বিপন্ন সময়
— ডাক্তারবাবু,আবার ওই সমস্যাটা ফিরে ফিরে আসছে—!
—কোনটা?
— ওই যে, শুধু মনে হচ্ছে কিছুতেই সত্যিকারের খুশি হতে পারছি না।
—একটু খুলে বলুন, বিস্তারে…
—মানে, মনে হচ্ছে ঠিক এইটাতেইতো খুশি হওয়ার কথা ছিল; পারফেক্ট ফ্যামিলি, লাভিং ওয়াইফ, ছেলেটা পড়াশোনায় ভালো, আমার নিজের মোটা মাইনের চাকরি প্লাস পারিবারিক হার্ডওয়ারের ব্যবসা— কোথাও তো কোন খামতি নেই। বাবা এখনো শক্তসমর্থ, রোজ দোকানে যান, মাও সুস্থসবল। তবুও যেন কী একটা নেই…
— তা, খুশি খোঁজার জন্য কী করছেন?
— শহর কলকাতায় যা যা করা যায়, সব ই তো করি। আগের উইকেন্ডে গঙ্গার ওপর ভাসমান রেস্তোরাঁয় গেলাম। এই হপ্তায় দামী অ্যামিউজমেন্ট পার্ক, মেইনল্যান্ড চায়না তারপর মাল্টিপ্লেক্সে “দাবাং থ্রি”। তা ছাড়া ছোটোখাটো ট্যুর তো আছেই।
— মানে খুশি খুঁজছেন না, কিনতে চাইছেন?
— পার্ডন, বুঝলাম না?
— বাদ দিন; তা যাদের জন্য এতকিছু করছেন, তারা মানে, আপনার ছেলে আর বউ এতে খুশি হচ্ছে?
— কী জানি ডাক্তারবাবু, এটা নিয়ে আমারও একটু সংশয় আছে। মাঝেমাঝে মনে হয়, বোধ হয় ওরাও খুশি হবার ভাণ করছে। মানে, এইগুলো করে ওদেরকে খুশি দেখবার জন্য আমি যে খুশি হচ্ছি বা বলা ভালো খুশি হবার অভিনয় করছি, সেই চেষ্টাটাকে অ্যাপ্রিশিয়েট করতে হয়ত ওরা আমার সামনে খুশি মুখে থাকছে। সরি, খুব কম্পলিকেট করে ফেললাম বোধহয়, বোঝাতে পারলাম না ঠিকমতো!
—একদমই না, জলের মত পরিষ্কার। তা, আপনার মনে যখন একটা দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছে এ নিয়ে, তখন নিশ্চয় “আসল খুশি কী?” সে ব্যাপারে আবছা হলেও একটা ধারণা আছে?
— সেটাই তো পরিষ্কার নয় আর সেই মুশকিল আসান করতেই আপনার কাছে আসা।
—আচ্ছা, আমি না হয় একটু হেল্প করছি। খুশির কারণ খোঁজার আগে তার বহিঃপ্রকাশ, ধরণ এগুলো জানা দরকার। আপনার পূর্ব অভিজ্ঞতা কী বলছে? খুশি হলে মানে একদম মন থেকে খুশি হলে আগে আপনার কী রকম মনে হত?
—উমমম… একদম রিল্যাক্সড লাগত, মানে সেই মুহুর্তে কোনো ভয়, টেনশন থাকত না। অন্য কোন দুশ্চিন্তা মাথায় আসত না। এখন ঠিক তেমনটা হয় না, গঙ্গাবক্ষে বা আইনক্সে তথাকথিত খুশির মুহুর্ত গুলোতেও মনে হয় কাল ছেলেটার স্কুলবাসে কোনো দুর্ঘটনা ঘটবে না তো? কোনো নেশাটেশা ধরে যদি? ওই যে কাগজে পড়লাম আবেশ না কি একটা ছেলের কথা কদিন আগে। আবার কখনো মনে হয়, যদি আই.আই.টি তে চান্স না পায় তাহলে হতাশ হয়ে পড়বে না তো?
—আপনার ছেলের বয়স কত?
— এই ১২ তে পা দিল।
— সে কি? আই.আই.টি র তো অনেক দেরী! এখন ই কিসের চাপ?
— আসলে কেরিয়ার গাইডেন্স তো একটু আগে থেকেই…
— যাকগে বাদ দিন, যে কথা হচ্ছিল, কী করতেন খুব খুশি হলে?
