আমার নবনীতাদি

সিদ্ধার্থ সিংহ on

কবে যে প্রথম নবনীতাদির বাড়িতে গিয়েছিলাম, এখন আর মনে নেই। না, তখনও সিঁড়ি-লাগোয়া ইস্পাতের চ্যানেলে বসানো চেয়ারে করে ইলেক্ট্রিকের মাধ্যমে তিনি ওঠানামা করতেন না।
তার পর মাঝে মাঝেই যেতাম ‘সানন্দা’ পত্রিকার জন্য কবিতা আনতে।
আমি তখন লীলা মজুমদার, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, সুচিত্রা ভট্টাচার্য, মহাশ্বেতা দেবীর সঙ্গে অনেকগুলো সংকলন যুগ্ম ভাবে সম্পাদনা করে ফেলেছি।
আনন্দ প্রকাশন থেকে আমাকে একদিন বলা হল, আমাদের কয়েকটা সংকলন করে দাও না…
আমি বেশ কয়েকটা সংকলন করে দিলাম। হঠাৎ  মনে হল, অনেক বিখ্যাত লেখকই তো কবিতা দিয়ে লেখালিখির জীবন শুরু করেছিলেন। আবার অনেক প্রথিতযশা কবিও এমন এক-একটা গল্প লিখেছেন, যেগুলো যে কোনও গল্পকারের গল্পকেও হার মানাবে। আমি যদি সেই সব কবিদের গল্প নিয়ে একটা সংকলন করি, তা হলে নিশ্চয়ই সেটা বাংলা সাহিত্যে একটা মাইলস্টোন হয়ে থাকবে।
আমি না-হয় মূল কাজটা করলাম, কিন্তু সঙ্গে তো একজন সিনিয়ার কাউকে চাই। তখনই আমার মাথায় এল নবনীতাদির কথা। ওঁকে বলতেই, ওঁ সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেল। কিন্তু সমস্যা হল, লেখক তালিকা নিয়ে।
আমি যাঁদের সঙ্গে এর আগে এবং পরবর্তিকালেও, যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছি, তাঁদের মধ্যে যেমন ছিলেন চৌরঙ্গী-খ্যাত ঔপন্যাসিক শংকর, তেমনি ছিলেন সম্পাদকদের সম্পাদক, লেখকদের লেখক, লালবাঈ-খ্যাত রমাপদ চৌধুরীও। কিন্তু না, তাঁদের কারও সঙ্গেই আমার কখনও কোনও সমস্যা হয়নি। আমি যে লেখক তালিকা সাজাতাম, সবাই তা একবাক্যে মেনে নিতেন। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল নবনীতাদির সঙ্গে। এবং আমার সম্পাদনার জীবনে সেটাই প্রথম।
নবনীতাদি জানতেন, সম্পাদনায় আমার হাতেখড়ি হয়েছে রমাপদবাবুর কাছে। রমাপদবাবুকে উনি খুব ভাল করেই চিনতেন। রমাপদবাবুর কালীঘাটের বাড়িতে তাঁর ছোট মেয়েকে নিয়ে তিনি প্রায়ই আসতেন। সেই লোকটার সঙ্গে আমার কী সম্পর্ক, উনি তা ভাল করেই জানতেন। তবু…
যে দু’টি মানুষ রমাপদবাবুর অত্যন্ত কাছের ছিলেন, তার একজন আমি আর অন্য জন হলেন নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ি। এ সব জানার পরেও তিনি আমার লেখক-তালিকা নিয়ে ঘোরতর আপত্তি জানালেন।
না, উনি কোন কোন নাম বাদ দিতে চেয়েছিলেন এবং কোন নামগুলো ঢোকাতে চেয়েছিলেন, সেই নামগুলো আমি আর উল্লেখ করতে চাই না।
আমি শুধু বলেছিলাম, সম্পাদনার ক্ষেত্রে আমার কিছু পলিসি আছে। কারণ, সব বিখ্যাত লেখকদের কাছ থেকেই আমার লিখিত অনুমতি নেওয়া আছে। আমি তাঁদের লেখাই রাখব, যাঁদের বই ইন্ডিভিজুয়ালি তাঁদের নামে বিক্রি হয়। তাঁদেরই রাখব, যাঁরা সময়ের বিচারে এর মধ্যেই উতরে গেছেন। রাখব তাঁদেরই, যাঁরা ইতিমধ্যেই প্রয়াত হয়েছেন। না, জীবিত লেখকদের লেখা রাখার একেবারেই পক্ষপাতি নই আমি।
আমি যখন আমার সিদ্ধান্ত থেকে একচুলও নড়তে নারাজ, তখন তিনি বললেন, তা হলে একটা কাজ করো, আমার নামটা আর রেখো না। আর রাখলেও, তোমার নামটা আগে রাখো, আমার নামটা পরে।
আমি যখন যাঁর সঙ্গে যৌথ ভাবে কোনও সংকলন সম্পাদনা করেছি, খুব স্বাভাবিক ভাবেই আমার নামটা তাঁদের পরে রেখেছি। কিন্তু এ কী বলছেন তিনি!
তিনিও নাছোড়বান্দা। তাঁর জায়গা থেকে তিনি কিছুতেই সরবেন না। অগত্যা দু’জনকেই কিছুটা সমঝোতা করতে হল। অবশেষে পঞ্চাশ জন কবির এক-একটা অনবদ্য গল্প নিয়ে প্রকাশিত হল— কবির কলমে গল্প।

