তারা কুসুমের মধু করে পান

কামরুজ্জামান কাজল on

ছবুরের মা বুকফাটা আর্তনাদে যখন আল্লাহকে ডাকছিল, ছবুর তখন বাপের কোলে, গেট দিয়ে বের হচ্ছিলো । খুব আগ্রহ নিয়ে মায়ের কান্না শুনতে থাকে সে, খানিকটা অবাকও হয় !

ধীরে ধীরে কান্নাটা পেছনে চলে যাচ্ছে। আওয়াজ কমতে কমতে ক্ষীণ হয়ে আসে । ছবুরের কান তবুও খাড়া। মায়ের কান্নার ভেতরে সে কিছু একটা টের পায়।

যদিও এই ছয়মাসের অভিজ্ঞতায় সে অনেক কিছুই বুঝেনি, বুঝার কথাও না। কিন্তু দুপুরের পর থেকে কিভাবে জানি সব কিছুই পরিষ্কার । এই যে, একজন অর বাপকে জিজ্ঞাসা করলো—চাচা আপনে এতোক্ষণ কোলে রাখতে পারবেন ? নাইলে আমারে দেন…

ছবুর সব বুঝতে পারছে । তার মোটেও অন্য কারো কোলে যাবার ইচ্ছা নাই। না—দুইদিকে মাথা নাড়ায় ছবুরের বাপ। বাপের চোখ থেকে ঠস করে দুই ফোটা পানি এসে পড়ে ছবুরের ছোট্ট সাদা জামাটায়। ছবুর খুশি হয়।

আশপাশে যেখানে যারা ছিলো, রাস্তায়, দোকানে, সেলুনে, জানলা-ছাদে, সবাই কেমন থ হয়ে তাকে দেখছে। বিড়বিড় অনেক অনেক কথা ভেসে আসছিল বাতাসে । এটাও ছবুর বুঝতে পারে। ওর খুব ইচ্ছা করছিলো, মাথার গিটটা খুলে, সবার তাকায়ে থাকাটা দেখে।

আর আধাঘন্টা আগে ডাক্তার কাছে গেলেও পোলাডা বাইচা যাইত! কেউ একজন আফসোস করে ওঠে । পেছন থেকে একজন শক্ত গলায় বলে— সব দোষ ঐ ডাইনির, অর যে দোষ আছে আমি আগেই কইছিলাম । আরেকজন উদাস ভঙ্গিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে । আল্লাহর মাল আল্লায় নিয়া গেল!

এইসব কথা শুনে ছবুরের মেজাজ খারাপ হতে থাকে । যদিও রাগ দুঃখ অভিমানের অনেক ঊর্ধে ছবুর, তবুও সে বুঝতে পারে । সব । হঠাত অর গাল থেকে একটা মিষ্টি টের পায় ছবুর। অভ্যস্ত, পরিচিত গন্ধ। কার? ছবুরের মায়ের? নাকি অন্য কিছু? ছবুর ছোট্ট বুকের ছাতিটা ধুকবুক করে ।

ছবুর তখন বাপের কোলে, আজিমপুর কবরস্থান । জানাযার সময় মুখটা বের করা হলে ছবুর টের পায় । বাপের জলটসটস দুইটা চোখ, শেষবারের মতো দেখতে থাকে ছেলের মুখ । ছবুর বাপের দিকে তাকিয়ে মিস্টি একটা হাসি দেয় ।

…….

শুনশান । শব্দহীন একটা জগত । তবে অন্ধকার না । হালকা কমলা আলোয় ডানা নাড়তে থাকে একটা প্রজাপতি । প্রতিবার ডানা ঝাপটাতেই বাতাসে নতুন রঙ ছড়াচ্ছে । কমলা রঙটা ধীরে ধীরে গাঢ় হতে থাকে । পাহাড় থেকে নেমে আসে আরেকটা প্রজাপতি । আরেকটা । আরেকটা । আসতেই থাকে । বাতাসে রঙের ছড়াছড়ি খেলা । ফুলের বুকটা ফুলে ওঠে, ঘাসের বুকটা আরেকটু কচি হয়, পুকুরঘাটের শ্যাওলারা হেসে কুটিকুটি খায় । মায়ের সাথে একজোড়া চোখ হাতে নিয়ে খেলতে থাকে শিশুটি । সামনেই হা হয়ে অপেক্ষা করছে একটা মাটির গহবর ।

ছবুরের বাপ সব টের পায় । কাউকে কিচ্ছু বলে না ।

ফেসবুক অ্যাকাউন্ট দিয়ে মন্তব্য করুন


কামরুজ্জামান কাজল

জন্মস্থান বাংলাদেশ, পাবনা জেলার ঈশ্বরদী উপজেলা । প্রায় তিন বছরেরও অধিক সময় ধরে অণুগল্প নিয়ে কাজ করছেন । ফেসবুক গ্রুপ "অণুগল্প" থেকেই মূলত অণুগল্পের হাতেখড়ি । এছাড়াও দেশের বিখ্যাত সব সাহিত্যপত্রিকায় ও ওয়েবজিনে তার অণুগল্প নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে । ইতোমধ্যেই প্রকাশিত হয়েছে দুটি একক অণুগল্প গ্রন্থ ১। দলছুট শালিকগণ (২০১৭) ২। আটপুকুরের ফুল (২০১৮) ২০১৬ সালে বের হয়েছে কাব্যগ্রন্থঃ শ্যাম পাহাড়ের আড়ালে । বর্তমানে লেখক "ত্রৈমাসিক অণুগল্প" পত্রিকার সম্পাদনা পর্ষদের সদস্য । অণুগল্প নিয়ে আছেন, অণুগল্প নিয়েই কাজ করে যেতে চান ।

0 Comments

মন্তব্য করুন

Avatar placeholder

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।