— উমমম… সে খুব ছেলেমানুষি ব্যাপার, যেমন ধরুন বাথরুমে কল খুলে অনেকক্ষণ ধরে হেঁড়ে গলায় গান গাইলাম।
— জল খুব বেশিক্ষণ খুলে রাখাটা পরিবেশ সচেতনতার দিক থেকে ভালো কথা নয়, তবে গানটা আপনি গাইতেই পারেন। কোন গানটা বেশি গাইতেন— মনে আছে?
— সে অনেক গান, তবে সব থেকে প্রিয় ছিল “আঁধি” সিনেমার গান।
— কতদিন সেই “চানঘরে গান” শোনা যায় নি?
— মনে নেই, তা পনেরো-বিশ বছর হবে।
— ধরুন গানটা।
— এখন? এখানে, এই চেম্বারে?
— হুম, নো প্রব্লেম, শুরু করুন।
— ইয়ে, মানে কেমন একটা ইয়ে লাগছে।
— ইয়ে দিয়ে ইয়েটাকে বের করে ঝেড়ে ফেলুন, ভালো লাগবে।
— [গান] “তুম আগায়ে হো, নুর আগায়া হ্যায়”…. তেমন ভালো হল না, বোধহয় স্কেলের ও গোলমাল হল, না?
— হুম, আর “চরাগোঁ সে ল” যাওয়ার সময় সুরটাও গেল, তবে সেটা বড়কথা নয়। গেয়ে আপনার কেমন লাগছে?
— ভালো, বেশ ভালো, একটা কিরকম যেন ছেলেমানুষি আনন্দ হল।
— আচ্ছা আর কী কী করে একদম নির্মল, টেনশনহীন আনন্দ পেতেন আগে?
— ধরুন, হঠাৎ ইন্ডিয়া ক্রিকেটে জিতে গেল, বিনা নোটিসে পত্রপাঠ খিচুড়ি-মাংসর প্ল্যান হয়ে গেল। তারপর রথের দিন বাজী ধরে ৪ ঠোঙা জিলিপি খেয়ে নিলাম। আমি, বিপ্লব, হারু, আর রবি মিলে এসব হত আর কি!
—আর?
— আর, ধরুন আমাদের অন্য দুই বন্ধু জহিরুল আর লিয়াকতের বাড়ি ঈদের নেমন্তন্ন থাকত। মাটন বিরিয়ানি, ফিরনি, সেমাই আর এক অদ্ভুত পরোটা খাওয়াত… মাখনের মত নরম, আর কোথাও খাই নি সেটা। মজার কথা জানেন, জহিরুলের দিদি নার্গিস প্রতি বছরই বলত, “ভয় নেই, বড় মাংস (বিফ) দিচ্ছি না”! আমরা হেসে বলতাম, “জানি সে বিশ্বাস টুকু আছে”!
— তা এই তো পরপর রথ আর ইদ গেল, যোগাযোগ করেছেন বিপ্লব, হারু, রবি, জহিরুল, লিয়াকত দের সাথে?
— না, মানে অনেক দিন টাচে নেই, আর ওরা সবাই সোশাল নেটওয়ার্ক এ নেই তো…
— তা, আপনার ফেসবুক তো বলছে, আপনার দেড় হাজার বন্ধু এখন, ইন্ডিয়া আজো ক্রিকেটে জেতে মাঝেমাঝে, রথে এখনো ঠোঙা ভর্তি জিলিপি বিক্রি হয়, তাহলে এখন এই নতুন বন্ধুদের নিয়ে কেন “সতিকারের খুশি” হতে পারছেন না, মিস্টার মিত্র?
—আসলে সোশাল নেটওয়ার্ক এ…
— আসলে সোশাল নেটওয়ার্ক এ তো আর খিচুড়ি মাংস রান্না করা যায় না, তাই না? তার জন্য, রক্তমাংসের মানুষগুলোকে কাছাকাছি আসতে হয়, পরস্পরের স্পর্শ, নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস অনুভব করতে হয় এবং তাদের কণ্ঠস্বর কোনো বৈদ্যুতিন মাধ্যম ছাড়াই পরিষ্কার শুনে নিতে হয়। এতক্ষণে আপনি একদম ঠিক লাইনে বল করলেন। রিয়েল আর ভার্চুয়ালের ফারাকটা ধরতে পারছেন। আচ্ছা, জহিরুল আর লিয়াকত? ওদের ঈদ মুবারক জানিয়েছেন গতকাল?
