জীবনপুরের পথিক

শুভদীপ আইচ on

“আমি আংটি চাটুজ্জের ভাই” – ১৯৬৩-র প্রেক্ষাগৃহ তখন এই সংলাপে মন্ত্রমুগ্ধ। হল থেকে বেরিয়ে মুখে মুখে ফিরছে এই ছবির সংলাপ আর অসাধারণ সব গান। তবে তার থেকেও বেশি চর্চায় এই সিনেমার নায়ক তথা কেন্দ্রীয় চরিত্রের অভিনেতা সত্যেন দাস। কি চমকে গেলেন নাকি? আসলে সিনেমায় নামার আগে অনুপ কুমার এর আসল নাম ছিল সত্যেন দাস। এটি আসলে সেই স্বপ্নের চরিত্র যার জন্য একজন অভিনেতা সারাটা জীবন অপেক্ষা করে থাকেন। জমিদারের ছেলে হয়েও সমস্ত সুখ, স্বাচ্ছন্দের জীবন ছেড়ে এই যে পলাতক হয়ে যাওয়া সেই ব্যাধি তখন সংক্রমণের মতো ছড়িয়ে পড়ছে গোটা বাংলায়। জীবন সম্পর্কে এই উদাসীনতা ও বোহেমিয়ানিজম তখন বাংলার তরুণদের ঘরে ঘরে। ফলে তরুণসমাজ এই সিনেমার সাথে নিজেদের খুব ভালোভাবে মেলাতে পারলো। কিন্তু এত সংক্ষেপে এই ছবির গুরুত্ব বোঝাতে গেলে তা অসম্পূর্ণ হবে। আসলে এই বসন্ত চাটুজ্জে ওরফে “আংটি চাটুজ্জের ভাই” যেন আপামর হেরে যাওয়া, প্রতিভার যোগ্য সম্মান না পাওয়া অসংখ্য জুনিয়র আর্টিস্ট ও বঞ্চিত মানুষদের প্রতিভূ হয়ে দাঁড়ালো। কমেডি ও পার্শ্ব-অভিনেতার বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে আত্মপ্রকাশ করলেন একজন সর্বহারার নায়ক ‘অনুপ কুমার’। এই জয় আসলে অনেক স্ট্রাগলারেরও জয়। যারা দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা করে যাচ্ছেন একটু কল্কে পাওয়ার, কবে একটু ভাগ্যের শিকে ছিঁড়বে এই আশায়। ভুবনমোহিনী হাসি আর ডায়লগ ডেলিভারির চকিত বিদ্যুৎখেলায় বাঙালি খুঁজে পেল তার নতুন নায়ককে। অনুপ কুমার সেরা অভিনেতার সম্মান পেলেন বেঙ্গলি ফিল্ম এন্ড জার্নালিস্ট এসোসিয়েশন (BFJA Award) এর দ্বারা।

মনে রাখতে হবে তরুণ মজুমদার যখন অনুপ কুমারকে এই ছবির লিডরোলের জন্য কাস্ট করেন তখন উত্তম ও সৌমিত্র দুজনেই কেরিয়ারের শিখরে অবস্থান করছেন। এবং ঠিক দু বছর আগেই ১৯৬১ তে মুক্তি পেয়েছে তপন সিনহার “ঝিন্দের বন্দী”। যেখানে সমানে সমানে টক্কর দিয়েছেন উত্তম ও সৌমিত্র। তবুও তরুণ মজুমদার বেছে নিয়েছিলেন এই অনুপ কুমারকেই। আসলে এই চরিত্রের জন্য যে কাঁচা ও ফ্রেস লুক এর দরকার ছিল তা হয়তো তিনি ছাড়া অন্য কেউ জমিয়ে তুলতে পারতেন না। সন্ধ্যা রায় এর সাথে তাঁর জুটি যেমন জনপ্রিয়তা পেল, তেমনই রুমা গুহ ঠাকুরতার সাথে তার পর্দার রসায়ন এক অন্য মাত্রা দিলো। বস্তুতঃ রুমা গুহকে এই চরিত্রে কাস্ট করাটাও তরুণ মজুমদারের এক মাস্টারস্ট্রোক বলা যেতে পারে। পরবর্তীতে কিশোর কুমারের সহধর্মিনী রুমা নিজেও ছিলেন একজন সুগায়িকা। দূরদর্শন ও বেতারের বিভিন্ন শোতে তাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে।