নবনীতাদি, মানে নবনীতা দেবসেন থাকতেন দক্ষিণ কলকাতার হিন্দুস্থান পার্কে। তাঁর বাড়ির নাম ‘ভালবাসা’। সেখানেই ১৯৩৮ সালের ১৩ জানুয়ারি তিনি জন্মগ্রহন করেন। বাবা ছিলেন বিখ্যাত কবি নরেন্দ্র দেব। মা রাধারানী দেব। বাড়ির সাহিত্য আর সাংস্কৃতিক পরিবেশেই তাঁর বড় হয়ে ওঠা। গোখেল মেমোরিয়াল স্কুলে পড়াশোনা। পরে লেডি ব্রাবোর্ন, প্রেসিডেন্সি কলেজ এবং যাদবপুরে। তারও পরে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিসটিংশন নিয়ে আবারও এম এ। পি এইচ ডি করেন ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পোস্ট ডক্টরেট ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
১৯৭৫ থেকে ২০০২ সাল অবধি তিনি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্যের অধ্যাপিকা ছিলেন এবং বেশ কিছু কাল বিভাগীয় প্রধানও ছিলেন। এ ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপেরও বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবেও পড়িয়েছেন। তাঁকে তুলনামূলক সাহিত্যের একজন বিশিষ্ট জন হিসেবেই গণ্য করা হয়।
বাংলা ও ইংরেজি ছাড়াও হিন্দি, ওড়িয়া, অসমিয়া, ফরাসি, জার্মান, সংস্কৃত এবং হিব্রু ভাষাও তিনি জানতেন।
১৯৫৯-এ তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রথম প্রত্যয়’ প্রকাশিত হয় এবং প্রথম উপন্যাস ‘আমি অনুপম’ ১৯৭৬-এ। কবিতা, প্রবন্ধ, রম্যরচনা, ভ্রমণ কাহিনি, উপন্যাস মিলিয়ে তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৩৮।
তিনি দীর্ঘ দিন ‘রামকথা’ নিয়ে কাজ করছেন। সীতার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তিনি রামকথার বিশ্লেষণ করেছেন। ‘চন্দ্রাবতী রামায়ণ’ তাঁর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ।
১৯৬০-এ বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ (পরবর্তী কালে নোবেলজয়ী) অমর্ত্য সেনের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। তাঁদের দুটি মেয়ে। বড় মেয়ে অন্তরা সাংবাদিক ও সম্পাদক। ছোট মেয়ে নন্দনা অভিনেত্রী ও সমাজকর্মী।
পড়াশোনা এবং পড়ানোর ব্যস্ততার মধ্যেও কিন্তু নবনীতাদির কলম কখনও থেমে থাকেনি। একের পর এক লিখে গিয়েছেন কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, ভ্রমণকাহিনী, উপন্যাস। রম্যরচনাতেও ছিল তাঁর নজরকাড়া মুন্সিয়ানা।
আত্মজীবনী মূলক রম্যরচনা ‘নটী নবনীতা‘ গ্রন্থের জন্যে তিনি ১৯৯৯ সালে সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার পান। ২০০০ সালে পদ্মশ্রী সম্মান ছাড়াও পেয়েছেন মহাদেবী বর্মা ও ভারতীয় ভাষা পরিষদ ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান থেকেও অজস্র পুরস্কার।
এক ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করেও একটা মানুষ যে এত রসিক, এত মন খোলা হতে পারেন, নিজেকে নিয়ে, এমনকী, নিজের ক্যানসার হয়েছে জানার পরেও, নিজের মৃত্যু নিয়েও কেউ যে এত মজা করতে পারেন, তা একমাত্র নবনীতাদিকে সামনে থেকে না দেখলে বা তাঁর লেখার নিমগ্ন পাঠক না হলে কেউ বিশ্বাসই করবেন না।
এই তো কিছু দিন আগে এক বিশেষ অনুষ্ঠানে কলকাতায় এসেছিলেন অমর্ত্য সেন। নবনীতাদি শুধু আমাকে নয়, আমার ছেলেকেও নিয়ে যেতে বলেছিলেন। এসেছিল নবনীতাদির মেয়ে-জামাইও। দারুণ জমে উঠেছিল সে দিন।


