আবির মাখা কদমগাছ

জয়দীপ চট্টোপাধ্যায় on

দূরপাল্লার ট্রেন যেখানে থামতে চায় না, আর যারা থামে তারাও নিতান্তই পরিস্থিতির কারণে… এমন এক ছোট স্টেশন। তার সীমিত দৈর্ঘ্যের প্ল্যাটফর্ম। আর সেই সীমিত অঞ্চলের নিরহঙ্কার অস্তিত্ব। হলুদ রং করা জাফরি দেওয়া পাঁচিল। পাঁচিলের ওপারে লালমাটির রাস্তা, যা ট্রেনের জানলা দিয়ে যাত্রীরাও দেখতে পায়। সেই পাঁচিলের ওপারে আর এপারে কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা কিছু গাছ। যে সব গাছ বিশেষ মরশুমে লাল, হলুদ, নীল, সাদা, গোলাপী ফুলে ভরে থাকে। যে সব গাছের এ ডালে ও ডালে উড়ে বেড়ায় চড়াই, দোয়েল শালিখ, ফিঙে, বসন্ত বাউরির মত পাখি। আর সন্ধে হ’লে পাতার ফাঁকে ঝাঁকে ঝাঁকে মিশে গিয়ে কিচিরমিচিরে ভরিয়ে দেয় স্টেশন চত্বর। সেখানে ছুঁয়ে যায় আলাদা আলাদা ঋতুর চার প্রহর, ছুঁয়ে যায় যাত্রার মুহূর্তরা। সবকিছুই হয়… দৈনন্দিন, ছিমছাম ভাবে অথচ একটা কোমল যত্নের স্পর্শে। ঠিক যেভাবে কোনও মধ্যবিত্তের গৃহিনী নিজের মত করে সাজিয়ে-গুছিয়ে রাখতে চায় তার সংসারের সব কিছু।


                         — — — 


জায়গাটার নাম এর আগে কখনও শোনেনি মল্লিকা। কুন্তলের ওখানে বদলি হচ্ছে শুনে কোন জেলায় যাচ্ছে, তাও বুঝতে পারেনি। কুন্তল অল্প কথার মানুষ, নিজের বাড়ি ছেড়ে দূরে কোথাও গিয়ে থাকতে হবে – এসব ভেবেও বিরক্ত ছিল মনে মনে। তাই জায়গা নিয়ে বিশেষ উৎসাহ দেখাচ্ছিল না। সরকারী চাকরি, কিছু করার নেই। এক বছর অন্ততঃ কাটাতেই হবে ওখানে। কিন্তু মল্লিকার মনের ভেতর একটা চাপা আনন্দ ছিল। শুনলো দু’বার ট্রেন বদলে যেতে হয়। বীরভূমের কোনও এক গ্রামের স্টেশন। টাউন থেকেও বেশ দূরে। টাউন থেকে বেশ দূরে… এছাড়াও আরও যতরকম প্রতিকূলতা এক এক করে রোজ বলে যেত কুন্তল। যত যাওয়ার দিন এগিয়ে আসত, একটা করে অপছন্দের কারণ বেড়ে যেতো। । তাও মল্লিকার মনে আনন্দটা ছিল। কারণ মধুচন্দ্রিমা ওর শ্বশুরবাড়ির সংস্কারে নেই। বিয়ের পর একবার সবাই মিলে পুরী গেছিল, জগন্নাথ দর্শন করতে… শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে ননদ আর তার মেয়েও ছিল। সেই শেষ। তারপর আর কোথাও যাওয়া হয়নি… তিন বছর হ’তে চলল। আনন্দটা আরও ঘণীভূত হ’ল যখন নিশ্চিৎ হ’ল শুধু দু’জনেই যাচ্ছে। তবে ‘বাধ্য হয়ে’ ভাবটা সব সময়ে চোখে-মুখে রেখে দিতো। একেবারে যাওয়ার দিন গাড়িতে ওঠা পর্যন্ত ওই ভাবটা ছাড়েনি। ছাড়লেই বিপদ!