কিন্তু কিভাবে একটি আপাদমস্তক মিউজিক্যাল ফিল্মে অনুপ কুমার নিজেকে এত মানিয়ে নিলেন ও প্রাণ ঢেলে অভিনয় করলেন তার বীজ নিহিত আছে অনেক গভীরে। তাঁর বাবা ধীরেন্দ্রনাথ ছিলেন একজন সুগায়ক ও অভিনেতা। যিনি কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গেও কাজ করেছেন। সেই রক্তের টানেই হোক বা ঐশ্বরিক প্রতিভার জোরে তিনি নিজেকে নতুন করে প্রতিষ্ঠা করলেন বাংলা সিনেমার জগতে।

অনুপ কুমারের অভিনয় জীবনের শিক্ষা বাবার হাত ধরেই। এছাড়াও আরো একজনের নাম না বললেই হয় তিনি হলেন শিশির কুমার ভাদুরী। নব্য বাংলা থিয়েটারের পথিকৃৎ এই নাট্যকার ও অভিনেতা অনুপ কুমারকে যেভাবে আবিষ্কার করেছিলেন তা নিঃসন্দেহে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ।

১৯৩৮ এ ধীরেন কুমার গাঙ্গুলির “হালকথা” সিনেমায় শিশুশিল্পী হিসেবে তাঁর আত্মপ্রকাশ। পিতা ধীরেন দাসের অকালে চাকরি চলে যায় আকাশবাণী থেকে। ফলে শিশু অভিনেতা হিসেবে টালিগঞ্জ পাড়ায় কাজ শুরু করেন। পরে স্টার থিয়েটারে মহেন্দ্র গুপ্ত ও শিশির কুমার ভাদুড়ির প্রশ্রয়ে পেশাদার রঙ্গমঞ্চের নিয়মিত মুখ হয়ে ওঠেন। পাশাপাশি চলতে থাকে সিনেমার কাজ।  তারপর 1948 থেকে ধারাবাহিক ভাবে তার একজন পূর্নশিল্পী হিসেবে অভিনয় জীবন। সে হিসেবে ” পলাতক ” তাঁর ৯৩ তম সিনেমা। সন্ধ্যা রায় ও অনুপ কুমার জুটি পলাতক, নিমন্ত্রণ (১৯৭১) বা ঠগিনীর মত সিনেমায় যেভাবে সাড়া ফেলেছিল, তাতে অচিরেই হয়তো তাঁর নায়কের সম্মান পাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে তাঁকে সেভাবে আর ব্যবহার করতে দেখেনি বাংলার দর্শক। থিয়েটার অভিনেতা হিসেবে বাংলা নাট্য একাডেমি পুরস্কার ও জিতে নেন ১৯৮৯ সালে। সিনেমা ও থিয়েটারের পাশাপাশি যাত্রাশিল্পেও তাঁর অবদান কম নয়। ১৯৯১ এ তিনি যাত্রাশিল্পে বিশেষ অবদানের জন্য সেরা পরিচালক এর সম্মান পান। “শিরোমনি পুরস্কার” ও লাভ করেন। ১৯৯৭ সালে BFJA তাঁকে অভিনয় জীবনের পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে বিশেষ সম্মাননা প্রদান করে। সারাজীবন কমবেশি ৩৪০ টির মতো সিনেমায় অভিনয় করেছেন। The Wall এ শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় একটা ভালো কথা বলেছিলেন, “উত্তম কুমারের জমানার আগে থেকেই অনুপ কাজ করেছেন বাংলা ছবিতে। উত্তম-সুচিত্রার সঙ্গেও কাজ করেছেন। আবার উত্তম-প্রয়াণের পরেও তাপস পাল থেকে প্রসেনজিৎদের বন্ধুর রোলেও অনুপ কুমার নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়েছেন। এই যে অভিনয়ের অভিযোজন, এ কিন্তু সহজ কথা নয়। ইন্ডাস্ট্রির এই যুগবদলে অনেকেই হারিয়ে যান, কাজ কমে যায়। অনুপ কুমার সব যুগেই ছিলেন সদর্পে।”

