উজান ভাটির জল-জঙ্গলে

ধীরাজ সরকার on

ভাটার টানে মাতলা নদীর কালচে ঘোলাটে জলে শুকনো পাতা ঘুরপাক খাচ্ছে বিক্ষিপ্তভাবে। কাদার শুকনো চড়ে উল্টো করে  রাখা অর্ধ নির্মিত নৌকাটিতে সবে আলকাতরার প্রলেপ পড়েছে। কাচা পাকের কেমন একটা অ্যাসটা গন্ধ নাকে লাগছে!!!

-গন্ধটা পাচ্ছো না তোমরা??

-চেনা গন্ধ একটা!!

-প্রতিবার বন্যায় যখন আত্রেয়ীর জল আমাদের উঠান ছেড়ে চলে যেত, তখন গন্ধটা পেতাম।

-তাই না!!

ইঞ্জিনের ভুট্ ভুট্ শব্দটা বিরক্ত লাগছে। ইঞ্জিন ঘরের পিছনে ডেকের মতো ফাকা চাতাল। বেশ ভালো লাগছে। শরীর স্পর্শ করছে শীতল বাতাসকে। নদীর দুধারে ঘন সবুজ জঙ্গল, মাথার উপর নীল চাদরের মতো  বিস্তৃত হয়ে নীলাকাশ। ঘোলাটে স্থির জল, সবুজ অরণ্য আর চার পাশের নিস্তব্ধতা যেন জল রং-এ আকা ক্যানভাসের মতো নিশ্চল। অল্প জলে দাড়িয়ে ধানীঘাস বাতাসের তালে দুলছে, তাদের মাঝে মাঝে নলখাগড়া,ধুধুল,খলসে,গর্জন, কাকড়া বকুল, গোলপাতা আর হেতালের প্রাকৃতিক জঙ্গল। পাড়ের দিকে ম্যানগ্রোভের গভীর জঙ্গলে কেওড়া, গেউ, গড়ান, সুন্দরী ও বাইনের ঠেসমূল আগলে রেখেছে সুন্দরবনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যকে। মাটি ফুড়ে বেরিয়ে আছে ম্যানগ্রোভের শ্বাসমূলগুলি। হাজার হাজার বছর ধরে বঙ্গোপসাগর বরাবর আন্তঃস্রোতীয় প্রবাহের দরুন প্রকৃতিকভাবে উপরিস্রোত থেকে পৃথক হওয়া পলি সঞ্চিত হয়ে গড়ে উঠেছে সুন্দরবন। এর জৈবিক উপাদানগুলো বিশেষ ভূমিকা রাখে  প্রাণী ও উদ্ভিদ বৈচিত্র্যের ক্ষেত্রে। এর জলা জঙ্গলে প্রায় ১০০টির বেশি প্রজাতির ম্যানগ্রোভ জন্মায়। রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার, চিত্রা হরিন, কুমির, কচ্ছপ,গিরগিটি, গুইসাপ,শেয়াল,বুনো মহিষসহ অসংখ্য প্রজাতির আবাসস্থল। অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুতে সুন্দর বনের আয়তন ছিল বর্তমান আয়তনের প্রায় দ্বিগুণ। বনের উপর মানুষের অধিক চাপ ক্রমান্বয়ে এর আয়তন সংকুচিত করছে। প্রশ্ন জাগে…..!! এভাবে বিশ্বায়নের বাণিজ্যিকরণে পৃথিবী থেকে সব অরণ্য একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে না তো!!

লঞ্চের ছোট ইঞ্জিন ঘরটিতে ডাক দিলেন  সারেং  শম্ভুদা। লঞ্চ বা বড় নৌকার প্রধান মাঝি বা চালককে সারেং বলে।আরও একজন সহকারী চালক থাকে ইঞ্জিন ঘরের নীচে ডেকের ভিতরে। সারেং প্রয়োজন মতো হাতে টানা সূতো দিয়ে ঘন্টা বাজিয়ে বার্তা দেয় আর সহকারী চালক নির্দেশ মতো লিভার ঘুরিয়ে গিয়ার পরিবর্তন করে।

কয়েকজন লোক বুক সমান জল ঠেলে খাড়ির ডান দিকে পাড়ে উঠে জঙ্গলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।

-কোথায় যাবে ওরা?

