ছেলেবেলার মধুপুর

ঋদ্ধিমান ভট্টাচার্য্য on

সেই ছেলেবেলার গল্প। বছর দশেক বয়স। শীতের ছুটিতে বাড়ির সব্বাই মিলে সেবার গেছিলাম মধুপুরে। ডিসেম্বরের ভোরে শীত মেখে কু- ঝিক ঝিক রেলগাড়ি চেপে টুক করে পৌঁছে গেছিলাম মধুপুর। এরআগে পাহাড় দেখিনি,তাই মালভূমির লাল মাটি আর শালের বন বাদাড় টপকে রেলগাড়ি যখন ছুটছিল,রোদ চুপচুপে ন্যাড়া টিলাগুলো দেখে চোখ গোল্লা হয়ে যাচ্ছিল। ট্রেনের সাথে সমানে পাল্লা দিয়ে ছুটে চলছিল কুঁড়েঘর,মরা নদীর সোঁতা আর ঘড়ির কাঁটা। প্যাসেঞ্জার ট্রেন লেটের মা-বাপ ছিল না। আমার অবশ্য দেরী ভালোই লাগছিল। তবু বিকেল হতেই নেমে পরলাম মধুপুর।


হোটেল নয়,আমরা ছিলাম এক বাগানবাড়িতে। উঁচু পাঁচিলে ঘেরা। কাঠের গেট থেকে লাল সুড়কি বিছানো পথ চলে গেছে সিঁড়ি অবধি। পথের দুপাশে ফুলের বাগান। ডালিয়া, চন্দ্রমল্লিকা,গাঁদা রঙীন হয়ে ফুটে আছে। আম,পেয়ারা,আতা আর ইউক্যালিপটাস, দেবদারু গাছের ছায়ার গন্ধ মাখা বাগানবাড়িটাতে পৌঁছতেই ভালো লেগে গেছিল। সকালে ঘুম ভাঙলেই দেখি রোয়াকে খান কতক হাঁড়িচাচা এসে বসেছে। প্রজাপতি উড়ছে ফুলে ফুলে। 
উত্তম বলে একটা ছেলে ছিল,দেহাতি। আমরা যেকদিন ছিলাম ও আমাদের সাথে ছিল। ফাইফরমাশ  খাটতো, কুয়ো থেকে চানের জল তুলে দিত। দূরের সরকারী নলকূপ থেকে খাওয়ার জল এনে দিত। খেলা করত আমার সাথে। একটা টাঙ্গা ডেকে আনত,আর আমরা যেতাম বাজারে। ময়রার দোকানে হিংয়ের কচুড়ি আর আলুর তরকারি দিত শাল পাতার ঠোঙায়। ওটাই রোজকারের ব্রেকফাস্ট ছিল। তারপর দুপুরের জন্য বাজার করা হত। সেই শাল পাতায় মোড়া পাঁঠার মাংস আর আনাজপাতি সাঁওতাল পাড়ার হাট থেকে কেনাকাটা করে ফিরে আসতাম। জলের গুনে নাকি ক্ষিদে হোতো জব্বর। দুপুরে গড়িয়ে নিয়ে উত্তম কে টহল দিতে যেতাম। সাঁওতাল পাড়ার মাঠ পেড়িয়ে চলে যেতাম এক বড় দিঘির পাড়ে। দিব্যি হাঁস চরে বেড়াত টলটলে জলে।  সবাই মিলে সন্ধ্যায় ঘুরতে যেতাম,ফেরার পথে দেখতাম পথের দুধারে থিকথিকে জোনাকি। ঝিঁঝিঁ পোকা ডাকত। 


একদিন গিয়েছিলাম উস্রী । সেই তো প্রথম ঝরনা দেখা।  ঝরনার জলে চান করেছিলাম।  উস্রীর স্বচ্ছ জলে পা ডুবিয়ে বসেছিলাম। ফেরার পথে রাস্তার ধারে ধাবায় খেলাম,প্রথমবার খাটিয়ায় বসে।  খাটিয়ার দড়ির বুনোনের ফাঁকে কেমন ভারি স্টিলের জল ভরা গ্লাস রেখে যাচ্ছিল। খোলা আকাশে রোদের আঁচে বসে এমন মধ্যাহ্নভোজের  জন্য আজও মন কেমন করে। 


একদিন রাতে রান্না হল,মোরগের ঝোল। উত্তম এনেদিয়েছিল সাঁওতাল পাড়া থেকে। সে মোরগ আনার এক বেত্তান্ত আছে। দু‘কুড়ি দশ,মানে পঞ্চাশ টাকায় রফা হয়েছিল। লাল আর সবুজ ডুরে শাড়ি পড়া বুড়িমা  টাকা নিয়ে আঁচলে বেঁধে বসেই রইল। আশপাশে কোঁকরকোঁ করে ঘুরে বেড়াচ্ছে হৃষ্টপুষ্ট খান চারেক মোরগ আর আমরা হা-পিত্যেশ করে বসে আছি সেই বিকেল থেকে। সন্ধ্যার আঁধার নামতে যখন সব মোরগ আর মুরগী খাঁচায় ফিরল তখন মোরগ প্রত্যর্পণ হল। 


সে এক নস্ট্যালজিয়া মাখা ছুটি। এখনও মনে পড়ে। চোখ বন্ধ করে ভাবলে উত্তমকেউ দেখতে পাই—কষ্টি পাথরের মতন রঙ,গাল ভরা হাসি। নেভি ব্লু হাফ প্যান্ট আর হলদে ডুরে জামার উপর তুঁসের চাদর চাপিয়ে দাঁড়িয়ে আছে,একহাতে পেয়ারা অন্য হাতে কাঠবিড়ালির  ছানা।

ফেসবুক অ্যাকাউন্ট দিয়ে মন্তব্য করুন


ঋদ্ধিমান ভট্টাচার্য্য

জন্ম ১৯৮৩র ৫ই এপ্রিল। ড়ি টাকিতে।রসায়নে স্নাতক।লেখালেখি সখ ইস্কুল থেকেই। স্রোত, কাজরী এমন কিছু লিটল ম্যাগের হাত ধরেই শুরু হয়েছিল লেখা।সেই ভাললাগা থেকেই লিখে যাওয়া। সেভাবে বিশেষ কোন ধরনের প্রতি আলাদা পক্ষপাত না থাকলেও, ভ্রমনের গল্প, কবিতা, অনু গল্প, গল্প সব রকমের লেখাই পছন্দের। আপাতত রাজ্য সরকারের অধীনস্থ সংস্থায় কর্মরত আর অবসর সময়ের সঙ্গী এই লেখা। বর্তমানে ব্লগ টগের মতন কয়েকটি অন-লাইন ব্লগের সাথেও এই লেখালিখির সুত্রে জড়িত। প্রতলিপি বা Story Mirror এর মতন পোর্টালেও লেখা প্রকাশিত হয়েছে। এই নভেম্বরে Story Mirror আয়োজিত একটি সর্ব ভারতীয় প্রতিযোগিতায় “ট্যাটু” গল্পটি প্রথম পঞ্চাশটি গল্পের সূচীতে মনোনীত হয়েছে। লেখলেখির পাশাপাশি ছবি আঁকা, ছবি তোলা আর বেড়ানোর সখ আছে।

0 Comments

মন্তব্য করুন

Avatar placeholder

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।