     পাণ্ডব-বর্জিত গ্রাম, পরিচিত লোকজন কেউ নেই, শহরের সুবিধে-বিলাসীতা থেকে বিচ্ছিন্ন –  এসব কিচ্ছু মাথায় আসেনি। এই অনামী গ্রামের ছোট্ট স্টেশনটাই মল্লিকার কাছে ছিল অক্সিজেনের মত। একটা কাজের লোক একবেলা ঘরের কাজ করে দিয়ে যেত। আর একটা বুড়ো মত ভারী খাবার জল এনে দিয়ে যেত। ব্যস্‌। এ ছাড়া বাকি সব কাজই নিজেকে করতে হ’ত। প্রতিবেশী বলতে কাছাকাছি আরও কিছু রেলকর্মীদের পরিবার। নতুন এসেছে, কারও সাথেই বিশেষ আলাপ চারিতা হয়নি। আর গ্রামের জনবসতি স্টেশন থেকে কিছুটা দূরে। প্রথমে পাকা সড়ক ধরে বাজার, তারপর সেখান থেকে এক একটা পাড়ার দিকে সরু রাস্তা চলে গেছে। সেই মূল জনস্রোত থেকে দূরে ডিউটি করতে করতে কুন্তল আরও অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ত। এ তো দিন চারেক ছুটি কাটাতে আসা নয় যে পালামৌ বা আরণ্যকের মত উপন্যাসের গন্ধ শুঁকে আর এদিক সেদিক তিন-চাকা ভ্যানে করে ঘুরে তারপর মিষ্টির-বাক্স হাতে বাড়ি ফিরে গেলাম। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস এখানে কাটাতে হবে! 
    কিন্তু মল্লিকা এই নির্জন স্টেশন আর নিরালা প্ল্যাটফর্মের চারপাশের পরিবেশকেই একটা শান্ত বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মত ভালবেসে ফেলল। ভোরবেলা যে পাখির ডাকে ঘুম ভাঙত, সেই পাখির ডাককে ভালবেসে ফেলল। দুপুরবেলা স্টেশন থেকে যে মালগাড়ির শব্দ ভেসে আসত ঘুঘু পাখির ডাকের মাঝে, সেই মন্থর ঝিকঝিককে ভালবেসে ফেলল। বাড়ি থেকে অল্প দূরে যে পুকুরে মজদুরদের বউরা চানকরতে যেত, হাঁসদের দূরে সরিয়ে সাঁতার কেটে বেড়াত… সেই সবুজ ঠাণ্ডা আলোড়নকে ভালবেসে ফেলল। অনেকদিন পর, আজকাল খুব ভাল ঘুম হ’ত। বাপের বাড়ির কথা চিন্তা করে মন খারাপ হ’ত না। কুন্তলের অস্বস্তিতেও কোনও অসুবিধে হ’ত না। কুন্তল বুঝতে পারত – যে কোনও কারণেই হোক মল্লিকা খুব ভাল আছে এখানে। আশ্চর্য হ’ত ভেবে “কী ভাবে কেউ এমন একটা জায়গায় এত অসুবিধের মধ্যেও এমন নিশ্চিন্ত থাকতে পারে!” 


     ওদের তৃতীয় বিবাহ বার্ষিকীর দিন মল্লিকা দু’রকম মাছ রান্না করেছিল। দুপুরবেলা ট্রেনে করে টাউনে গেছিল দু’জনের একটা ছবি তুলতে। মেয়েদের প্রসাধনীর দোকান থেকে কিনেছিল খোঁপা সাজানোর একরকম ফিতে। আর সেখানকার একটা প্রসিদ্ধ মিষ্টির দোকান থেকে কিনে এনেছিল দু’জনের পছন্দের তিন-চার রকমের মিষ্টি। আর একটা কাজ করেছিল; একটা টগর গাছের চারা কিনে এনে বসিয়েছিল টবে। 
ফিরে এসে রাতে শোয়ার পর হঠাৎই কুন্তল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল অন্ধকার ঘরে। দীর্ঘশ্বাস ফেলা কুন্তলের স্বভাব। মল্লিকা শুনেও শুনত না। কিন্তু সেদিন দীর্ঘশ্বাস ফেলে কুন্তল চুপ করে থাকল না, বলল – “এখানেও কেমন আজকের দিনটা ভালভাবে কেটে গেল। মা-বাবার কথা ভেবে খুব একটা মনখারাপও হ’ল না। বলো?” মা-বাবা মানে শ্বশুর-শাশুড়ি, তাদের কথা আর মন খারাপ শব্দটা একই সঙ্গে এলো বলে হ্যাঁ কিংবা না তে উত্তর দিতে পারল না মল্লিকা। বলল “হুম, এখানেও ভালভাবে থাকা যায়। বাঁচা যায়।” কুন্তল এবার মল্লিকার দিকে পাশ ফিরে বলল, “এই যে সাধ করে টগর গাছ কিনলে, রাখলে টবে… বড় হ’লে আবার মাটিতে বসাতে হবে।”
– ক’দিন যাক, একটু গা ঝাড়া দিলেই মাটিতে বসিয়ে দেবো। 
– হ্যাঁ, গাছতা বাড়ুক, ফুল ফুটুক… আমরা আর ক’দিন। 
– মানে?
– হা হা… মানে আবার কী! চিরকাল কি এখানেই থাকব নাকি? ছ’মাস গেলেই ট্রান্সফার অ্যাপ্লাই করব… এক বছরের মধ্যে পালাতেই হবে এখান থেকে!
– ও।


