সিটঙ থেকে ত্রিবেনী

তুষার কান্তি দত্ত on

গৌরচন্দ্রিকা

দার্জিলিং জেলার কার্শিয়াং ডিভিশনে সিটঙ একটা গ্রাম। গ্রাম না বলে বরং গ্রামের সমাহার’ই বলা ভালো। আপার – মিডিল – লোয়ার সিটঙ মিলে পুরোটাকেই একসাথে বলে সিটঙ খাসমহল। এই অঞ্চলটাই দার্জিলিংয়ের অরেঞ্জ ভিলেজ নামে পরিচিত। দার্জিলিং, মিরিক, কালিম্পঙ-এর মত ব্যস্ত শহরের চেয়ে সিটঙ অনেকটাই ভার্জিন। তবে সিটঙ-এ আসতে গেলে আগে থেকেই হোটেল বুক করে আসা উচিৎ। এ পথে গাড়ি বড্ড অনিয়মিত। কার্শিয়াং থেকে দিলারাম, বাগোরা, মহালাধিরাম হয়ে আসা যায়। আবার লাটপঞ্চার কিম্বা রম্ভী হয়েও আসতে পারেন। হাতে সময় থাকলে মংপু যোগিঘাট সেলপু আহিলডারা ও নামথিং পোখারিও দেখে নেওয়া যায় দু’চার দিনে। পুরো অঞ্চলটাই মহানন্দা ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারির অন্তর্গত।

গ্রামীন সংস্কৃতিতে অলসভাবে কটা দিন কাটানোর জন্য সিটঙ আদর্শ। খুব উৎসাহীরা যদি মানচিত্রে সিটঙ-কে খুঁজতে চান, তাহলে মানচিত্রে কার্শিয়াং থেকে লাটপঞ্চার পর্যন্ত একটা সোজা লাইন টানুন। তারপর লাইনটাকে দু’ভাগে ভাগ করে হাত রাখুন। আপনি চোখ বন্ধ করে সিটঙ পৌঁছে গেছেন।

সিটঙ থেকে

দার্জিলিং – ৩৫কিমি
কালিম্পং – ৪৫ কিমি
এন জে পি – ৫৪ কিমি

সিটঙ

হিলকার্ট রোডের উপরেই দিলারাম। কার্শিয়াং থেকে ৫কিমি। আমাদের যাত্রা শুরু দিলারাম থেকেই। আপার সিটঙ-এ মালোটারের রাস্তা যেখানে ভাগ হয়েছে সেখানেই রিজার্ভ গাড়িটা আমাদের নামিয়ে দিয়ে চলে গেলো। ৮০০টাকা ভাড়া মিটিয়ে দিল টিম ম্যানেজার। এবারে শুরু হাঁটা পথে লোয়ার সিটঙ। পথের দুপাশে দেখতে দেখতে হাঁটছি। হোটেল কিম্বা হোমস্ট্যে কিছু একটা পেলেই হবে। আমাদের কোনো বুকিং নেই। যদিও ব্যাগের ভেতরে আছে আমাদের টেন্ট। থাকার জায়গা না পেলে শেষ আশ্রয়।

অবশেষে থাকার জায়গা পেয়েই গেলাম। সিটঙ পুজন হোমস্টে’তে। মালিক অনিল মঙ্গর খুব ভালো মানুষ। ওনার দুদিনের উষ্ণ আতিথেয়তা মনে রাখার মত। যাওয়ার আগে কথা বলে নিতে পারেন। ফোন নম্বর ৯১৯৭৩৩০২৬১৮৯।

