আমীর আজিজের তিনটি কবিতা
অস্বীকার করছি
তুমি গুলিতে আমায় মেরে ফেলতেই পারো
কিন্তু গুলিতে আমরা মরেই যাবো, এটা জরুরি নয়।
হ্যাঁ স্বীকার করছি,
মৃত্যুকে আমরা ভয় পাই
কিন্তু ভয় পেয়ে আমরা ভীতসন্ত্রস্ত হব এটা জরুরি নয়।
আমি আদম ও হাওয়ার সন্তান
আমার মাতৃভূমি হিন্দুস্থান
মহম্মদ আমার নবী,আল্লাহ আমার খোদা
আম্বেদকর আমার শিক্ষক
বুদ্ধ আমার শুরু,নানক আমার গুরু
অন্ন আমার ধর্ম, প্রেম আমার ঈমান
আমি ভয় পেয়ে ভীত হওয়াতে
অপঘাতে মৃত্যুবরণ করতে অস্বীকার করছি।
আমি অত্যাচারকে অস্বীকার করছি
কারণ অন্যায় অত্যাচারকে অস্বীকার করা বিপ্লবের পথে এগিয়ে যাওয়ার প্রথম চরণ।
আমি পশ্চাদপসরণ করতে অস্বীকার করছি।
আমার প্রাণের ফয়সালা সাত ঘন্টার একটা সংসদ অধিবেশন থেকে হোক,
এটা আমার কাছে মঞ্জুর নয়।
আর আমার পরিচয়ের ফয়সালা কোনো পরিচয়পত্র থেকে হোক,
তা আমার কাছে মঞ্জুর নয়।
আমি এরকম সংসদ অধিবেশনকে, আমি এরকম পরিচয়পত্রকে অস্বীকার করছি।
আমারই দেশে আমাকে অধিকার দেওয়ার বদলে ভিক্ষা দেওয়া হবে
এটা আমার কাছে মঞ্জুর নয়।
আমাকে শুধুমাত্র একটা নামের মতো করে
কোনো রেজিষ্টারে লিখে দেওয়া হবে
এটা আমার কাছে মঞ্জুর নয়।
আমি অধিকারের বদলে ভিক্ষা দেওয়াকে
রেজিষ্টারে শুধুমাত্র কোনো নামের মতো করে লিখে দেওয়াকে অস্বীকার করছি।
আমি ক্ষতস্থানকে ফুল বলব?
অন্যায়কারীকে রসুল বলব?
কার্ফুকে লোকতন্ত্র বলব?
ঘৃণাকে নিয়ম বলব?
যে মিথ্যাকে সত্যি বলে
আমি এই প্রকার সমস্ত ভাষা কে অস্বীকার করছি।
সব মনে রাখা হবে
সব মনে রাখা হবে, সব কিছু মনে রাখা হবে,
তোমাদের লাঠি আর গুলিতে
খুন হয়েছে যে আমার বন্ধুরা
তাদের স্মৃতিতে আমাদের মনকে নষ্ট করেই রাখা হবে।
সব মনে রাখা হবে, সব কিছু মনে রাখা হবে।
তুমি কালিতে মিথ্যা লিখবে আমরা জানি
কিন্তু আমাদের রক্ত দিয়ে হলেও
সত্যিটা নিশ্চয়ই লেখা হবে।
সব মনে রাখা হবে, সব কিছু মনে রাখা হবে।
ভরদুপুরে মোবাইল টেলিফোন বন্ধ করে,
মধ্যরাতে গোটা শহরকে নজরবন্দী করে
সদলবলে হাতুরি নিয়ে আমার ঘরে ঢুকে পড়া
আমার মাথা, মুখ,আমার ছোট্ট জীবনকে ভেঙে দেওয়া
আমার কলিজার টুকরোকে চৌরাস্তায় অবলীলাক্রমে মেরে ফেলে
ভিড়ের মধ্যে লুকিয়ে থেকে তোমার মুচকি হাসি
সব মনে রাখা হবে, সব কিছু মনে রাখা হবে।
দিনের বেলায় সামনে এসে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলা
“সব কিছু ঠিক আছে, সব আচ্ছে হ্যায়!”