মল্লিকা আর কিচ্ছু বলল না। অন্য পাশ ফিরে বালিশে মুখ গুঁজে শুলো। কুন্তল কিছু বুঝতে পারল না। ওর পিঠে মুখ ঘষে নিজের মত করে আদর শুরু করল। হাত দু’টো পেটের কাছে পৌঁছে নরম উষ্ণতা হাতড়াচ্ছে। 
একটু একটু করে ছাই খসে পড়তে লাগল, কুলুঙ্গির কাছে জ্বলন্ত দুটো-ধূপ থেকে। 


                    — — —


অপ্রত্যাশিত আর প্রত্যাশিত দু’রকম ঘটনা নিয়েই জীবন। মল্লিকা আর কুন্তলের এই নির্জন স্টেশন-যাপনেও এমনই হ’ল। প্রত্যাশিত ভাবেই টগর গাছটা বড় হয়ে জমিতে জায়গা করে নিলো। দেখে মনে হ’ল দ্রুত ফুল ধরবে। হয়ত প্রত্যাশিত ভাবেই, বিবাহবার্ষিকীর দু’মাস পরেই মল্লিকা শরীরে কিছু পরিবর্তন অনুভব করল, যেমন অনুভূত হ’লে চিকিৎসকের কাছে যেতে হয়… পরিবারে সুসংবাদ আসে। প্রত্যাশিত ভাবেই, কুন্তলের মাইনে বাড়ল একশো টাকা। যা অপ্রত্যাশিত তা হ’ল – কুন্তলের বদলীর আর্জি নাকচ। স্ত্রীয়ের অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার কারণ দেখিয়েও সুবিধে হ’ল না। মল্লিকাকে কুন্তল বলল শ্বশুর-বাড়ি অথবা বাপের বাড়ি চলে যেতে তিন মাস হওয়ার পর থেকে, কিন্তু মল্লিকা তাতেও সম্মত হ’ল না। পরিবর্তে দাবী করল, কেউ এখানে এসে তার সাথে থাকুক এই সময়টা। কেমন যেন জোর বেড়ে গেল মল্লিকার কণ্ঠস্বরে, তার অধিকারবোধে। সম্মত না হওয়া, আর এই জোর… দু’টোই কুন্তলের কাছে অপ্রত্যাশিত। কুন্তলের মা অনেক রকম উদ্বেগ প্রকাশ করলেও নিজের সংসার ছেড়ে আসতে চাইলেন না। আসতে হ’ল মল্লিকার মাকেই… মল্লিকার তখন ৭ মাস চলছে। ভরন্ত পেট। 


     গর্ভধারণের খবরটা নিশ্চিৎ হওয়ার পর থেকেই মল্লিকার মধ্যে একটা অন্যরকম সখ জন্ম নিয়েছিল… ঠিক জরায়ুতে জন্ম নেওয়া ভ্রূণের মত। প্রতি মাসে সে একটা করে নতুন চারা গাছ লাগাত বারান্দার একটা টবে। আর প্রতি দ্বিতীয় মাসে, তাকে ফিরিয়ে দিতো জমিতে। কোয়ার্টারের সামনের ছোট বাগানে অত জায়গা ছিল না। তাই তাদের একে একে বসিয়ে দিয়ে আসতে স্টেশনের পাঁচিলের ধারে সবুজ ঘাসে মোড়া লাল মাটির মধ্যে। মল্লিকার মা যেদিন এলেন… তখন প্ল্যাটফর্মের পাঁচিলের কাছে পাঁচটা গাছ বসে গেছে… আর ষষ্ঠটি মেয়ের সঙ্গে মিলে নিজেই লাগালেন পরদিন সকাল বেলা।  শুধু সেই প্রথম বসানো টগর গাছটা রয়ে গেল বাসার একফালি জমির ওপর। ফুলে ভরে থাকত গাছটা। ফুল ঝরে আলো করে রাখত গোড়ার চারপাশ। 
     অষ্টম আর নবম মাসে মল্লিকা নিজে খুঁজে পেতে কোনও গাছ আনতে পারল না। কুন্তল নিজেই নিয়ে এসেছিল ওর জন্য। শুধু টবে বসালো মল্লিকা নিজে হাতে। অষ্টম গাছটা যেদিন স্টেশনে লাগানো হ’ল… সেদিন বিকেলেই মল্লিকার ব্যথা শুরু হ’ল। সঙ্গে সঙ্গে সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে হ’ল কুন্তলকে। ডাক্তারের দেওয়া তারিখে দু’দিন দেরি। তাও কোনও রিস্ক নেওয়া সম্বভ নয়। যাওয়ার আগে প্রতিটা গাছকে নিজের হাতে জল দিয়ে গেল মল্লিকা। অল্প করে মগে জল নিয়ে… ব্যথা সহ্য করেই। 