পুবের আকাশ লাল করে সূর্য উঠলে ঘুম ভাঙল আমাদের। কল্যাণদা’র শরীরটা আজ ভালো নেই। সারারাত ঘুম হয় নি টেন্টের ঠান্ডায়। তাছাড়া উল্টাপাল্টা খাওয়াও হয়েছে অনেক। সিটঙ পুজন হোমস্টেতে যারা আসে তাঁরা মূলত ট্যুরিস্ট। বেশিরভাগ ট্যুরিস্টই কলকাতা থেকে ট্রাভেল এজেন্ট মারফত বুকিং করে। তাই আমাদের মত অফবিট ট্রেকার পেয়ে আজ বেজায় খুশি অনিল মঙ্গর। হোটেল মালিক গতকাল আমাদের প্রায় জামাই আদরেই রেখেছিলেন। একটার পর একটা খাবার অর্ডার করলেই চলে আসছে। এটা সেটা খেয়েই তাই হালকা এসিড হয়েছে কল্যাণদা’র। আমি আর কুট্টিদা নাকি গতকাল টেন্টের ভেতরে খুব জ্বালিয়েছি। স্লিপিং ব্যাগের ভেতরে ঢুকেই নাকি তুমুল নাক ডাকাডাকি। আমাদের নাক ডাকাডাকির কারণে বাকিদের ঘুমের দফারফা। সকালে চায়ের আসরে বসেই জানতে পারলাম এসব। ওয়েটার অনেকক্ষন টেবিলে রেখে গেছে ধোঁয়া ওঠা ব্ল্যাকটি। চারটে কাপ-প্লেট আর গরম জলের জগ। গরম গরম টোস্টে বাটার মাখাতে মাখাতে বিশ্বজিৎ বলছিল গতরাতের নাক ডাকাডাকির কথা।

হোটেল-বয়টা সুর করে থেমে থেমে ডাকছে, আও-আও! সামনের ফাঁকা চাতালে উড়ে এসেছে কয়েকটা সাদা পায়রা। পায়রাগুলো মালিকেরই পোষা। নরম মাটি থেকে খুঁটে নিচ্ছে দানা। ঘাড় নিচু করে একটা পায়রা, বকম বকম করে ডেকেই যাচ্ছে। আমি পায়রা বিশারদ নই। তাই বুঝতে পারলাম না এই ডাক মিলনের না বিরক্তির! তবে সাতসকালে পায়রার ডাক মন্দ লাগে না। পাশের টেবিল থেকে উঠে গেলো অন্য একটি পরিবার। ওদের ব্যাগ গোছানো হয়ে গেছে। ওরা রওনা দেবে। গেটের পাশে দাঁড়িয়ে আছে ওদের প্রাইভেট কার। পাহাড়ি জনপদ মানেই এক রাতের অতিথি। কে আসে কোথা থেকে, কেউ বা চলে যায় কোথায়! সম্পর্ক বলতে পরে থাকে শুধু মোবাইলে তোলা কতগুলো ছবি আর কিছু ভিডিও টাইমলাইন। তাও যদি খুব পুরাতন হয়ে যায়, তখন মেমরি ফাঁকা করতে গিয়ে ফাঁকতালে মুছে যায় স্মৃতি। খোপাখুপি লোহার খাঁচায় দুটো খরগোস হুটোপুটি করছে। কাজের লোক সাতসকালে খাঁচাতে রেখে গেছে অনেকগুলো ঘাস পাতা।

লম্বা ব্যালকোনিতে সকালের মিষ্টি রোদ এসে পড়েছে। সকালের চায়ের সাথে ওমলেট সহ বাটার টোস্ট। মন ভালো করা তৃপ্তির অনুভূতি। আর দেরি করা যাবে না। ঘড়িতে কাঁটায় কাঁটায় ৯টা বাজে। এক্ষুনি ক্যাম্প ক্লোজিং করে বেড়িয়ে পরতে হবে মংপু। না,না মংপু না। রম্ভী। কি জানি! তবে কোথাও তো একটা বটেই। সন্ধ্যে নামার আগে বলতে পারি না ঠিক কোথায় যাচ্ছি। আসলেই আমাদের কোনো গন্তব্য নেই!