প্রশ্ন করতেই শম্ভুদা বলে-

-মৌলের দল।

বুঝতে না পেরে জিঞ্গাসা করলাম

-মানে?

জলের দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে বললেন

-মধু সংগ্রহকারীদের দল।

হাজার হাজার লোক এভাবে পেটের টানে জীবন হাতে করে প্রতিদিন পেরিয়ে যায় জল জঙ্গল। কেউ যায় কাঠ কুড়াতে, কেউ আবার মধু সংগ্রহ করতে। তাদের  কারও হয়তো এটাই অগস্ত্য যাত্রা  আর ঘরে ফেরা হয় না। পেটের তাগিদে অনেক কিছুই মেনে নিতে হয়। শম্ভুদা বেশ গুছিয়ে কথা বলে। স্টীয়ারিংয়ে হাত রেখে বলে যায়…..

জঙ্গলে মধু সংগ্রহকারীদের স্থানীয় ভাষায় মৌলে বলে। তাদের দলে একজন  পোকাচালাক, একজন গুণীন আর একজন তাড়ানি থাকে। মৌমাছিকে ওরা পোকা বলে। পোকাচালাক মৌচাকের সন্ধান দেয়, গুণীন মন্ত্রবলে সবাইকে বাঘের হাত থেকে রক্ষা করে আর তাড়ানি মৌচাক থেকে মৌমাছি তাড়াতে বিশেষজ্ঞ।

-হঠাত সবাই চিৎকার করে উঠে…

-ঐ যে পাড়ের দিকে একটা কুমীর দেখা যাচ্ছে।অলস মেজাজে রোদ তাপাচ্ছে। আমরা সুন্দরবনের কোর এলাকায় ঢুকে পরেছি। শম্ভুদা তাই সবাইকে চুপ করে বসতে বললেন। লক্ষ্য করলে দেখা যায় দুপাড়ের ঘন জঙ্গল উচু করে লাইলনের জাল দিয়ে ঘেরা । এখানেই বাঘেদের অবাধ বিচরন। এই জায়গা গুলোতে অনেক সময় ওরা আসে মিষ্টি জলের খোজে। এটা নোয়াখালি- শম্ভুদা চিনিয়ে দেয়।

-এখানেই মাস দুয়েক আগে একটা বাঘ জঙ্গল থেকে বেরিয়ে লোকালয়ে ঢুকে পড়ে। আজকের ভাগ্যটা ভালো থাকলে বাঘের দেখা মিলতেও পারে।

জঙ্গলখালি, সুন্দরখালি, পীড়খালি, সুদনোখালি, সবকখালি, গাজিখালি একটার পর একটা খাড়িতে বিরামহীনভাবে এগিয়ে চলছে লঞ্চটি। দেহের রক্ত জালকগুলো পরস্পরের সাথে জুড়ে যে ভাবে রক্ত বয়ে নিয়ে যায় ঠিক যেন সেভাবেই গাঙ্গেয় উপকূলের প্রতিটি নদ-নদী পরস্পর জুড়ে নিশ্চল গতিতে প্রবহমান।