                      — — — 


না না… এটা কোনও চোখের জলে ভিজিয়ে দেওয়ার বিয়োগান্তক গল্প নয়। মল্লিকাকে আমরা এখানে এভাবে হারাবো না। মনে জোর আনুন পাঠক। হাসুন। মল্লিকা আর কুন্তলের পরিবারে নতুন সদস্যকে বরণ করে নিন হাসিমুখে। 
নবম গাছটি মল্লিকা নিজে হাতেই প্ল্যাটফর্মের মাটিতে লাগালো… দু’মাসের মেয়েকে কোলে নিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে ছিল কুন্তল। এই প্রথম, এই অজ পাড়া-গাঁ আর এক-ঘেঁয়ে স্টেশনটাকে খারাপ লাগছিল না। কী সুন্দর নতুন গাছের সবুজে ভরে আছে। গোরু-ছাগলেও এদের কোনও ক্ষতি করেনি। অসময়ে হওয়া বৃষ্টির জল পেয়ে সতেজ। ফুল ফুটছে গাছে গাছে। পাখি আসছে। গাছের ছায়ায় ঘুমোচ্ছে ক্লান্ত কুকুর-মা, সন্তানদের বুকে নিয়ে। 
“তোমার গাছগুলো কেমন ফুলে ভরে গেছে… দেখেছো?” মেয়েকে আলতো ভাবে দোলাতে দোলাতে বলে উঠলো কুন্তল। মা হওয়ার পর মল্লিকার স্বাস্থ্যে উন্নতি হয়েছে, একটা অন্যরকম লাবণ্য এসেছে শরীরের চড়াই-উৎরাইয়ে। গলার আওয়াজটাও কেমন ঢলো ঢলো শোনায়।  গাছের তলার মাটিতে সাঁড়াশি দিয়ে হালকা ভাবে খোঁচাতে খোঁচাতে একটা আলতো হাসিতে লজ্জা মিশিয়ে মল্লিকা বলল, “হবে না? ফাল্গুন মাস… বসন্ত এসে গেলো যে!” 


     মল্লিকা আর কুন্তল ওদের মেয়ের নাম রাখল মালিনী। বিবাহ বার্ষিকীতে আবার একটা গাছ লাগাল মল্লিকা। এবারে টাউনে গিয়ে তিনজন মিলে একটা ছবি তুলল। 
     মালিনীর অন্নপ্রাশনের সময় যখন ওরা সপরিবারে শহরে এলো, মল্লিকার সেটা প্রায় দু’বছর পর এতদিন একটানা শ্বশুর-বাড়িতে থাকা। অনুষ্ঠান মিটে যেতেই শাশুড়ি সুযোগ মত মুখে হাসি মাখিয়ে বললেন “এবারে তাহ’লে বউমা আর নাতনিকে এখানেই রেখে যা খোকা… আর ওখানে পড়ে থেকে কাজ নেই।” কথাটা শুনেই মল্লিকার চোখে অসন্তোষ নেমে এলো। সেও হাসি মাখিয়ে বলল, “সেকি মা… ওখানেও তো একটা সংসার… কত কাজ… গাছগুলোর দু’বেলা দেখাশুনো… বেড়ালগুলো তো এমনিতেই একদিন কী খেয়ে আছে কে জানে! রুনুর মাকে বলে এসেছি, যা হোক চাট্টি একবেলা মেখে দিতে।” ঠিক যেভাবে কেউ ফিরে গিয়ে সংসারের লোকজনের জন্য রান্না-খাওয়ার ব্যবস্থার কথা বলে। সে না ফিরলে, তাদের না খেয়ে থাকতে হবে। কুন্তলের মা নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। ঘরের বউ স্পষ্ট জানিয়ে দিচ্ছে, সে শ্বশুরবাড়িতে থাকতে চায় না। এ স্পর্ধা হজম করা সহজ কথা নয়। একবার স্বামীর দিকে আর একবার ছেলের দিকে তাকিয়ে উঠে চলে গেলেন ঘর থেকে… রান্নাঘরের বাসন গুছিয়ে রাখার অজুহাতে। মল্লিকা শ্বশুরমশাইয়ের দিকে তাকিয়ে সামান্য হেসে মেয়ের সঙ্গে খেলায় ফিরে গেলো। কুন্তলের বাবা এই নিয়ে বিশেষ কিছু বলেননি আর কুন্তল ওখানে যাওয়ার পর থেকেই বুঝতে পারে – মল্লিকার মধ্যে একটা পরিবর্তন এসেছে। ও চুপচাপ কোনও শব্দ না করেও অসহযোগিতা করতে পারে। জোর করে ওকে দিয়ে আর কিছু করানো সম্ভব নয়। গাছগুলোর মতই, ওর শেকড় গজিয়ে গেছে ওই ছোট্ট স্টেশনটার চারপাশে। 


