ফিরে দেখা বাবরি

দেবজিৎ সাহা on

রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় নাটকীয়তার শেষমেষ যবনিকা পতন ঘটল ৯ নভেম্বর ২০১৯। ভারতবর্ষের সুদীর্ঘ ইতিহাসে ঠাসাঠাসি ভিড়ে রাম রহিমের জায়গায় নিয়ে যে দীর্ঘ বচসা তার সামরিক সমাধানের ওপর সীলমোহর পরল। একটা চরম স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে হয়।

প্রায় পাঁচশো বছর আগে মীর বাকি মুঘল সম্রাট বাবরের আদেশেই তৈরি করেছিলেন বাবরি মসজিদ। ইতিহাস ভারি মজার । কখন তার কবর থেকে বেরিয়ে এসে বর্তমানকে আরো ভয়ঙ্করভাবে মজাদার করে তুলবে তা বলা বাহুল্য। ঠিক এই ভাবেই ১৮৫৩ সালে প্রথম বহিঃপ্রকাশ ঘটে আরেকটি সমান্তরাল ধর্মীয় দাবির যার জন্ম ঠিক বাবরি মসজিদের নিচে। সেদিন অল্প হলেও জানা গিয়েছিল কোন হিন্দু স্থাপত্য কিংবা মন্দির কে উড়িয়ে দিয়ে তৈরি করেছিলেন তার মসজিদ। হিন্দু মননে অল্পবিস্তর আঘাত তো লাগবেই। উদ্ভাসিত হয় নতুন তথ্য যা বর্ণনা করে ঠিক সেখানেই নাকি হিন্দু ধর্মের পরম পুরুষ শ্রী শ্রী রামচন্দ্রের জন্ম হয়েছিল । ধর্মের জটিলতা শুরু এখান থেকেই।

ধর্ম এবং সভ্যতার সম্পর্কটা ঠিক গুরু-শিষ্যের মত। ধর্মের দর্শন এবং আদেশেই সভ্যতার বিবর্তন। গুরুর পরামর্শ ছাড়া সভ্যতা কিভাবে এগিয়ে যাবে ? গুরুদক্ষিণা হিসেবে সভ্যতাকে যুগে যুগে যে অগণিত নিরীহ প্রাণ বলিদান দিতে হয়েছে তাকে নিয়তিবাদের গণ্ডিতে ফেলে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলাই যায়। হয়তো সেই সম্পর্কের সম্পৃক্তকরণ আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল প্রথমবার।

ভারতীয় সংস্কৃতি ও সমাজ ব্যবস্থার পেছনে রামায়ণ এবং সেই রামায়ণের নায়ক রাম হিন্দু ধর্ম সচেতন মনের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। আর প্রভু রাম মানে অযোধ্যা। প্রাচীনকাল থেকেই অযোধ্যাকে হিন্দু ধর্মের গুরুত্বূর্ণ স্থান দেওয়া হয়েছে। আর সেখান থেকেই জেরুজালেমের ন্যায় ভারতবর্ষে প্রথমবার শুরু হলো হিন্দু এবং মুসলিমদের ধর্মীয় ক্রুসেড।

১৮৫৩- এর পর সরকারি তথ্য অনুযায়ী হাজার ১৯৩৪ সালে শুরু হয় দ্বিতীয় কনফ্লিক্ট। ব্রিটিশ গভমেন্ট কঠোরভাবে হিন্দুদের এই আন্দোলনকে তখন চেপে দেয় । ক্ষতিপূরণ হিসেবে হিন্দু সমাজকে দিতে হয় প্রায় ৮৪ হাজার টাকা যা খরচা হয়েছিল মসজিদ ভেঙে যাওয়া অংশের পুনঃনির্মাণের জন্য। ১৪ বছর পর চলে আসা যাক ১৯৪৯ – এ । অখিল ভারতীয় রামায়ন মহাসভা নয় দিন ব্যাপী রামচরিত মানস পাঠের আয়োজন করেছিল । ২২ এ ডিসেম্বর ছিল যার শেষ দিন। ঠিক সেই রাতে কিছু কট্টর হিন্দু মসজিদ প্রাঙ্গণে প্রবেশ করে প্রধান গম্বুজ এর নিচে স্থাপিত করেন রাম এবং সীতা দেবীর মূর্তি।