নরম মাটির সরু গর্ত থেকে পা বাড়িয়ে বেরিয়ে আসছে লাল কাকড়াটি। ছিপ্ ছিপ্ জলের মধ্যে ভেসে বেড়াচ্ছে ব্যাঙাচির ঝাক। এটা সজনেখালি। Eco Tourism Spot of Sundarban Tiger Reserve এর অন্যতম অংশ। রাস্তার একপাশে সুন্দরী, গরান, গেউ,গর্জন ম্যানগ্রোভ প্রজাতির বাগান সারিবদ্ধভাবে সাজানো। বামপাশে কচ্ছপ প্রজনন কেন্দ্রের ক্যাম্পাস। দিন দিন হারিয়ে যেতে বসেছে এই প্রজাতিটি। একদিন হয়তো হারিয়ে যেতে পারে, তাই অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদেই তৈরি এই প্রজনন কেন্দ্রটির। ওয়াচ টাওয়ারটি থেকে যতদূর চোখ যায় শুধু ম্যানগ্রোভের ঘন জঙ্গল আর মাঝে মাঝে কৃত্রিমভাবে তৈরি মিষ্টি জলের জলাধার চোখে পরে। সমুদ্র উপকূলবর্তী হওয়ায় প্রাকৃতিক জলাধার গুলোর জল তুলনামূলক  নোনতা, তাই এই ব্যবস্থা। বাঘেরা এখানে নিয়মিত  জল পান করতে আসে। ইট বাধানো সরু রাস্তায় যেতে যেতে চোখে পড়ল বনবীবির মন্দির। বাহন বাঘের উপর উপবিষ্ট বনবীবি, পাশে হাত জোড় করে দাড়িয়ে ভক্ত দুঃখে। প্রবৃত্তির বশে অজান্তেই দুই হাত জোড় করে কপালে ঠেকাই। গরমে গলা শুকিয়ে গেছে।সিমেন্ট বাধানো বেঞ্চে বসি। বোতলের জলে গলা ভেজাই। একদল বানর অর্জুন গাছের উচু ডালটি ধরে লাফালাফি করছে। হালকা বাতাসের তালে কাপতে থাকে কাকড়া বকুলের পাতাগুলি। দুপুর ১টা ৪০মিনিট। ডাক পড়ল ডেকের ডাইনিংয়ে।কাঠের পাটাতন, কোঠা সদৃশ নীচু ছাদ, দুই দেওয়াল স্পর্শ করে লম্বালম্বি বেঞ্চ, নীল-সাদা এনামেল পেইন্ট। সাদা মেলামাইনের ডিসে প্রত্যাশিত দুপুরের খাবার গরম ভাত, স্যালাড,মুসুর ডাল, আলুভাজা আর চিংড়ির মালাইকারী।

ঘন ঘন বাশের বেড়া দিয়ে নদী বাধকে ভাঙ্গনের হাত থেকে বাচানোর প্রয়াস লক্ষ্য করি দূর থেকে। এটা দোবাকি। সজনেখালি থেকে প্রায় দুঘন্টার পথ জলপথে।ইট বাধানো কয়েকটা খাড়া সিড়ি, উপরের সিড়িতে তোড়ণ দ্বার। বড় করে লেখা দোবাকি ক্যাম্প, সুন্দরবন টাইগার রিজার্ভ। এটাও সুন্দরবন বাঘ সংরক্ষন অঞ্চলের অন্যতম অংশ। দূর্ভেদ্য জঙ্গলের মাঝে মাটি থেকে প্রায় ১২ফুট উচু এবং ২৫০ মিটার লম্বা কংক্রিটের রাস্তা। চার পাশটা লোহার তারের জাল দিয়ে ঘেরা।প্রকৃতির অবাধ ভূমিতে বন্য প্রাণীদের দেখার সুযোগ পাওয়া যায় এখান থেকে। কয়েকটা চিত্রা হরিণ, ময়ূর আর একটা বড় প্রজাপতি ও গিরগিটি চোখে পড়ল।