                    — — — 


মল্লিকারা ফিরে এলো আবার সেই স্টেশনের কাছেই। স্টেশনটার চেহারাই বদলে দিয়েছে গাছগুলো। কেমন রঙিন পোর্ট্রেটের মত হয়ে উঠেছে নিঃসঙ্গ স্টেশনটা। বৃষ্টিভেজা প্ল্যাটফর্মের মেঝেতে সেই রঙিন ছায়া পড়লে আরও মায়াবী দেখায়। যেসব ট্রেন এসে থমকে দাঁড়ায়, তার যাত্রীরাও অবাক হয়ে দেখে হঠাৎ জেগে ওঠা মরুদ্যানের মত স্টেশনটাকে। অথচ এ সব কিছুই মল্লিকার কাছে খুব স্বাভাবিক। কোনও বাতিক বা আড়ম্বর নয়। একটা মানুষ ঘরের কাজকর্ম, রান্না-বান্না নিয়েই সারাদিন থাকবে? গাছগুলোকে দুবেলা একটু জল দেওয়া, মাটিগুলো খুঁচিয়ে দেওয়া, মাঝে মাঝে একটু সার বানিয়ে মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া – এই তো কাজ। মেয়েটা আর একটু বড় হয়ে গেলে, আর কি এত সময় পাওয়া যাবে? 
  কুন্তলের পদোন্নতি হ’ল। স্টেশন মাস্টার অন্য জায়গায় বদলি হয়ে চলে যাওয়ার আগে তাঁর দায়িত্ব আর কাজ বুঝিয়ে দিয়ে গেলেন কুন্তলকে। আবার মাইনে বাড়ল। এবারে পাঁচশো টাকা। কুন্তল বলল – সব মেয়ের ভাগ্যে। মালিনীকে কোলে টেনে কপালে একটা চুমু খেলো মল্লিকা। মল্লিকাকে কাছে টেনে তার কপালে একটা চুমু খেলো কুন্তল। কেঁপে উঠল মল্লিকার চোখের পাতা তিরতির করে। বদলি হওয়ার কথা শুনলেই বুকটা হুহু করে ওঠে। 


     মালিনীর যখন আড়াই বছর বয়স, তখন মল্লিকা আবার গর্ভবতী হ’ল। শ্বশুরবাড়ির কেউ কেউ বলত, ওটা ইচ্ছে করে… যাতে শ্বশুরবাড়িতে না আসার অজুহাতটা আরও লম্বা করা যায়। ঠিক সেই সময়তেই সবাই ভাবছিল – এবার মেয়েকে ইস্কুলে ভর্তি করতে হবে। এবারে ঠিক শ্বশুরবাড়ি ফিরতে হবে… মেয়েছেলের ঢ্যাঁটামি তখন বেরিয়ে যাবে। কুন্তলও হালকা ভাবে বোঝানোর চেষ্টা করত, “মেয়ে বড় হচ্ছে… ইস্কুলে তো দিতে হবে বলো? এখানে কি আর সম্ভব।অন্ততঃ টাউনের দিকে কোথাও ট্রান্সফার নিতেই হবে।” পরোক্ষে বুঝিয়ে দিতো, শহরে না ফিরতে চাইলে অসুবিধে নেই… অন্ততঃ মেয়ের কথা ভেবে এই জায়গাটা ছেড়ে এবারে একটু ভাল জায়গায় যাই। মল্লিকা বুঝতে পেরেছিল, ঠিক যেমন মায়ের মন অনেক কিছু বুঝে নিতে পারে। রাত্রিবেলা মালিনী আর কুন্তল অঘোর ঘুমে ডুবে থাকলে একা একা বারান্দায় চলে আসত মল্লিকা। জ্যোৎসনার আলোয় তাকিয়ে থাকত সামনের স্টেশন আর টগর গাছটার দিকে। মনে হ’ত সব কিছু ভেসে যাচ্ছে। টগর গাছটাকে দেখে মনে হ’ত মল্লিকা নিজেই মাটিতে শেকড় আঁকড়ে দাঁড়িয়ে আছে। ফুল হয়ে ঝরে ঝরে পড়ছে শরীরের এক একটা টুকরো। জ্যোৎসনায় চিকচিক করছে। এমন নৈসর্গিক মুহূর্ত বেশিক্ষণ সহ্য করা যায় না। দেহ, মন, সব ঝলসে যায়। চোখে-মুখে জল দিয়ে আবার ঘরের দরজা বন্ধ করে বিছানায় ফিরে যেত মল্লিকা। 
     গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে বড় মায়া হ’ত। কষ্ট হ’ত পুকুরের হাঁসগুলোকে দেখলে… বেড়ালগুলো পায়ের কাছে মাথা ঠুকলে। যেন এই সবকিছুকে আরও ক’টা মাস আঁকড়ে থাকার জন্যই ইচ্ছে করে আবার শরীরে বীজ ধারণ করল মল্লিকা গাছ। 


