অম্বুবাচীতে প্রাচীন দিনাজপুরে কৃষিভিত্তিক লৌকিক দেবী “লজ্জাগৌরী” ও “লজ্জাপরব”

কৌশিক বিশ্বাস on

dinajpur-lojjagouri-lojjaporob

যাদৃশং তূপ্যতে বীজং ক্ষেত্রে কালোপপাদিতে।
তাদৃগ্ রোহতি তত্তস্মিন্ বীজং স্বৈর্ব্যঞ্জিতং গুণৈঃ’।।

(মনুসংহিতা-৯/৩৬)

বপনের উপযুক্ত বর্ষাকাল প্রভৃতি সময়ে উত্তমরূপে কর্ষণ-সমীকরণ প্রভৃতি পদ্ধতির দ্বারা সংস্কৃত ক্ষেত্রে যেরকম বীজ বপন করা হয়, সেই প্রকার ক্ষেত্রে সেই বীজ বর্ণ-অবয়বসন্নিবেশ রস-বীর্য প্রভৃতি নিজগুণের দ্বারা বিশিষ্ট হয়ে শস্যরূপে উৎপন্ন হয়

(মনুসংহিতা-৯/৩৬)
lojja-gouri

প্রাচীন মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা ও লোকজীবন অতিবাহিত হত মূলত কৃষিকাজকে কেন্দ্র করে। বৈদিক পরবর্তী যুগ থেকে আজ পর্যন্ত এ ধারা চলেছে বিশেষ করে গ্রামীণ জীবনের বিভিন্ন লৌকিক উৎসবেও। ভারতের কৃষিসভ্যতা প্রাচীন সমস্ত সভ্যতার মধ্যে অন্যতম। এই কৃষিকেন্দ্রিক সভ্যতার বুনিয়াদ কিন্তু পুরুষরা নয়;মহিলারা। ধান্যরোপনের দিকে তাকালেই আমরা তা দেখতে পারি। রোপণ মহিলা ছাড়া হয়ই না বলা চলে। মহিলা ও বসুমাতা বা এই ধরিত্রীর ফলপ্রসূ রূপ কল্পনায় এই উৎসবের ভিত্তি। একটি মেয়ে তখনই ফলদায়ী হয় যখন সে রজঃস্বলা হয়। ভারতের তিন দেবীর ক্ষেত্রে রজঃস্বলা হবার উৎসব পালিত হয় উত্তর ভারতের পার্বতী, কেরলের ভগবতী আর আসামের কামাখ্যা। বাংলা এবং ওড়িশার বিভিন্ন জায়গায় আরো একটি এরকম উৎসব অম্বুবাচীর দিন থেকে পালিত হয় তা হলো – লজ্জাগৌরীর “লজ্জাপরব”। চন্দ্রকেতুগড় থেকেও অবিকল একটি “লজ্জাগৌরীর” টেরাকোটা সিলিং পাওয়া গেছে একই মুদ্রায়। এছাড়া পাথরের বিভিন্ন মূর্তিও পাওয়া গেছে ওড়িশা সহ ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। আষাঢ় মাসের বৃস্টি হলে ধরিত্রী রজঃস্বলা হয় বলে কল্পনা করা হয়। এরপর তাকে কর্ষণের মাধ্যমে চাষযোগ্য করার পর বীজ ফেলে ফলদায়ী করা হয়। মানুষের মৈথুনপ্রতীক বলা যেতে পারে একে। তবে শুধুমাত্র কৃষিকাজকে কেন্দ্র করে এই অতি প্রাচীন উৎসবটি প্রাচীন সমাজব্যবস্থার সমস্ত সাক্ষ্য আজও বহন করে চলেছে। বস্তুত এই পরবের পরই গ্রামীণ লোকজীবন ব্যস্ত হয়ে পড়ে কৃষিকাজ বা চাষবাসে। কলাপাতায় আম,দুধ দেওয়া এবং এসময় কোন প্রাণী হত্যা না করা এই পরবের আবশ্যিক শর্ত। বর্তমান বিনশিরাতে পশ্চিমবঙ্গের যে দ্বিতীয় প্রাচীনতম রথ আছে তার “পার্শ্বদেবতা” হিসেবে এই “লজ্জাগৌরী” র পূজা করা হয়। স্থানীয় ভাষায় এটি “হাউনি” বলে পরিচিত। মূর্তিটি কাঠের রং করা এবং অবিকল প্রাচীন মূর্তির মতো সমাসনে উপবিষ্ট (প্রসবকালীন ভঙ্গিমা)। আজও কৃষিকেন্দ্রিক যত লৌকিক উৎসব আছে তার মধ্যে এই অম্বুবাচীতে “লজ্জাপরব ” অন্যতম যা পালিত হয়ে চলেছে দক্ষিণ দিনাজপুরে প্রাচীনতম বিনশিরার রথকে কেন্দ্র করে।


ফেসবুক অ্যাকাউন্ট দিয়ে মন্তব্য করুন


কৌশিক বিশ্বাস

তরিকুল্লাহ সরকার উচ্চ বিদ্যালয়ের ইংরেজির শিক্ষক। আঞ্চলিক ইতিহাস ও লোকসংস্কৃতি বিষয়ক প্রবন্ধ লেখক। বৌদ্ধ ইতিহাস, ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে গবেষণামূলক প্রবন্ধ লেখক।

0 Comments

মন্তব্য করুন

Avatar placeholder

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।