নবনীতাদি চলে যাওয়ার দু’দিন আগেও গিয়েছিলাম ‘ভালবাসা’য়। আমার সঙ্গে ছিলেন ভারতীয় হাইকমিশন, ঢাকা থেকে প্রকাশিত ‘ভারত বিচিত্রা’র সম্পাদক নান্টু রায়। না, ওঁর তখন ওঠার মতো অবস্থা ছিল না। আমি নবনীতাদিকে লাস্ট দেখেছিলাম, সদ্য নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় যে দিন ওঁকে দেখতে গিয়েছিলেন, সে দিন।
না, আর দেখা হবে না তাঁর সঙ্গে। তবে তিনি স্বশরীরে না থাকলেও, তিনি থাকবেন আমাদের মধ্যে। তাঁর লেখার মধ্যে।


ফেসবুক অ্যাকাউন্ট দিয়ে মন্তব্য করুন


সিদ্ধার্থ সিংহ

সিদ্ধার্থ সিংহ : ২০১২ সালের 'বঙ্গ শিরোমণি' সম্মানে ভূষিত সিদ্ধার্থ সিংহের জন্ম কলকাতায়। ১৯৬৪ সালে। ক্লাস নাইনে পড়ার সময়ই তাঁর প্রথম কবিতা ছাপা হয় 'দেশ' পত্রিকায়। প্রথম ছড়া 'শুকতারা'য়। প্রথম গদ্য 'আনন্দবাজার'-এ। প্রথম গল্প 'সানন্দা'য়। যা নিয়ে রাজনৈতিক মহল তোলপাড় হয়। মামলা হয় পাঁচ কোটি টাকার। ছোটদের জন্য যেমন সন্দেশ, আনন্দমেলা, কিশোর ভারতী, চির সবুজ লেখা, ঝালাপালা, রঙবেরং, শিশুমহল ছাড়াও বর্তমান, গণশক্তি, রবিবাসরীয় আনন্দমেলা-সহ সমস্ত দৈনিক পত্রিকার ছোটদের পাতায় লেখেন, তেমনি বড়দের জন্য লেখেন কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ এবং মুক্তগদ্য। 'রতিছন্দ' নামে এক নতুন ছন্দের প্রবর্তন করেছেন তিনি। এ পর্যন্ত প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা দুশো একচল্লিশটি। তার বেশির ভাগই অনুদিত হয়েছে বিভিন্ন ভাষায়। বেস্ট সেলারেও উঠেছে সে সব। এ ছাড়া যৌথ ভাবে সম্পাদনা করেছেন লীলা মজুমদার, রমাপদ চৌধুরী, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, মহাশ্বেতা দেবী, শংকর, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, সুচিত্রা ভট্টাচার্য, নবনীতা দেবসেন, রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়দের সঙ্গে। তাঁর লেখা নাটক বেতারে তো হয়ই, মঞ্চস্থও হয় নিয়মিত। তাঁর কাহিনি নিয়ে ছায়াছবিও হয়েছে বেশ কয়েকটি। গান তো লেখেনই। মিউজিক ডিরেক্টর হিসেবেও কাজ করেছেন বেশ কয়েকটি বাংলা ছবিতে। তাঁর ইংরেজি এবং বাংলা কবিতা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে কয়েকটি সিনেমায়। বানিয়েছেন দুটি তথ্যচিত্র। তাঁর লেখা পাঠ্য হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদে। ইতিমধ্যে পেয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ শিশু সাহিত্য সংসদ পুরস্কার, কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত পুরস্কার, কাঞ্চন সাহিত্য পুরস্কার, সন্তোষকুমার ঘোষ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা লোক সাহিত্য পুরস্কার, প্রসাদ পুরস্কার, নতুন গতি পুরস্কার, ড্রিম লাইট অ্যাওয়ার্ড, কমলকুমার মজুমদার জন্মশতবর্ষ স্মারক সম্মান, কবি সামসুল হক পুরস্কার, সুচিত্রা ভট্টাচার্য স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার, অণু সাহিত্য পুরস্কার, কাস্তেকবি দিনেশ দাস স্মৃতি পুরস্কার, শিলালিপি সাহিত্য পুরস্কার, চেখ সাহিত্য পুরস্কার ছাড়াও ছোট-বড় অজস্র পুরস্কার ও সম্মাননা। পেয়েছেন ১৪০৬ সালের 'শ্রেষ্ঠ কবি' এবং ১৪১৮ সালের 'শ্রেষ্ঠ গল্পকার'-এর শিরোপা।

0 Comments

মন্তব্য করুন

Avatar placeholder

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।