                       — — — 


আবার একটা একটা করে মাস পার হয়ে গেলো। এক একটা করে নতুন চারা গাছ এনে বসালো মল্লিকা আর কুন্তল… এবারে উলটো দিকের প্ল্যাটফর্মে, দু নম্বর প্ল্যাটফর্ম। মালিনী সঙ্গে সঙ্গে থাকত। প্রজাপতি আর কাঠবেড়ালী তাড়া করে বেড়াতো ছুটে ছুটে। বিহারী লাইন-ম্যান ফাগুলাল সব সময় পাহারাদারের মধ্যে সঙ্গে সঙ্গে থাকত, যাতে বিটিয়া-রানি হঠাৎ লাইনের দিকে না চলে যায়। এ’বারে, কুন্তলের মা স্পষ্টই বলে দিলেন – বৃদ্ধ স্বামীকে ছেড়ে তাঁর পক্ষে কোথাও যাওয়া সম্ভব নয়। বউমা শহরে এলে, তখন না হয় যতটা পারেন করবেন। মল্লিকা সব শুনে কুন্তলকে বলল “হ্যাঁ গো, আমি না থাকলে মেয়েটাকে শহরে ওদের কাছে রেখে দিয়ে আসবে না তো?” 
কুন্তল কী বলবে বুঝতে পারল না। সবাই আবেগঘন উত্তর দিতে পারে না সব সময়। কুন্তলও তাদেরই মত। মায়ের ওপর বিরক্তি প্রকাশ করে শুধু বলল, “বুড়ো বয়সে ফালতু অশান্তিগুলো তৈরী না করলে চলে না এদের… আর তোমাকেও সব কথা বলতে নেই এই জন্য!”; এই অবধি বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল স্টেশনের দিকে। কুন্তলের দ্রুত চলে যাওয়া দেখে মল্লিকা হেসে ফেলল। কুন্তলের চলে যাওয়া দেখতে দেখতে দু নম্বর প্ল্যাটফর্মের গাছগুলোর দিকে চোখ পড়ে গেল। কুন্তল আর মল্লিকা… একজন বুঝতে পারছিল যে অন্যজনের চোখে জল চিকচিক করছে একই কম্পাঙ্কে। অথচ দু’জনেই ভাবল – বেশ ফাঁকি দেওয়া গেল। 


     এবারেও মল্লিকার মাকেই আসতে হ’ল কোমড়ের ব্যথা নিয়ে। এবারে আর গাছ লাগাতে পারছিলেন না বসে। মেঝেতে উবু হয়ে বসলে, উঠতে অসুবিধে হয়। দিনে একবার কী দু’বার উবু হয়ে বসেন। বাধ্য হয়। যেদিন বার বার বসতে হয়… সেদিন আর নিজে উঠতে পারেন না, কাজের বউকে সেদিন টেনে তুলে দিতে হয়। তাও এসেছিলেন মেয়ের টানে… মা তো। 
অষ্টম গাছটা স্টেশনে লাগিয়ে, সব ক’টা গাছে জল দিয়ে, তারপর মেয়ের দু’গালে হামি খেয়ে মল্লিকা বলল “দুষ্টুমি  করবে না… রুনু মাসির কথা শুনবে! দিম্মার কথা শুনবে। বাড়ির বাইরে কক্‌খোনও একা আসবে না। কেমন?” মালিনী শুধু ঘাড় হেলিয়ে রইল একদিকে। মাকে একটা প্রণাম করে তারপর শেষ বৈশাখের গুমোট গরমকে দুষতে দুষতে কুন্তলের সঙ্গে টাউনের দিকে চলে গেল মল্লিকা। 