কথা বলতে গিয়ে তোতলানো
আর রাত্রি হলেই ন্যায্য দাবী চাওয়া লোকেদের উপর লাঠি,গুলি চালানো
আমাদের উপর আক্রমণ করে
আমাদেরকেই আক্রমণকারী বলা
সব মনে রাখা হবে, সবকিছু মনে রাখা হবে।
আমার হাড়ের উপর লিখে রাখবো এইসব কথা
তুমি যে চাইছো আমার অস্তিত্বের কাগজ
আমার অস্তিত্বের প্রমাণ তোমাকে অবশ্যই দেওয়া হবে।
এই যুদ্ধ তোমার শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত লড়া হবে।
এটাও মনে রাখা হবে কিভাবে তুমি দেশকে বিভাজন করার ষড়যন্ত্র করেছো
এটাও মনে রাখা হবে
কত সাধ্যসাধনা করে আমরা দেশের ঐক্য রক্ষার চেষ্টা করে গেছি।
এটাও মনে রাখা হবে
যখনই জগতে কাপুরুষতার কথা উঠবে,
তোমার কুকর্ম মনে রাখা হবে
আর যখনই জগতে জীবনরক্ষার কথা উঠবে
আমাদের নাম মনে আসবে।
কিছু লোক ছিল যাদের সংকল্প লোহার হাতুড়িতে ভেঙে পড়েনি
কিছু লোক ছিল যাদের আত্মা বিক্রি হয়ে যায় নি
ইজারাদারদের পয়সার কাছে।
(যেমনটা তোমাদের বিক্রি হয়ে যায়।)
কিছু লোক ছিল যারা
তুফান চলে যাওয়া অবধি অটল ছিল
কিছু লোক ছিল যারা নিজের মৃত্যুসংবাদ আসা পর্যন্ত বেঁচে ছিল।
চোখের পাতা পলক ফেলা ভুলে যায় তো যাক
পৃথিবী নিজের কক্ষপথে ঘোরা ভুলে যায় তো যাক
তবু আমাদের কাটা পাখনার ঝটফটানি আর আমাদের ফাটা গলার আওয়াজ মনে রাখা হবে।
তুমি রাত লেখো আমরা চাঁদ লিখব
তুমি জেলে পোরো,আমরা দেওয়াল টপকানো লিখব
তুমি এফ আই আর লেখো
আমরা ‘প্রস্তুত আছি’ লিখব।
তুমি আমাদের খুন করে ফেলো
বরং তুমি আমাদের খুন করে ফেলো।
আমরা ভুত হয়ে তোমার খুনের সমস্ত প্রমাণ লিখব।
তুমি আদালতে বসে চুটকি লেখো
আমরা রাস্তায় দেওয়ালে সুবিচার লিখব।
বধির ও শুনতে পায় এমন জোরে বলব
অন্ধও দেখতে পায় এতোটাই স্পষ্ট লিখব।
তোমরা কালো পদ্ম লেখো
আর আমরা লাল গোলাপ লিখব।
তোমরা মাটিতে অত্যচার লেখো আকাশে বিপ্লব লেখা হবে।
সব মনে রাখা হবে, সব কিছু মনে রাখা হবে।
যাতে তোমার নামে চিরকাল অভিশাপ করা যায়
যাতে তোমাদের কুকর্মে কালিমা লেপা যায়।
তোমার নাম,তোমার কুকর্ম মনে রাখা হবে।
সহানুভূতি ও ভিড়তন্ত্র
সাহেব আপনার সহানুভূতি শুধুই সরকারি
ভিড়ের হাতে আমার মৃত্যু থাকবে জারি
কাল খুনের বাহানা একটা পশু ছিল
আজ খুনের বাহানা একটা রোগে পরিণত হয়েছে।
বিহারের পাটনা শহরের এই ছেলেটি স্কুলের পড়াশোনা শেষ করে চলে আসে দিল্লির জামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে বাকি পড়াশোনা করতে।সিভিল ইঞ্জিনিয়ারের ডিগ্রি অর্জন করে ছেলেটি। তাঁর নিজের ভাষায়, “বেকারত্ব একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারকে কবি বানিয়ে দেয়।” বছর খানেক আগে পিংক ফ্লয়েড খ্যাত রজার ওয়াটারস আমিরের লেখা নাগরিকত্ব বিলের প্রতিবাদে লিখিত ‘সব মনে রাখা হবে’ কবিতার ইংরেজি অনুবাদ আবৃত্তি করলে তা প্রবল ভাইরাল হয়। আর এক লহমায় আমিরের কবিতার মাধ্যমে বলা তেজদীপ্ত বক্তব্য , নির্ভীক উচ্চারণ ভারতবাসীকে অবাক করে।
0 Comments