— নাহ!
— কেন?
— এটা খুব কম্পলিকেটেড বিষয়, বলে বোঝানো মুশকিল, তাছাড়া সেনসিটিভ ইস্যু, কিছুটা ব্যক্তিগতও বটে। এর উত্তর হয়ত আমার সচেতন মনও ঠিক জানে না।
— তাহলে বিশেষজ্ঞ হিসেবে আমি একটু সাহায্য করি, আপনার অবচেতন মনের অতল থেকে উত্তরগুলো তুলে আনতে? অনেকটা ডুবুরির মত ডুব দিয়ে মণিমুক্তো খুঁজে দিতে?
— হ্যাঁ, তা বেশ, সে তো…
— আপনার ছেলেবেলায় সম্পর্কের সমীকরণ টা অন্য রকম ছিল। তখন ধূলোগড় ঘটে নি, সন্ত্রাসের ধর্ম হয় কি হয় না এ নিয়ে রোজ তর্ক হত না। বাংলাদেশের অবস্থা এতটা খারাপ হয় নি, গোরু ও হনুমানের অত্যাচার এই পর্যায়ে পৌঁছয় নি, সোশাল মিডিয়ায় প্রতিদিন বিদ্বেষের বিষ ছড়ানো হত না, হিন্দু দেবদেবীর মুর্তি নিয়ে নোংরামি হয় নি এই লেভেলে আর বাংলাদেশের খ্যাতনামা স্ট্যান্ড আপ কমেডিয়ান কে হাস্যরস সৃষ্টির জন্য, “হিন্দুদের ওজু করতে গিয়ে ধরা পড়ে মার খাওয়া” কে বিষয় হিসেবে বাছতে হত না!
— দেখুন, বিশ্বজোড়া ইসলামি সন্ত্রাসের পরিপ্রেক্ষিতে বিপক্ষ যুক্তি হিসেবে আপনি দু-তিনটে বিচ্ছিন্ন ঘটনা তুলে ধরতে পারেন না। আইসিসের প্রকাশ্য দিবালোকে মুণ্ডছেদ, মুম্বই, হায়দারাবাদে সিরিয়াল ব্লাস্ট, ফ্রান্স, জাকার্তা, ইস্তাম্বুল, ঢাকা এর পরেও বলবেন “সন্ত্রাসের রঙ নেই”? কতদিন আর নিজেকে ধোঁকা দেবেন, ডাক্তারবাবু?
— মিস্টার মিত্র, আপনি গুলিয়ে ফেলছেন, আমার কাছে বিষয়টা খুব ক্লিয়ার, একদম অঙ্কের মত। আমার কাছে ভারতের বাইরের ও আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার থেকে বড় কিছু নেই। আমি এর থেকে বেশি গুরুত্ত্বপূর্ণ জাতীয় ধর্ম বা কর্তব্য দেখতে পাই না।
ট্রান্সবর্ডার টেররিজম এবং ভারতের মধ্যে থেকে যারা দেশদ্রোহিতা করছে, জাতীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত করছে, আমি তাদের সবার বিপক্ষে। সেখানে যদি ৯৭ শতাংশ উগ্রবাদী আক্রমণ ইসলাম ধর্মাবলম্বী দের হয়ে থাকে, তাহলে আমি তাদের সবার বিরোধিতা করি। প্রয়োজনে পেন এর বদলে অস্ত্র তুলে নিতেও দ্বিধা করব না। কিন্তু বাকি তিন শতাংশ হিন্দু, শিখ বা বৌদ্ধ কেও আমি সমান ভাবে ঘৃণা করব। এক্ষেত্রে আমি কবিগুরুর কয়েকটা লাইন ভীষণ ভাবে মেনে চলি, একদম ভেতর থেকে,
“অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে
তব ঘৃণা যেন তারে তৃণ সম দহে”।
আর সেই দহনটা জাতধর্মের রঙ বিচার না করেই আমি করে থাকি।
কিন্তু আমাকে বোঝান, এর সাথে আপনার বাল্যবন্ধু, আযৌবন সুখ-দুঃখের সঙ্গী জহিরুল আর লিয়াকতের কী সম্পর্ক? তারা কী দোষ করেছে?