  এবারে ছেলে হ’ল। নাম রাখল কিংশুক। স্টেশনে শেষ যে গাছটা পুঁতেছিল মল্লিকা সেটা পলাশ গাছ। তার তিন মাসের পরেই বদলী হয়ে দুবরাজপুর চলে গেল কুন্তাল। টাউনে পোস্টিং-এর সঙ্গে মাইনেও বাড়ল। মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করতে হবে। দু’টো বাচ্চা সামলানোর জন্য ঘরও বড় দরকার। মল্লিকাও আর জেদ করল না। স্টেশনের দুটো প্ল্যাটফর্মের দিকে তাকালে মনে হ’ত এখানকার কাজ যেন শেষ হয়ে গেছে। এবারে তার নিজেরও বদলি নেওয়ার সময়। কুন্তল ভেবেছিল মল্লিকা কান্নাকাটি করবে, ছেলেমানুষী জেদ ধরবে, অথবা সেই নীরব বিদ্রোহ শুরু করবে যা সামলানো আর সহ্য করা দুটোই মুশকিল। ভয় পাচ্ছিল কুন্তল… যদি এই অবস্থায় মল্লিকা খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দেয়? যদি অসুস্থ হয়ে পড়ে? কিন্তু সেসব কিছুই করল না মল্লিকা। আবার অবাক হ’ল কুন্তল, যে মল্লিকা নিজেই সব হাসিমুখে মেনে নিচ্ছে। উৎসাহ নিয়ে সব জিনিসপত্র গোছগাছ করছে। যা কিছু নিয়ে যাবে না, সেসবের একটা গতি করার চেষ্টা করছে। কুন্তল মাঝে মাঝে একই কথা জিজ্ঞেস করত, “হ্যাঁ গো… তোমার খারাপ লাগছে না তো? তুমি সত্যিই মন থেকে যেতে রাজী তো?” বার বার বলতে আর কথাগুলো শুনতে নিজেরই বোকা বোকা লাগত। একদিন মল্লিকা হাসতে হাসতে বলেই ফেলল “তুমি এত ভয় পাও আমাকে?! বাব্বাহ… আগে জানলে তো ঘাড় ধরে অনেক কিছু করিয়ে নিতে পারতুম!”


নতুন যে ব্যক্তি এলো কুন্তলের জায়গায়, তার বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। গৃহিনীও বেশ ভারিক্কী, চোখে-মুখে একটা অদ্ভুত অসহিষ্ণুতা… এমন এঁদো গ্রামে সংসার নিয়ে এলে যেমন অনেকেরই হয়। তার সঙ্গে বিশেষ ভাবও করতে পারল না মল্লিকা… আর মন থেকে ইচ্ছেও হ’ল না। সত্যি বলতে গাছগুলোর এরা যত্ন নেবে, এমন প্রত্যাশাই আর রইল না। টগর গাছটা নিজেই গিন্নী হয়ে উঠেছে। টুনটুনি পাখি বাসা করেছে গাছের ডালে। হয়ত নিয়মিত পুজোর ফুল পাওয়ার জন্য এই গাছটার একটু যত্ন নেবে। 
     কেমন অনাথ করে দিয়ে চলে যাচ্ছে সবাইকে… এটা মেনে নিতে পারছে ভেবে নিজেই অবাক হচ্ছিল মল্লিকা। ফাগুলালকে ডেকে বলে গেল… যাতে গাছগুলোকে নিয়ম করে দুবেলা জল দেয়। আর কিছু না পারুক, সময় মত জলটুকু যেন দেয়। ফাগুলাল ‘জরুর মাইজী’ বলে হাত জরো করে মাথাটা একবার নিচু করল। রুনু আর রুনুর মা আবার আসতে বলল, ফাগুলাল আবার আসতে বলল। স্টেশন আর প্ল্যাটফর্ম আবার আসতে বলল। বেড়ালগুলো আবার আসতে বলল। গাছগুলো কিচ্ছু বলল না, এক আকাশ অভিমান নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল চুপ করে। সবার গায়ে একবার করে হাত রেখে ট্রেনে গিয়ে বসল মল্লিকা। মেয়ে আর মা জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইল। আসতে  আসতে দূরে চলে গেল মল্লিকার মরূদ্যান। স্টেশন – বসন্ত দ্বীপ। 