যোগিঘাট

টেন্টের মধ্যে থেকে ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিয়ে রওনা দিলাম লোয়ার সিটং থেকে। পাহাড়ি পথে দু’তিনটা বাঁক ঘুরতেই যোগিঘাট। উঁচু থেকে ছবির মত দেখতে লাগে নদীর সমান্তরালে সবুজ আবাদি জমি। পথে কোনো চোরবাটো নেই। বাসরাস্তা বরাবর সামান্যই হাঁটা পথ। মেরেকেটে দুই কিমি। রেনখোলা নদীর উপর লোহার ব্রীজ। পাশেই পরিত্যক্ত জঙ্গলাকীর্ণ কাঠের ব্রীজ। ব্রীজ পেরিয়ে রাস্তা চলে গেছে ডানদিকে বেঁকে। আমরা পায়ে চলার রাস্তা ধরলাম বাঁয়ে। নদীর ধারে অনিল রাইয়ের ছোট্ট একটা ধাবা। ব্যাগগুলো গুছিয়ে রেখে, জামা কাপড় খুলে নেমে পড়লাম রেনখোলার ঠান্ডা জলে। ইতস্তত ছড়ানো পাথর। ঠান্ডা নুড়ি পাথরে পা রাখতেই কনকন করে। ইচ্ছে করছিল নদীতে হাত পা ডুবিয়ে স্নান করি। কিন্তু হঠাৎই সূর্য মুখ ঢাকলো মেঘে। ইতিমধ্যে বিশ্বজিৎ কোথা থেকে অনেকগুলো শুকনো কাঠ জোগাড় করে এনেছে। বড় একটা বোল্ডারকে গার্ড করে তিনটা ছোট পাথরের উপর ম্যাস্ট্রিনটা রেখেছে কুট্টিদা। বোতল থেকে জল ঢালছে কল্যাণদা। আর আমি বিন্দাস …… জামা কাপড় খুলে বড় একটা বোল্ডারের উপর বসে আছি গামছা পরে। বসে বসে ছবি তুলছি পাহাড় জঙ্গলের। কানের হেড ফোনে পুরাতন একটা হিন্দি গানে স্মৃতির রোমন্থন। রেন খোলাতেই আজ দুপুরের ক্যাম্প।

প্রকান্ড একটা বোগানভেলিয়ার গাছ। আর গাছ ভর্তি বেগুনি রঙের ফুল আলো করে আছে অনিল দাজুর ধাবা। ওই আর কি, পাহাড়ি ধাবা বলতে যা বোঝায়! কিচেন টয়লেট সহ একটা দোকান। ফ্রীজে রাখা কিছু খাবার একটা চুলা আর পরিমান মত মদ থাকলেই যেকোনো বাড়িই, পাহাড়ে হয়ে যায় ধাবা। গাড়ি পার্কিংতো ফ্রী। উপত্যকার ঢালু যে কোন জায়গায় গাড়ি পার্ক করানো যায়। আর অর্ডার করলেই গরম গরম পছন্দসই রান্না। সিগারেট কিনতে গিয়ে দেখি বাইরের গ্যাসের উনুনে চমরিগাই এর মাংস রান্না হচ্ছে। সুঘ্রানে ম ম করছে চারপাশ। ধাবার সামনে বেশ কতগুলো প্লাস্টিকের চেয়ার আর রংচটা টেবিল। টেবিলের উপর স্ট্যান্ড সহ মাল্টি কালারের ছাতা। পাঁচটি নেপালী ছেলে বিয়ারের নেশায় বুঁদ। সাথে একটা নেপালী গান। এক প্যাকেট সিগারেট চাইতেই দাজু কষা মাংসে কিছুটা জল ঢেলে কিচেন থেকে উঠে এলো।

— তপাই কো খানা চাহিয়ে?

— কিছুটা আমতা আমতা করে বলি, নেহি চাহিয়ে ।

খাওয়ার অর্ডার করার চেয়ে সেলফ কুকিং-এর মজাই আলাদা। তাছাড়া রান্না করতে কুট্টিদার জুড়ি মেলা ভার। তাই একপ্যাকেট সিগারেটের সাথে কিনে নিলাম সামান্য কিছু পেঁয়াজ আর গোটা কতক লঙ্কা। আজকের মেনু গরম চা, সাথে বিস্কুট। আর ম্যাগি।

