অর্পিতা সরকার-এর একগুচ্ছ কবিতা

ঈপ্সা
মাতামহী বালিকা আমিকে বলেছিলেন–
ধাতুপাত্র আর মৃতপাত্র ছোঁয়াছুঁয়িতে রাইখো না
পোড়ামাটি হইতে রক্ত ঝরে, স্বপনকলা খান খান কান্দে,
তারপর কত ভাঙচুর, জলখেলা…
ধাতুলোভ বেড়ে যায় বড়।
যতখানি প্রেম দিলে প্রাণে
রমণেও বিরহের সুখ কেঁদে কেঁদে মরে
ছিঁটেফোঁটা মন্ত্রপুত বায়ু
তোমার আমার মাঝে নবজাতকের মতো দেয়ালা সাজায়
ধাতুলোভ বেড়ে যায় বড়।
প্রিয়মুখ, মুক্তির পথে মাটির কলস থেকে
ফোঁটা ফোঁটা জলে বুক ভরে দেব।
তার আগে তরল আগুনে ঢেলে দেব আদরের খাদ
মুদ্রা দিয়ে কেনা যাবতীয় ঘা
রেখে যাব প্রজন্মের নামে
আমরা পেরেছি যা,
কঠিনে কুসুমে খেদ
ভালবাসা, তোমাদের
অক্ষয় লোভ দিয়ে যাব।
জীবন
জলের ডগায় যেমন শব ভেসে থাকে
সেই রকম ভাসা ভাসা বেঁচে আছি
চুপ করে চেয়ে দেখি
কালকূট যেন সুধা ধারাময়
কত আশ এ ধরায়, কত মায়া
ওই যে দিবসের সুর,
কুসুমবীজ ঠোঁটে উড়ে যায় পক্ষীবালিকা
নিমের চারাতে রোজ জল দেয় খুকু
শ্রান্ত মা চুমো আঁকে শিশুর কপালে
ঘেয়ো কুকুরের মুখে ধরে দেয় ভাত–
এইসব ছবি আলো দেয় চোখে
পরাণঘাটে চলকে ওঠে কোয়েলের জল
ওরই বালিপাড়ে বাঁধি পালকের ঘর,
ওগো সাধের জীবন,
চলো ধাতু খঁজি,
চলো আরও কিছুদিন বাঁচি।
চাঁদেরকণা
১.
আমার বন্ধু সন্ন্যাসী ভাবের মানুষ। আকাশে ঘুমের বড়ির মতো চাঁদ দেখে ঘর ছাড়বে পন করেছিলো। জেঠিমা দামাল জলের মতো বউ ঘরে আনল। পড়শি শাঁখ বাজালো, উলু দিলো। নতুন বউ শক্ত হাতে চেপে ধরল ল্যাটা মাছের ঘাড়।
২.
দুধভাতের থালা ধোওয়া জোছনা উঠেছে । নববধূ পুরনো হয়েছে। আঁচল আলগা করে ওই নিদ্রা গেছে সুখে। শুধু বন্ধুর চোখে ঘুম নেই। পথনিশি যে ডাকে। চলো যাই। এইবেলা চলো যাই। কী কারণে দেখো দোলনায় খোকা কেঁদে ওঠে। বঁধু জেগে দেখে সারাবাড়ি জুড়ে পুরাতনী চাঁদ, ছড়িয়ে রয়েছে।
আষাঢ়
এবার বৃষ্টি আসবে
নরম মেয়েমানুষের মতো মেঘ ঘিরে আছে
আমাদের পোড়ো ব্যথাভূমি
কবেকার কথা,
অতিত্ আসবে বলে গাড়ু গামছা গুছিয়ে রেখেছি দুয়ারের পাশে;
মাঝে মাঝে সংকেত আসে।
শুধু চৌকাঠ পেড়োয় বিমার
আমাদের অপয়া সংসার আমিষবারের হুলো
জমানো তন্দ্রা নিয়ে যায়
দ্যাখো, তোমার দীর্ঘ বাহুতে লাঙলের ধার
অথচ পঙ্গু হৃদয়!
মাধবী, মাধবী, তুমি ফুল ধরে রাখো
দুধকলম ধানে কোল ভরে গেলে
হতভাগী, মূষলধারাতে চোখ মুছে নিও।
দায়
কেউ নেই।
শুধু একফালি রাত আঁচলের খুঁটে
অন্ধকার —
শিয়রে মায়ের মতো বসে থাকে ঠায়,
বঁধুয়ার মতো মাথা রাখে পাঁজরের কোলে
আমি থির হয়ে থাকি।
পায়ের নিচে কালকুন্ডলী
ছুয়ে দিলে মৃত্যুসুধা ঢেলে দেবে সুখে
থির হয়ে থাকি।
মাত্র বেঁচে থাকা দায়
রক্তে তুষারপাত
তবু চোখ বুজে থাকি।
দৃশ্যের কাছে
আমাদের দেখা হয়ে যায় আবার,
কতোগুলি অনাথ শবদেহ কাঁধে;
গুমরে মরা আকাশটার নিচে।
আগের চেয়ে দুর্ভেদ্য তুমি
আমি বিচ্ছেদে লোভী
জীবনের কাছে কত কী চাইবার–
পুরুষের পরমায়ু শতবর্ষকাল
অথচ পিপাসার প্রাণ
ছটফটে সাঁতারমাছের মতো;
হাতে বিপদতারিনী ধাগা
মিলেমিশে আছি অযুত লাশের ভিড়ে,
সেই অপয়া কুশের আঘাতে ঝরে যেতে থাকি
একফোঁটা নদী, প্রণয় পরশ
চেয়ে চেয়ে হাহুতাশ
দিন ফুরোলে
ভগ্নকাঁচের মতো সীমানা পেরিয়ে দেখি
বেশরম বাতাস শুধু তোমাকে স্পষ্ট করেছে।
0 Comments