না, কিন্তু তথাগতের ঐশী আলোক তথাপি পৃথিবীর বুকে ঠিক জ্বলিবে।

আজ রাজগৃহের নিকটবর্তী সপ্তপর্ণী গুহাতে যেন সেই মহাসাধনার প্রদীপটি পরম প্রীতি ও ঐক‍্যমতের আবহে জ্বলিয়া উঠিল!

” হে করুণাঘন! ওম্ মণিপদ্মে হুম্”

……………..

তথ‍্যঋণ:

উইকিপিডিয়াতে লিপিবদ্ধঃ

  • মুখোপাধ্যায় বাসুদেব (১৯৯৪). The Riddle of the First Buddhist Council – A Retrospection,
  • ছুং-হুয়া বুদ্ধিস্ট জার্নাল, পৃষ্ঠা ৪৫২–৪৭৩

…………..

ফেসবুক অ্যাকাউন্ট দিয়ে মন্তব্য করুন


শ‍্যামাপ্রসাদ সরকার

শ‍্যামাপ্রসাদ সরকারের জন্ম কলকাতায়। পাঠভবন স্কুলের সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে সাহিত‍্য সৃজনে উৎসাহ সেই ছাত্রাবস্থা থেকেই। পরবর্তী কালে সেন্ট জেভিয়ার্স সহ অন‍্যান‍্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও ছোট বড় বিভিন্ন পত্রিকায় মূলতঃ কবি হিসাবে আত্মপ্রকাশ। সম্পাদনা করেছেন 'স্ফূলিঙ্গ' ও 'প্রত‍্যূষ' এর ছোট পত্রিকা। বর্তমানে মধ‍্যপ্রদেশে বেসরকারী ব‍্যাঙ্কে কর্মরত অবস্থায়ও সাহিত‍্যসাধনার ধারাটি বহমান। 'ঋতবাক', 'সব‍্যসাচী', 'বেদান্ত', 'প্রতিলিপি', 'বিবর্তন', 'সময়' প্রভৃতি পত্রিকায় নিয়মিত সাহিত‍্যরচনায় রত। অসংখ‍্য কবিতা, ছোটগল্প ও উপন‍্যাস (মূলতঃ ঐতিহাসিক ও জীবনীমূলক) রচনার জন‍্য পাঠকমহলে ইতিমধ‍্যেই সমাদৃত। সম্প্রতি কোলকাতা বইমেলা ২০২০ তে প্রকাশিত হয়েছে উপন‍্যাস 'নিঠুর দরদী'। পুরস্কৃত হয়েছেন ' বিবর্তন পত্রিকা - সাহিত‍্য সম্মাননা ২০২০' তে 'নির্বাচিত কবিতা' সংগ্রহের জন‍্য।

0 Comments

মন্তব্য করুন

Avatar placeholder

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।