ত্রিবেনী

খাওয়াদাওয়া করতে করতেই বেলা গড়িয়ে গেলো। এপথে গাড়ি খুব কম। নেই বললেই চলে। যারা আসে তাঁরা নিজেদের গাড়ি রিজার্ভ কারে আসে। অগত্যা আমাদেরও রিজার্ভ করতে হলো। অনিল দাজুর বাড়ির সামনেই হালকা শেডের ইন্ডিগো’টা দাঁড়িয়েছিল। ড্রাইভারের সাথে দরদাম করে উঠে পরলাম। যাচ্ছি রম্ভি। রিজার্ভ আটশো টাকা। পুর্বপরিকল্পনা মত আমাদের যাওয়ার কথা ছিল পনবু গ্রামে। পনবু থেকে একদিন ট্রেক করে কালিঝোড়াতে নেমে আসা যায়। সামথার প্ল্যাটোর দক্ষিণ দিকে পনবুর সেই অতীত স্মৃতি এখনো অমলিন। ১৯৯৮ সাল। আমি তখন উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষের ছাত্র। NESPON (NGO) এর সাথে অনেকে মিলে পূর্বখোলা হয়ে পনবু গ্রামে গেছিলাম সেবার নেচারস্ট্যাডি ক্যাম্পে। রাতে ক্যাম্প-ফায়ার, সবাই মিলে খিচুড়ি রান্না, পাঁপড় ভাজা, প্যাট্রোল করে রাত জাগা। পূর্ণিমার রাত ছিল। চাঁদের আলো ধুয়ে দিচ্ছে উপত্যকা। পূর্বখোলা নদীর জল চক চকে রুপোর মত। শুনশান নিস্তব্ধতা। টেন্টের বাইরে নিভু নিভু আগুন। জীবনের প্রথম ট্রেক!

যাওয়ার পথে পড়লো রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি বিজড়িত মংপু। এখানেই মৈত্রেয়ী দেবীর সান্নিধ্যে রবীন্দ্রনাথ কিছুদিন ছিলেন। বাড়িটা এখন সরকারী সংগ্রহশালা। রাস্তার পাশে কোল্ড ড্রিংস, জলের বোতল, পানমশলা আর চকচকে পাকা কমলা নিয়ে বসেছে দোকানি। ডিসেম্বর মাস। এখন পর্যটনের সময়। তবুও কোথাও কোনো পর্যটক চোখে পড়ল না। খুব ইচ্ছে করছিল এখানেই নেমে যাই। একদিন অন্তত থাকি। কিন্তু হাতে সময় খুব কম। আগামী দুদিনের মধ্যেই বাড়ি ফিরতে হবে। গাড়ি থেকে নেমে পঞ্চাশ টাকা দিয়ে হাফ ডজন কমলা কিনে নিলাম। রম্ভিতে ন্যাশানাল হাইওয়ের উপর গাড়িটা যখন আমাদের নামিয়ে দিলো। আমরা বুঝতে পারলাম এখান থেকে সামথারে যাওয়া অনেক হ্যাপা। নেট খুঁজে বিশ্বজিৎ জানিয়ে দিলো, তিস্তা বাজারের পাশেই ত্রিবেনী। নদী সমান্তরলে দেড় কিমি মত একটা চর। থাকার জন্য বেশ হবে। স্যাক পিঠে চাপিয়ে জলের বোতল হাতে নিয়ে ব্রীজ থেকে অনেকটা নীচে নামতেই বড় রাস্তা। তিস্তা নদীর এই দিকটা দার্জিলিং জেলা। ওপারটা সিকিম। বড় রাস্তা। হাঁটছি তো হাঁটছিই। পথ ফুরায় না। এদিকে দিনের আলো কমে আসছে। কুট্টি’দা তাড়া লাগায়। তিস্তাবাজার থেকে ত্রিবেনী দুই কিমি মত পথ। পিঠের স্যাকটা ঢিল হয়ে গেছে। কোমরে শক্ত করে বাঁধন দিয়ে আবার চলতে শুরু করি। পথ নদী সমান্তরাল ……