হয়তো তদানিন্তন সরকার এই ধার্মিক কলহ থেকে সৃষ্ট ভয়ঙ্কর এক ভবিষ্যতের বাস্তব ঠাওর করতে পারেনি। যদিও তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়টিকে নিয়ে যথেষ্ট চিন্তিত ছিলেন । জওহরলাল নেহেরু বলেছিলেন ” … dangerous example being set there , which will have had bad consequences… ” ইউনাইটেড প্রভিন্সের মুখ্যমন্ত্রী পন্ডিত গোবিন্দ বল্লভ পন্ত অবস্থার সহজ সমীকরণ তখন বের করতে পারেননি । চেষ্টা করেননি কেউ। প্রায় ৪০ বছর পর রাম এবং সীতার মূর্তি প্রতিস্থাপন কে” miracle of God ” বলে আখ্যা দেয়া হয়। ঈশ্বর এবং আশ্চর্যের মধ্যিখানের জায়গাটা বড় অস্পষ্ট। সে যাই হোক ১৮৫০ সালে ব্রিটিশ গভমেন্ট এর তত্ত্বাবধানে একটি হিন্দু মুসলিম কম্প্রোমাইজ করা হয়। ১৮৫৬ সালেই মন্দির প্রাঙ্গন দুই ভাগে বিভক্ত করা হয়েছিল । মসজিদের মধ্যেই ব্যবস্থা করা হয়েছিল মুসলিমদের নামাজ পড়ার এবং মসজিদের বাইরে কিছুটা দূরে একটি বেদীর উপর প্রভু রামের পূজার্চনার জায়গা করে দেয়া হয়েছিল। রাম মন্দির পুরোপুরিভাবে তৈরি করার প্রথম দাবি উঠেছিল ১৮৮৩ সালে খারিজ করে ব্রিটিশ সরকার।

১৯৪৯ সালের পর থেকেই এত সাম্প্রদায়িক বাতাবরণ তৈরি করা হয়েছিল যার দরুন বাবরি মসজিদ জনসাধারণের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিন্তু বছরে একবার পূজা-পার্বণে ব্যবস্থা করা হয় হিন্দুদের জন্য। রাজনৈতিক চাপানউতোর চরমে ওঠে ১৯৮৫ সালে যখন তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী শাহ বানো কেস- এর আদালতের নির্ণয়কে মুসলিম কমিউনিটির সার্থে অগ্রাহ্য করে । যার দরুন তাকে হিন্দু কট্টরপন্থীদের মুখে পড়তে হয়। তখনই মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের মসজিদ কে পুনরায় খোলার দাবি।

শুরু হয় নতুন রাজনীতির খেলা যা রাজীব গান্ধী আগে থেকেই হয়ত ভেবে রেখেছিলেন। খুলে দেওয়া হয় মসজিদ প্রাঙ্গণ এবং খোলার দু’দিন পর মসজিদ থেকে পূজা-অর্চনা দূরদর্শনের পর্দায় দেখানো হয়। সমস্যা যে আরও ঘনীভূত হচ্ছে তা হয়তো তদানিন্তন সরকার বুঝতে পারেননি কিংবা খেলতে গিয়েছিলেন রাজনীতির একটা ঝুঁকিপূর্ণ জুয়া খেলা। ঠিক তখনই হিন্দু আবেগকে হাতিয়ার করে অভ্যুত্থান হয় ভারতীয় জনতা পার্টির।

রাম মন্দির নির্মাণ কে নিয়ে এল কে আদভানি নেতৃত্বে শুরু হয় দশ হাজার কিলোমিটার সারা ভারত রথযাত্রার। সাধারণ হিন্দু মনন অনেকাংশেই তা গ্রহণ করে নেয়। গর্বিত বোধ করে নিজের হিন্দুত্বের। রামের অস্তিত্বের সাথে নিজের অস্তিত্ব মিলে যায়। শুরু হয় ধর্মীয় অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। প্রাণকেন্দ্র হয়ে ওঠে অযোধ্যার বাবরি মসজিদ অথবা অঘোষিত রাম জন্মভূমি। সেই লড়াই আধুনিক সমাজ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে কতটা প্রয়োজনীয় তা নিয়ে অনেক প্রশ্ন থাকতেই পারে কিন্তু প্রশমিত হিন্দু আবেগ উপচে পড়ে ৬ ডিসেম্বর ১৯৯২ সালে। হাজারে হাজারে কার সেবক নামে অসংযত জনতা ভেঙে দেয় বাবরি মসজিদ। মৃত্যু হয় উভয় পক্ষের প্রায় ২ হাজার মানুষের। আকাশে বিক্ষিপ্তভাবে দেখা যায় ১৯৪৭ এর সেই দাঙ্গার কালো মেঘ।