                       — — — 


– জানিস, এই পলাশগাছটা আর আমার বাবার এজ সেম। 
– হোয়াট? 
– হ্যাঁ রে, আমার দাদু তো এখানেই থাকতেন। এই স্টেশনেই কাজ করতেন। এই স্টেশনের সব গাছ… মানে এখন যা দেখছিস তার অনেকগুলোই ওনাদের লাগানো। আগে এত গাছ ছিল না। 
বাবা যে বছর জন্মায়, এই পলাশ গাছটাও সেই বছরই লাগানো হয়। 
– আর ইউ সিরিয়াস?!
– অফকোর্স আই অ্যাম! তোদের গল্প দিয়ে আমার কী লাভ? 
– তা… তুই বলছিস, এখানকার প্ল্যাটফর্মের গাছগুলোর দেখাশুনো তোরা করতিস… তোদের অ্যানসেস্ট্রাল প্রপার্টি এগুলো। 
– অত কমপ্লিকেটেড করছিস কেন? দাদু এখানে থাকতেন। আমার ঠাকুমা গাছ লাগাতে ভালবাসতেন। তাই গাছ লাগাতেন। এই গাছটা আমরা চিনি। কারণ আমরা মাঝে মাঝেই এখানে আসতাম ছোটবেলা। বাবা-পিসি-দাদু-ঠাম্মা… বছরে দু-একবার এখানে আসতাম। লাইক পিকনিক, ফ্যামিলি গ্যাদারিং। 
– আই সি… তো আজ হঠাৎ আমাকে নিয়ে এলি কেন এখানে? আই মীন… অফকোর্স দিস ইজ আ নাইস প্লেস… সেরিন। বিউটিফুল। বাট হোয়াট নেক্সট? এখানে কোনও আশ্রম-টাশ্রম বা ঐ জমিদার বাড়ি-ফাড়ি আছে নাকি… যেখানে দোল খেলা হয়? 
– না না… এখানে বেশিক্ষণ থাকব না। একটু পরেই আর একটা ট্রেন ওদিক থেকে আসবে… চলে যাব। কী জানি, তোকে একটা জিনিস হঠাৎ দেখাতে ইচ্ছে হ’ল। তাই নিয়ে এলাম। 
– কী রে? কী জিনিস?
– আমার দাদু… প্রতি বছর দোলের দিন এখানে আসেন… ফর লাস্ট সেভেন ইয়ার্স। এ বছর বিছানা থেকেই উঠতে পারছেন না। তাই আমি এলাম। 
– এখানে আসেন? দোলের দিন? 
– হ্যাঁ, ওই যে কদমফুলের গাছটা দেখছিস… ওটাও আমার ঠাকুমার লাগানো। ওর নিচেই ঠাকুমার অস্থি রাখা হয়েছিল। ঠাকুমা চলে যাওয়ার পর… দাদু এসে ওই গাছটার গায়ে আবির মাখিয়ে দিয়ে যেতো দোলের দিন। এ বছর তো আসতে পারলো না… তাই ভাবলাম, আমিই এসে আবির দিয়ে যাই। 

ফেসবুক অ্যাকাউন্ট দিয়ে মন্তব্য করুন


জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়

বর্তমানে হায়দ্রাবাদ নিবাসী  হলেও, জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়ের শৈশব থেকে যৌবন সবটাই কলকাতার শহরতলী জুড়ে। জন্ম ২০শে আগস্ট, ১৯৮৬। বায়োটেকনলজিতে বি টেক শেষ করেই কর্মসূত্রে ২০০৮ সালে কলকাতা ছেড়ে বেঙ্গালুরু চলে যান, এবং তারপর হায়দ্রাবাদ। প্রায় দশ বছর হয়ে গেল, কলকাতার বাইরেই জীবন। বাংলা সাহিত্যের প্রতি নিবিড় ভালবাসা থেকেই একসময় লেখার ইচ্ছে জন্মায়। প্রায় সাত-আট বছর উনি একাধিক আন্তর্জাল পত্রিকা এবং মুদ্রিত পত্রিকায় লিখে চলেছেন গল্প, প্রবন্ধ, গদ্য এবং কবিতা। ২০১৩ সালে 'আদরের নৌকা' প্রকাশনা থেকে প্রকাশ পায় ওনার প্রথম গল্প সংকলন 'প্রতিবিম্ব'। এর পর ২০১৫ সালে  'হাওয়াকল' প্রকশনা থেকে প্রকাশ পায় ওনার প্রথম উপন্যাস 'কৃষ্ণঘন যাম'। ২০১৭ সালে 'হাওয়াকল' প্রকশনা  থেকেই প্রকাশিত হয় প্রথম অণুগল্প সংকলন 'টিনিটাস'। ২০১৮ সালের কলকাতা বইমেলায় 'তবুও প্রয়াস' প্রকাশনা থেকে জয়দীপের প্রথম গদ্য সংকলন 'হৃদয়পুর কত দূর?' প্রকাশ পায়। এই লেখার মধ্যেই তিনি আনন্দ খুঁজে পান। আর প্রতিযোগিতামূলক এই জীবনে এই লেখাই তাঁর কাছে একটা রিফিউজ। লেখার প্রতি ভালবাসার টানেই উনি লিখতে চান... যতদিন পারেন।

1 Comment

Barun Talukder · এপ্রিল 21, 2019 at 6:38 অপরাহ্ন

খুব ভাল লিখেছেন ভাই ।

মন্তব্য করুন

Avatar placeholder

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।