পাথুরে স্পার থেকে অনেকটা নীচে নেমে এসেছি। দুপাশে শাল সেগুনের জঙ্গল। বোঝাই যাচ্ছে প্ল্যান্টেশন। সরকারি ভাবে পর্যটন গড়ে তোলার চেষ্টা হয়েছিল ঘিসিং এর আমলে। তারপর রাজনৈতিক উত্থান পতনে গুরুত্ব হারায় ত্রিবেনী। রানিং ওয়াটার বলতে নদীর জলের উচ্চস্রোত। কোনো ইলেক্ট্রিফিকেশন নেই। প্রকান্ড এক সরকারি গেস্ট হাউস আছে বটে। তবে পুরোটাই ভুতুড়ে। দীর্ঘ দিনর অযত্নে পলেস্তরা খসে পড়েছে। দেওয়ালে বেড়ে উঠেছে আগাছা আর বটের চারা। বিবর্ণ রঙ। কেউ কোত্থাও নেই। নেমে এলাম বালির চরে। নরম বালিতে কোথাও কোথাও পা ডুবে যায়। অনেক গুলো টেন্ট খাটানো এদিকে ওদিকে। সিকিমের ট্রাভেল এজেন্টরা ইদানিং মল্লি থেকে ত্রিবেনী পর্যন্ত এই পথটাকে রিভার র‍্যাফটিং এ খুব প্রমোশন করেছে। রিভার র‍্যাফটিং সহ ট্যুর প্যাকেজের সাথে নিশ্চিন্তে থাকছে ক্যাম্পিং, ইন্টিমেট এসকেপ, ফিশিং, হাইকিং, ক্যাম্প-ফায়ার। টেন্টগুলোর দেখাশুনা করার জন্য দু একজন গ্রামবাসি আছেন বটে। কিন্তু তাদের দেখা মেলা ভার। সারাদিন প্রাত্যহিক কাজকর্মে সবাই ব্যস্ত। তবে কোম্পানি মারফত আগাম বুকিং থাকলে, নিশ্চিন্ত। উপস্থিত থাকবেই থাকবে। জুতা মোজা খুলে তিস্তার ঠান্ডা জলে পা দেই। বিশ্বজিৎ আর কুট্টিদা গেছে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করতে। থাকা নিয়ে কোনো টেনশন নেই। টেন্ট আমাদের কাছেই আছে। কিন্তু খাবো কি? একটা চানাচুরের প্যাকেট ছাড়া কোনো রেশন’ই তো নেই!

চোখেমুখে জলদিয়ে বসে আছি একটা বাঁশের বেঞ্চে। কল্যানদা মোবাইলে ক্যমেরায় ফ্রেমবন্দী করছে নদীর দৃশ্যকল্প। নিস্তব্ধ উপত্যকা। চোখ বন্ধ করে জলের স্রোতের শব্দ শুনছি। হঠাৎ নিস্তব্ধতা খানখান করে বিশ্বজিৎ এর চিৎকার। দুজনেই একসাথে ফিরে এসেছে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা পাকা করে। হুররে … আজকেও পেয়ে গেছি টেন্ট। আমার বয়ে আনা টেন্টটা আজও খাটাতে হচ্ছে না। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। অন্ধকার নেমেছে তিস্তার চর জুড়ে। অর্জুনদা আজ আমাদের কেয়ারটেকার। হিমশীতল অন্ধকার আর জলের আবর্তে আজ ত্রিবেনী’তেই আমাদের রাত্রি যাপন।

গতকালের থেকে আজকের টেন্টটা অনেক ছোটো। ভাড়াও বেশি। তিস্তা নদীর বেড বরাবর ঠান্ডা বাতাসের দাপট। চতুর্দিকে শিশিরের জল গড়াচ্ছে। টেন্টের দেওয়ালে হাত পড়তেই ছ্যাত করে উঠলো। আউটারের সাথে ইনারটা লেপ্টে গেছে। সন্ধ্যায় অর্জুনদা যখন টেন্টটা পাতছিল তখনই বুঝেছিলাম রাতে প্রবলেম হবে। একে তো কয়েকটা পেগ (টেন্ট আটকানোর জন্য ব্যবহৃত বড় পেরক) বালিতে হারালো। তার পরে আউটারটা ঠিকমত ক্লিপও করতে পারলো না। অনেকগুলো টেন্টের মালিক হলেও অর্জুনদা টেকনিক্যালি সাউন্ড নন। টেন্টের মুখ পূর্বদিকে। আমাদের পশ্চিমে মাথা। ভুমির ঢাল পশ্চিম থেকে পূর্বে। আমি শুয়েছি টেন্টের এক ধারে। চর জুড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে কয়েকটা কুকুর। বাইরের জঙ্গলে রাতে নানা রকম শব্দ। ঘুম আসে না কিছুতেই। ভোর তিনটা চল্লিশ মিনিট। বেশ শীত শীত করছে। নদী উপত্যকার বিপরীত দেওয়াল জুড়ে সারা রাত ধরেই লম্বা গাড়ির ক্যারাভ্যান। জাতীয় সড়ক 31A জুড়ে রাখে পাহার আর সমভূমিকে।