— দেখুন ড: গুপ্ত, আমার মনে হয়েছে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এটাই বোধহয় শ্রেয়। হয়ত সংস্রব না রাখলে, আর ঝামেলায় জড়াতে হল না।
— আবার, আবার সমস্যা সেই সোশাল নেটওয়ার্ক আর দলে ভারী আপনার ওই উগ্র হিন্দুত্বের ধ্বজাধারী বন্ধুরা, তাই তো? আপনার মনে হয়েছে যে, এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ঈদের নেমন্তন্ন খেতে গেলে আপনাকে নিয়ে ঘৃণ্য ট্রল করে একঘরে করে দেওয়া হবে।
প্রতিবাদ করুন ধ্বংসাত্মক আইসিস কর্মকাণ্ডর, জ্বলে উঠুন গুলশনের উগ্রপন্থার বিরুদ্ধে, সোজা সাপ্টা ভাষায় ইসলামী সন্ত্রাস কে ইসলামী সন্ত্রাস বলেই, কল আ স্পেড আ স্পেড, কিন্তু জহিরুল আর লিয়াকত কি তরোয়াল নিয়ে “নারায়েতকবির” হুংকার দিয়ে আপনাকে তাড়া করেছে কখনো, যে আপনি সংস্রব একেবারে ত্যাগ করলেন?
— হয়ত ওরাও ভিন্ন ধর্মাবলম্বী দের ঘৃণা করতে শিখেছে।
— আপনি কিন্তু উল্টো পথে হাঁটছেন, আমাদের দেশের আইন কিন্তু আসামীর অপরাধ প্রমাণ হবার আগে পর্যন্ত তাকে নির্দোষ বলেই গণ্য করে। আজ ক্রিকেটে পাকিস্তানের জয়ে কলকাতায় আগের থেকে বেশি বাজী ফুটেছে বলে, আপনার বন্ধুদের “আউট” ডিক্লেয়ার করবেন না। বরং একবার বেনিফিট অফ ডাউট দিয়েই দেখুন কী হয়। যদি তারা সত্যি বদলে গিয়ে থাকে, তাহলে আপনার রাস্তা তো খোলাই আছে। এত নামী কোম্পানির টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ার আপনি মিস্টার মিত্র, আর এরকম কমিউনিকেশন গ্যাপ?
— ড. গুপ্ত, আপনি মনে হয় ঠিকই বলছেন, এই কটা কথা বুকের মধ্যে জমে ছিল, আমি নিজেও ঠিক ঠাহর করতে পারি নি।
— গঙ্গাবক্ষে ভাসমান রেস্তরাঁয় না গিয়ে বরং গঙ্গার তীর ধরে সোজা চলে যান আজীমগঞ্জ, জহিরুলের বাড়ি। হয়ত নার্গিস দিদি দস্তরখান বিছিয়ে আজো আপনার অপেক্ষায়। হয়ত ঈদের দাওয়াতের স্বাদ এখনো একইরকম লাগবে। খুঁজে নিন রবি, বিপ্লব আর হারুকে। বয়স বেড়ে গেছে, আজ রাস্তার জিলিপি খেলে হয়ত একটু অ্যাসিডিটি হবে, কিন্তু খুশি খুঁজে পাবেন। সেই খুঁজে পাওয়াটা ফেসবুকে বন্ধু খুঁজে পাওয়ার থেকে অনেক বেশি আনন্দদায়ক। আবিষ্কার করুন আপনার ফেলে আসা দিন, লুকনো শৈশব। তখন সত্যিকারের খুশি খুঁজতে আর আমার মত মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে আসতে হবে না। নমস্কার, ভালো থাকবেন মিস্টার মিত্র।
— এ কী? এতক্ষণ আপনার মুখটা ঠিকমতন দেখতে পাই নি ড. গুপ্ত। আপনি তো আমার মতই দেখতে হুবহু! অবিকল আয়নায় যে প্রতিচ্ছবি দেখি, সেরকম। আপনি কে ড. গুপ্ত? আমার ঘুমের মধ্যে লুকিয়ে থাকা আরেকটি লোক, হ্যালো শুনতে পাচ্ছেন? আমার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছেন ড. গুপ্ত? হ্যালো…হ্যালো…
——————————————সমাপ্ত————————
0 Comments