সূর্যের শেষ বেলার রোদ মাতলার জলে ঝলমল করছে। দিগন্তে রঙিন আভা। পাখিদের ঝাক এক এক করে বাসায় ফিরছে। প্রফুল্ল সবাইকে বিকালের চা ও টিফিন দিয়ে যায়। মুরি-চানাচুর সঙ্গে কয়েকটা করে গরম তেলে ভাজা।অতিথিশালার লাল বাতির চেনগুলি স্পষ্ট হচ্ছে ধীরে ধীরে। মনে হয় আর একটু পরেই পৌছে যাব পখিরালয়ে। আজ এখানেই আমাদের রাত্রিবাস। সন্ধ্যে হতেই- অতিথিশালার সামনে ফাকা মাঠটিতে কয়েকজন স্থানীয় লোক জড়ো হয়েছে। সবার শরীরে হত দারিদ্র্যের পুরু প্রলেপ। সরল দৃষ্টিতে সরল সংলাপে ব্যস্ত  নিজেদের মধ্যে। কিছুক্ষণ পর বুঝলাম দিনের কাজের শেষে অতিথিশালা গুলোতে স্থানীয় লোকেরা লোকপালা পরিবেশন করে কিছু বাড়তি উপার্জনের আশায়। শুরু হল বনবীবি- দক্ষিণরাই ও কাঠুরিয়াকে নিয়ে লোককথা সমন্বিত লোকপালা। কাঠ কুড়াতে গিয়ে পথ হারিয়ে ফেলেছে পরান। সূর্য ডুব ডুব।  অন্ধকার হয়ে আসছে। গভীর জঙ্গলে পথ খুজতে গিয়ে পড়ল সুন্দর বনের নর খাদক বাঘ ছদ্মবেশী দক্ষিণরাইয়ের সামনে। ভয়ে স্মরণ করতে লাগল দেবী বনবীবির নাম, শেষে বনবীবির কৃপায় রক্ষা পেল সে। শেষে সবাই একসঙ্গে গেয়ে উঠল—

সুন্দরবনের সুন্দরী,

রূপ-গুনে রূপসী….

বনবীবি বা বনদেবী এখানকার হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে সবার আরাধ্যদেবী। অবাক হয়ে যাই…!! দুটি ধর্ম এভাবে একাত্ম হতে পারে জেনে। সমুদ্রে মাছ ধরতে যাওয়ার আগে, জঙ্গলে কাঠ কুড়াতে যাওয়া বা মধু সংগ্রহ করতে যাওয়া আগে সবাই বনবীবির পূজা দেয়, বন্দনা করে, কেউ চাল, কলা,  বনের ফলমূল,মধু মানত করে। সকলের বিশ্বাস জঙ্গলের দৈত্যরাজ দক্ষিণরাই বাঘ ছদ্মবেশে আক্রমণ করলে বনবীবি রক্ষা করেন তাদের।

ঘড়িতে চোখ পড়তেই চমকে যাই রাত প্রায় ১১টা। চারপাশে গাঢ় অন্ধকার। ঝি ঝি পোকার ডাক।বাতাসের সন্ সন্ শব্দ আর জ্বলন্ত জোনাকিদের ছোটাছুটি গভীর অরণ্যে রাত্রিযাপনের রোমাঞ্চকর অনুভূতি এনে দেয়। গুলিয়ে ফেলি বর্তমান ও অতীতের সময়কে। চোখ বুজে অপেক্ষা করি আরও একটা নতুন দিনের নতুন যাত্রার।

পখিরালয়, সুন্দরবন

৩০শে অক্টোবর, ২০১২.

ফেসবুক অ্যাকাউন্ট দিয়ে মন্তব্য করুন


ধীরাজ সরকার

জন্ম ১৯৭৯ সালে দক্ষিণ দিনাজপুরের কুশমন্ডিতে। বর্তমানে বালুরঘাটে স্থায়ীভাবে বসবাস। পড়াশুনা বালুরঘাট হাই স্কুল, বালুরঘাট কলেজ, NBU থেকে। পেশায় শিক্ষকতা। ভালো লাগে রং,তুলি,ক্যানভাস আর গন্তব্যহীন ভ্রমণ নেশায় মজতে। অবসর সময়ে কাগজ কলম সঙ্গী করে প্রকৃতির অনাবিল আনন্দ ভাগ করে নিতে ভালোলাগে অক্ষরের মাধ্যমে নোটবুকের পাতায়।।

0 Comments

মন্তব্য করুন

Avatar placeholder

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।