র‍্যাফটিং

sitong tushar 9

তিস্তা আর রঙ্গিত নদী দুটি তিস্তাবাজারের কাছে যেখানে মিশেছে, সেটাই ত্রিবেনী। ত্রিকোণাকৃতি একটা বালির বিচ। এই সঙ্গমটা র‍্যাফটারদের বেস ক্যাম্প। এখানে ক্যাম্পিং এর সুবিধাও রয়েছে। সুভাষ রাই আর মহম্মদ ফিরোজ এ’দুজন আমাদের এক্সপার্ট হ্যান্ড। এদের হাতেই জীবন বাজি রেখে আজ উঠেছি নৌকায়। তিস্তায় র‍্যাফটিং করার শখ বহুদিনের। দুধ সাদা ফেনিল জলরাশি। জলের স্রোত ভাঙছে তরঙ্গ মুর্চ্ছনায়। একটার পর একটা স্রোত উঠছে আর নামছে। “নি ডাউন” … “গেট ব্যাক” … ফিরোজের কথা মত একবার নামছি আবার উঠছি। নৌকার ঠিক সামনে আমি বসে। জলের আবর্তে ক্যাটার‍্যাক্ট গুলি এলেই মাথা নিচু করতে হচ্ছে। জলের ঝাপটা থেকে বাচার জন্য বার বার হাঁটুমুড়তে হচ্ছে। খরস্রোত এলেই ফিরোজ হাঁক পারছে… “নি ডাউন’।ইলাস্টিক রাবার ব্যান্ডের মধ্যে পা’টা কোনমতে ঢুকিয়ে নৌকার সামনের দড়িটা শক্ত করে ধরে নৌকার সামনে হাঁটু মুড়ে মাথা নিচু করতে হচ্ছে বারবার। মাথা নিচু করলেই বা কী! বরফগলা কালঠান্ডা জল আপাদমস্তক ভিজিয়ে দিচ্ছে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে উপত্যকার ঠান্ডা বাতাস। করাতের দাঁতের মত ঠান্ডা কামড়ে বসছে হাড়ে। বাকিরা শক্ত হাতে বৈঠা ঠেলছে। পার করছি একটার পর একটা ক্যাটার‍্যাক্ট। সকাল ১০টায় ২৭মাইল থেকে রওনা দিয়েছি। এখান থেকে বেনী ৭মাইল। সময় লাগে একঘন্টার কাছাকাছি। নৌকার ভাড়া সহ ফটো ডকুমেন্টেশন করতে লাগে মাথাপিছু হাজার টাকা। তিস্তাবাজারে চলে এলে দিনে দিনেই বুকিং করে নেওয়া যায় র‍্যাফটিংয়ের। মল্লি থেকে এই যাত্রাপথে মোট ছয়টি গ্রেড রয়েছে। তার মধ্যে ছয় নম্বর হার্ডেলটা সবচেয়ে বিপদজনক। নৌকা উল্টালে বড় বড় বোল্ডারের ধাক্কা আর ঠান্ডা জলাবর্তে বাঁচার আশা খুবই ক্ষীণ। সাঁতার জানাটা খুব জরুরি এই পথে এলে।


ফেসবুক অ্যাকাউন্ট দিয়ে মন্তব্য করুন


তুষার কান্তি দত্ত

জন্ম - ১৯৭৩। শিক্ষাগত যোগ্যতা - এম এ, বি এড। পেশা - শিক্ষকতা । বাড়ি - বালুরঘাট, দক্ষিণ দিনাজপুর। ভালো লাগে পাহাড় জঙ্গলে নিজের মত ঘুরে বেড়াতে কখন বন্ধুদের সাথে, কখনো বা একদম একা একা। ট্রেকিং ও অফবিট ট্রাভেলিং-এ সাচ্ছন্দ বধ করেন। সকাল সন্ধ্যে ছাদের বাগানেই কাটে সবুজের সান্নিধ্যে। মন হলেই রঙ তুলি হাতে নিয়ে বিমূর্ত ভাঙ্গা গড়ায় নিবিষ্ট অন্তর্মুখী....

0 Comments

মন্তব্য করুন

Avatar placeholder

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।