শ্রী সমর চক্রবর্তীঃযে শুধু নিজেকে দেখছে নিজের দুপুর থেকে দূরে বসে

কৌশিকরঞ্জন খাঁ on

কবিরা যখন চলে যান তখন আকাশও কাঁদে। আসলে প্রকৃতির নিজস্ব খেয়ালে বেড়ে ওঠা সন্তান কোল ছিঁড়ে চলে গেলে দুঃখে বানভাসি কে না হয়! সমর চক্রবর্তীর প্রয়ানে তাই শিলিগুড়ি সমেত গোটা উত্তর বাংলার কবিতাজগৎ শোকসন্তপ্ত। এই বেদনা বহনকরা সত্যিই দুঃসাধ্য। একটা বেদনার ভাওয়াইয়া যেন তরাই থেকে ডুয়ার্স, ডুয়ার্স থেকে আত্রেয়ী– পুনর্ভবা– টাঙ্গন বিধৌত সমতলে পাক খেয়েই চলেছে কবির মৃত্যুতে।

তাঁর অনেক পরিচয়। একেকজনের কাছে একেক রকমের। পছন্দ মতো নির্বাচন করে নেওয়ার অধিকার দিয়ে গেছেন সমর চক্রবর্তী মানুষের কাছে। কখনো তিনি বোলপুর শান্তিনিকেতনের ইংরেজি সাহিত্যের তুখোড় ছাত্র তো কখনো শিলিগুড়ি কলেজের প্রথিতযশা যশা অধ্যাপক। আবার তাঁর বোহেমিয়ান জীবনের অনেক সাক্ষী শিলিগুড়ি শহরের অন্ত্যজ মানুষ।সবার আপন ছিলেন তিনি। তিনি নিজের হাতেই নিজের ক্লাস ভেঙেছেন। সবকে ছাপিয়ে একসময় হয়ে উঠেছিলেন কবি। তিনি তাঁর প্রতিটি শব্দবয়নের কৃতিত্ব প্রকৃতিকেই দিয়ে যেতে চেয়েছেন। তাই তিনি লিখেছেন –”এই সেই পাখির কবিতা একলাইন তুমি যার বাকিটা লেখোনি।” তাঁর কবি পরিচয় তাঁর নিজস্ব নির্মান নয়। প্রকৃতির অবারিত সত্যের মতো তাঁর কবি পরিচয়। যেভাবে আকাশে শ্রাবণ ঘনিয়ে আসে, বাড়ির কার্নিশ ছুঁয়ে বিদ্যুত চমক খেলে যায়, তারপর কোনো এক শরতে মেঘেরা সন্তান প্রসব করে কাশফুলের প্রান্তর জুড়ে, সেই ভাবেই প্রকৃতির নিজস্ব নিয়মে ভাওয়াইয়ার গোপন ফিসফাসে কবি হয়ে উঠেছিলেন তিনি। তিনি কবিতায় নিজেকে দ্রবীভূত হতে না দিয়ে পাড়ে দাঁড়িয়ে থেকেছেন সঙ্গোপনে।তাই তাঁর কথায় আমরা পাই – “যে লোকটা মাছ ধরছে / যে শুধু নিজেকে দেখছে নিজের দুপুর থেকে দূরে বসে।” তিনি লিখেছেন তিনটি কাব্যগ্রন্থ — পাঠ ও পতনের কবিতা, শিলা ও শৈলী বিষয়ক, অপরা অবাকপ্রতিমারা। আরো অজস্র অগ্রন্থিত কবিতা রয়ে গেছে জানা–অজানা লিটল ম্যাগে।কেননা স্বভাবে তিনি ছিলেন অগোছালো। কেউ তো নিশ্চয়ই ভালোবেসে তা সংগ্রহ করে সংকলিত করবে একদিন।

সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়টি হলো এই রকম একজন বোহেমিয়ান চরিত্রের মানুষ কবিতার জগৎ তো শাসন করতেই পারেন, কিন্তু তিনি শিলিগুড়ি প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের চেয়ারম্যানেরও গুরুভারও সামলেছেন কৃতিত্বের সাথে তিন বছর। আমরা যারা সুদূর বালুরঘাট থেকে সমর চক্রবর্তীর কবিতার সাথে পরিচিত ছিলাম শুধু তাদের কল্পনা করতেও কষ্ট হয় কিভাবে সেই কবি সাত ঝামেলার প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের চেয়ারম্যান পদ সামলে ছিলেন! কিন্তু তিনি সামলেছিলেন এবং কৃতিত্বের সাথে সামলে ছিলেন এটাই সত্য। জিনিয়াসরা সবই পারেন। কবি সমর চক্রবর্তীও তাই পেরেছেন।

তাঁকে বক্তার ভূমিকায় দেখার সুযোগ হয়েছে বেশ কয়েকবার। বোহেমিয়ান মানুষটি বাংলা কবিতা নিয়ে যখন সুমিষ্ট কন্ঠে বিশ্লেষণ করেছেন মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে, সময় কোথা দিয়ে চলে যায় তা বোঝার অবকাশ থাকতো না শ্রোতাদের।

তবে আড্ডার মেজাজে সমর চক্রবর্তী যেকোনো মানুষের কাছে তাঁর সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত রূপ। কথায় কথায় বুদ্ধিদীপ্ত উইট প্রয়োগ মিথের পর্যায়ে চলে গিয়েছিল কাছের মানুষগুলোর কাছে। একই বাসে যাত্রা করতে গিয়ে তিনি বলেছেন – এসো, “সহ–বাস ” করি। তিনি রসিকতা করে নিজের পান্ডুলিপিকে বলতেন “গান্ডুলিপি”। যারা সাহিত্য করেন কিন্তু মদ পান করেননা তাদের বলতেন” মদনা সাহিত্যিক”। হয়তো অল্প কিছুদিন বাদেই তাঁর সাথে দেখা হলো কিন্তু তিনি বলতেন, “তোমার সাথে একশ বছর বাদে দেখা হলো।” শব্দ!শব্দ! শব্দের জাগলারি ছিলো তাঁর কাছে নেশার মতো। তাই তাঁর অভিলাষ মতো আমরা তাঁর কবিতার পাঠকরাও চাই– “তটস্থ চোখের রোদে তোমার লাবন্য লেখা হোক।”

বালুরঘাটের সাহিত্য জগতের সাথে তাঁর সখ্য ছিল বহুদিনের। একাধিক লিটল ম্যাগাজিনের ডাকে সাড়া দিয়ে তিনি তিনি বেশ কয়েকবার বালুরঘাটে এসেছেন। সুদূর শিলিগুড়ি থেকে সেই মোবাইল ও স্যোসালমিডিয়াহীনতার যুগেও তিনি শুধু বাংলা কবিতার মাধ্যমে বালুরঘাটের অনেক আপনজন হয়ে উঠেছিলেন। গভীর প্রজ্ঞা নিয়ে তিনি শিলিগুড়িতে বসে যে শব্দ ছড়িয়ে দিয়েছেন কবিতায় কবিতায় তা শিলিগুড়ি ছাপিয়ে, উত্তরবাংলার নিজস্ব ভাষ্য হয়ে উঠেছিল কিভাবে যেন।

খুব অল্পদিনের ব্যবধানে উত্তরবঙ্গের দুই মহীরুহ দেহ রাখলেন। হ্যা অশ্রুকুমার সিকদার এবং সমর চক্রবর্তীর মৃত্যুতে গোটা উত্তরবঙ্গের সাংস্কৃতিক জগৎ বিষন্ন। এই বিষন্নতার কোনো আরোগ্য নেই উপশম নেই।
…………………………………………………..

ফেসবুক অ্যাকাউন্ট দিয়ে মন্তব্য করুন


কৌশিকরঞ্জন খাঁ

১৯৭৭ সালে জন্ম। বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর । সব রকম গদ্য লিখলেও ছোটগল্প ও উপন্যাস লিখতে বেশি পচ্ছন্দ করেন। আনন্দবাজার, নন্দন, কথাসাহিত্য, শিলাদিত্য, তথ্যকেন্দ্র, উত্তরভাষা, মোহিনী তে লেখা ছাপা হয়।

0 Comments

মন্তব্য করুন

Avatar placeholder

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।