প্রথম রোজা
“সামনের একমাস গোটা বাড়ির সবাই রোজা থাকবে, কিন্তু দশ বছরের রুহানিকে রোজা রাখার পারমিশন দেওয়া হয়নি। আম্মি-আব্বা-দাদির কাছে সকাল থেকে কান্নাকাটি করেও কোনো উপায় হয়নি। সবাই বলেছে, রুহানি অনেক ছোটো, তাছাড়া না খেয়ে দেয়ে স্কুল – টিউশন এর জন্য তাকে ছাড়া যাবে না। একমাত্র ছুটির দিন সে চাইলে রোজা রাখতে পারে।
অনেক কান্নাকাটির পর আম্মি বলেছিলেন, রুহানি যদি ভোর তিনটের সময় নিজে নিজে উঠে পড়তে পারে তবে ভেবে দেখা হবে।
কারণ মা জানতেন, রুহানি সারাদিনের পড়াশোনা, খেলাধূলার ক্লান্তির পর ঘুমালে তার কানের কাছে ঢাক বাজলেও সে উঠতে পারবে না।
রাত্রি আড়াইটার সময় একটা আওয়াজ রুহানির কানে ধীরে ধীরে ঢুকছে। কে যেন ঢাক বাজিয়ে চিতকার করছে। “” আল্লাহকে প্যায়ারে, নবি কে দুলারে উঠো। রোজদারো উঠো”” বলা শেষ হওয়ার পর আবার ঢাকের শব্দ।
উঠে বসেছে রুহানি। চারদিকে আলো। বাড়ির সবাই উঠে পড়েছে। দৌড়ে রান্না ঘরে গিয়ে মা কে জড়িয়ে ধরে বলল, “”আম্মি, আমি উঠেছি। আমি রোজা রাখব।”” আম্মি জিজ্ঞাসা করলেন তুই উঠলি কিভাবে? রুহানি বলল, কে যেন ঢাক বাজাচ্ছিল। উনি কে আম্মি?
আম্মি বললেন, উনি রোজার সময় ঢাক বাজিয়ে সবাইকে ওঠান। যাদের এলার্ম ঘড়ি নেই, উনি তাদের এলার্ম।
রোজার পারমিশন না পেলেও রুহানির কানে ওই শব্দগুলো অনেক কল্পনার জন্ম দিয়েছিল। বাইরে বেরিয়ে এলার্ম চাচাকে দেখার বাইনা করলেও বেচারির সে ইচ্ছাও পূর্ণ হয়নি। কিন্তু অবশেষে ইদের দিন দেখা দিলেন এলার্ম চাচা। ওই একই ঢাক বাজিয়ে ইদের দুপুরে, ইদী বা বকশিস নিতে আসলেন তিনি। ইয়া লম্বা মানুষ, মাথায় পাগড়ি, লম্বা দাড়ি – গোঁফ। গলায় ঝোলানো বিশাল একটা ঢাক। উঁচু করে পরা লুংগি আর একটা পুরোনো পাঞ্জাবি।
রুহানির সাথে এলার্ম চাচার নিঃস্বার্থ বন্ধুত্ব গড়ে উঠল। প্রতি বছর ইদের দিন রুহানি এলার্ম চাচার আসার অপেক্ষা করে, আর এলার্ম চাচাও রুহানির। বড় হয়ে, কৌতুহল বশত বিভিন্ন প্রশ্ন করার সময়, রুহানি জানতে পারে, এলার্ম চাচার আসল নাম, গোবিন্দ সিং। পেশায় রিকশা চালক। একবার কোনো এক বিপদে পড়ে মন্দিরের পাশাপাশি মাজারের দরজায় গেছিলো। তারপর সেই মাজারে সুতো বেঁধে মানত করেছিল, প্রতিবার রোজার সময় মানুষকে জাগানোর কাজ করবে, তখন থেকেই সে একই কাজ করে চলেছে। যখন এলার্ম ঘড়ি কিনতে পারত না মানুষ তখন থেকে শুরু করেছিল গোবিন্দ সিং। আজ ঘরে ঘরে স্মার্ট ফোন মিনিটে মিনিটে মানুষকে জাগাতে পারে শুনেও গোবিন্দ সিং তার শফত পালন করে চলেছে।
চারদিকে সাম্প্রদায়িকতায় নোংরা খেলা দেখে, এলার্ম চাচাকে বারবার মনে পড়ে রুহানির। আর একবার জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছে হয়, “চাচা তোমার ধর্ম কি?”
0 Comments