ঠিক ১৩ বছর পর হঠাৎ সেখানে হয় উগ্রবাদী আক্রমণ। ৩০ শে সেপ্টেম্বর , ২০১০ এলাহাবাদ হাইকোর্ট অমীমাংসিত জমিটি কে তিন ভাগে ভাগ করে যার এক ভাগ হিন্দু মহাসভা আর এক ভাগ সুন্নি ওয়াকআপ বোর্ড এবং বাকি আরেক ভাগ দেওয়া হয় নির্মোহী আখারা কে। ২০১০ সালে হিন্দু মহাসভা এবং সুন্নি ওয়াকআপ বোর্ড উচ্চ আদালতে আবেদন করে। ২০১১ সালে উচ্চ আদালত পুনরায় অমীমাংসিত জমি স্থিতাবস্থা বহাল রাখে।

২১ শে মার্চ ২০১৭ সর্বোচ্চ আদালত মধ্যস্থতার মাধ্যমে বিবাদ সমাধানের প্রস্তাবনা দেয়।

৯ নভেম্বর ২০১৯ দেশের সর্বোচ্চ আদালত আগে আর্খেলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া তথ্য যাচাই করে । যেখানে বলা হয় বাবরি মসজিদের জায়গায় আরেকটি স্থাপত্যের কাঠামো পাওয়া যায় যা কোনভাবেই মুসলিম স্থাপত্যের সাক্ষ্য বহন করে না। যাকে নাকি আবার কোনভাবেই হিন্দু স্থাপত্য বলা যায়না।

সব পক্ষ শুনে সব দলিল যাচাই করে সর্বোচ্চ আদালত শেষমেষ বাবরি মসজিদের ২.৭ একর জায়গা রাম মন্দির নির্মাণের জন্য কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারকে আদেশ দেন। এবং অযোধ্যাতেই ৫ একর জায়গা প্রদান করার আদেশ দেন মুসলিমদের মসজিদ নির্মাণের জন্য।

যাইহোক এতবড় একটা জটিলতা আর কতবছর টেনে নেওয়া যায়! নিষ্পত্তি হওয়াটা দরকার। তাই হলো। কার দিকে হলো, কার দিকে হলো না, সেটা নিয়ে অনেক কথা পড়ে বলা যাবে। ২.৭ একরের রাম মন্দির অথবা ৫ একরের মসজিদ নির্মাণ আখেরে ভারতবর্ষের আর্থসামাজিক অবস্থার কতটা পরিবর্তন করবে, তা নিয়েও আলোচনা করা যাবে। তবে কিছু ক্ষমতাপিপাশু ভন্ড উগ্র ধর্মীয় অবতারের আর্থিক অবস্থার উন্নতি হবে একথা বলাই যায়। ঈশ্বর এমন একটা বস্তু যার যেমন কোন এক্সিস্টেন্স প্রমাণ করা যায় না , তেমনি তাঁহার নন – এক্সিস্টেন্স ও প্রমাণ করা কঠিন। আর এর মধ্যিখানে যুগ যুগ ধরে ম্যাজিক করে চলেছেন অনেকেই। আর আমরা তো ম্যাজিক ভালোবাসি।


ফেসবুক অ্যাকাউন্ট দিয়ে মন্তব্য করুন


দেবজিৎ সাহা

জন্ম ও বেড়ে ওঠা দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার বালুরঘাট শহরে। পড়তে ও লিখতে ভালোবাসেন। ইংরেজী সাহিত্য নিয়ে নর্থ বেঙ্গল ইউনিভারসিটি থেকে স্নাতক ও গৌড়বঙ্গ ইউনিভারসিটি থেকে স্নাওকত্তর । সাহিত্যের প্রতি গভীর অনুরাগ থেকেই লেখা লেখির জগতে প্রবেশ। কলেজ জীবন থেকেই লেখা লেখি শুরু করেন। পেশায় শিক্ষক। এছাড়াও ফটোগ্রাফি তে বিশেষ আগ্রহ রয়েছে।

0 Comments

মন্তব্য করুন

Avatar placeholder

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।