প্রবল অর্থাভাবের ফলে শুরু থেকেই বেছে নিয়েছিলেন অনেক বেশি সিনেমা করবেন। ফলে ভালো সিনেমার পাশাপাশি প্রচুর ট্র্যাশ সিনেমাও তাঁকে করে যেতে হয়েছে। সেটাও একটা কারণ যে জন্য তাঁকে পার্শ্ব অভিনেতা ও কমেডিয়ান ছাড়া লিডরোলে সেভাবে কেউ কাস্ট করলো না। সুমিত্রা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে ‘ডাক দিয়ে যাই’ তাঁর একটি অনবদ্য কাজ। অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় অনুপ কুমার-সন্ধ্যা রায় জুটি নিয়ে বানালেন ‘নতুন জীবন’। সেটিও কম জনপ্রিয়তা পায়নি।

তবে জীবনে একটা সময় প্রবল কষ্টে থাকলেও বিপদের সময় বহু মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। ইন্ডাস্ট্রির কাছে তিনি ছিলেন সবার প্রিয়। বিখ্যাত অভিনেত্রী গীতা দে – র মেয়ের এপেন্ডিক্স অপারেশনের খরচ তিনিই প্রথম জোগাড় করে দেন। পরে তা শোধ করে দিলেও বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে গীতা দে এই বিপদের দিনে পাশে দাঁড়ানোর জন্য অনুপ কুমারের নাম আলাদা করে স্মরণ করেছেন। মৃণাল সেনের সংসার জীবনও তাঁর ই সহায়তা পেয়েছে একটা সময়। বস্তুত মৃনাল সেনের স্ত্রী গীতা সেন ছিলেন অনুপকুমারের মামাতো বোন। সহকর্মী এইসব বিখ্যাত মানুষদের পাশাপাশি তিনি পাশে দাঁড়িয়েছেন টেকনিশিয়ানদের জন্যেও। অভিনেত্রী সংঘের যে সংগ্রামী ইতিহাস আমরা ভুলতে পারি না অর্থাৎ ন্যুনতম মজুরির দাবিতে টেকনিশিয়ানদের ধর্মঘট– সেই আন্দোলনে মূল স্তম্ভ হয়ে টেকনিশিয়ানদের পাশে দাঁড়ান ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় আর অনুপ কুমার।

আজ ৩ রা সেপ্টেম্বর। উত্তমকুমারের জন্মদিন। আর অনুপ কুমারের পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার দিন। বেঁচে থাকলে এখন তার বয়স নব্বই বছর হতো। স্বর্গে গিয়েও তিনি সেই পার্শ্ব-অভিনেতাই রয়ে গেলেন। এখনো উত্তম আলোয় তিনি একইরকম ঢাকা পড়ে আছেন। আজ সারাদিন যত বা উত্তম-চর্চা তার চেয়ে অনেক কম অনুপকে নিয়ে চর্চা হবে। তবু “দক্ষিণের জানালা” -র থেকে এইটুকু চেষ্টা থাকলো যদি একজনও এই লেখা পড়ে তাঁকে নিয়ে নতুন করে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। নায়ক না হোক অন্তত সেলুলয়েডের ইতিহাসে একজন প্রবাদপ্রতিম অভিনেতা হিসেবে যদি তাঁকে ভাবী প্রজন্ম মনে রাখে সেটাই সূত্রধার হিসেবে অনেক বড় প্রাপ্তি।


● ঋণ স্বীকার :

১. উইকিপিডিয়া
২. দ্য ওয়াল ও শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়


ফেসবুক অ্যাকাউন্ট দিয়ে মন্তব্য করুন


শুভদীপ আইচ

জন্ম : ১৭ ই ফেব্রুয়ারি , ১৯৮৬ , কলকাতা। নিবাস - দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার বালুরঘাট শহরে। প্রকাশিত কবিতার বই মেঘ পিওনের চিঠি ( ২০১৭ ), নিঃশ্বাস, প্রেম ও অন্যান্য অনুষঙ্গ ( ২০২০ )।

0 Comments

মন্তব্য করুন

Avatar placeholder

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।