স্নানঘর

জয়দীপ চট্টোপাধ্যায় on

             স্নানঘর তো কেবল ‘স্নান’ ঘর থাকে না। ওখানেই টয়লেট সিট, বা প্যান বসে যায়। সিস্টার্ণ বসে যায়। চার ফিট বাই সাত ফিটের একটা লম্বাটে স্নানঘরেই কতকিছু। এমনকি কাপড়ও ওখানেই কাচতে হয়। ভাড়া বাড়ির যা হয়। যে থাকবে, সে বুঝুক। দরজার কাঠের ওপরে টিনের প্লেটিং। সেই টিনেও জং পড়ে জায়গায় জায়গায় মরচেগুলো ধারালো হয়ে উঠেছে। নতুন রঙ করে কি টিনের বেরিয়ে আসা দাঁত লুকনো যায়? মাকড়শাগুলো খুব কর্মঠ। নাহলে বুঝে নিতে হয় বাড়িওয়ালা মাকড়শার জাল আর ঝুলগুলোও ঝারার প্রয়োজন মনে করেন নি। কোনও কোনও জালে মুক্তোর মত তিনটি চারটি করে সাদা ফোঁটা গাঁথা। মনে হয় ভেতরে ডিম লালিত হচ্ছে। হালকা ভাবে দেখলেও তিনরকম প্রজাতির মাকড়শা চোখে পড়ল। এটা ওদের ঘর। এখানে ওরা থাকে। বাথরুমের দরজা খুলে আলো জ্বালাতেই কেমন সচেতন হয়ে উঠল। ত্রস্ত হয়ে উঠল কেউ কেউ। নতুন ভাড়াটে এলে এদের সপরিবার উচ্ছেদ করা কী ঠিক হবে?  ‎ওপর দিকে একটা ছোট জাফরির মত। ঢালাই সিমেণ্টের ছাঁচ। সেখান থেকে বাইরের আলো এসে পড়ে। পাখির পালক বা শুকনো গাছের পাতা যে ভাবে মাকড়শার জালে আটকে, তাতে বোঝা যায় তারাও ওই জাফরি দিয়েই আসে। আর আসা যাওয়া করে টিকটিকি। দুটো দেখলাম। পূর্ণবয়স্ক। শান্ত ভাবে চেয়ে আছে, আলোর কাছাকাছি। উৎকৃষ্ট মানের হুইস্কি খেয়ে, তার সঙ্গে সিগারেট খেলে মানুষের গা থেকে হুইস্কি আর সিগারেটের গন্ধ মিশে একটা অন্যরকম গন্ধ সৃষ্টি হয়। মনে হ’ল হালকা একটা গন্ধ পেলাম… ঠিক সেরকম। জিজ্ঞেস করতে বাড়িওয়ালা বললেন – ‘সকালেই ফিনাইল দিয়ে পরিষ্কার করিয়েছি, সেই গন্ধ।’ আমি বললাম ‘না’। তখন বললেন – ‘তাহ’লে একতলায় কেউ বিড়ি-সিগারেট খাচ্ছে হয়ত।’ আর কিছু বললাম না। বাথরুমের মেঝেটা পরিষ্কারই, সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই।
— — —
             নাইট শিফটের কাজ। প্রথম পাঁচদিন সন্ধের পর থেকে ঘরেই থাকা হয়নি। আর, এমনি দিনে রাত জেগে জেগে এমন হয়, যে ছুটির দিনে রাতে আর ঘুম আসে না। শনিবার রাত, তখন ঠিক ক’টা বাজে কে জানে? এপাশওপাশ করতে করতে উঠে বাথরুমে যেতেই সেই গন্ধটা পেলাম। হুইস্কি আর সিগারেট মেশানো গন্ধ। হালকা, মিহি একটা গন্ধ। বেশ দামী হুইস্কি এবং সিগারেট। তাহলে একতলাতেই কেউ আছে, শৌখিন মানুষ। কমোডে বসে থাকতে থাকতে মনে হ’ল গন্ধটাও যেন স্পষ্ট হয়ে উঠছে। আরও জোরালো হয়ে উঠছে। কেমন একটা নেশার মত ঘোর লাগল। মনে হ’ল দেওয়ালের মাকড়শা আর টিকটিকিরাও চুপ করে বসে কিছু ঘটার অপেক্ষা করছে। ক্রমে বাথরুমের চেহারাটাই চোখের সামনে পালটে গেল। দেওয়ালের রঙ জ্বলে গেছে। পলেস্তারা খসছে। মেঝেতে শ্যাওলা। স্যাঁতস্যাঁতে ভাব। হঠাৎ করেই কেমন শীত করতে শুরু করল। আলোটা হলুদ থেকে হালকা বাদামী হয়ে যেতেই সড়সড় করে টিকটিকিগুলো জাফরির দিকে ছুটে গেল। আমি আচ্ছন্নের মত বসে দেখলাম সব। উঠে বেরনোর চিন্তা এলো, তবে হাত-পা কিছুই সড়ল না। আলোর রঙ তখন বদলে হালকা নীল, জাফরি দিয়ে এয়ার কণ্ডিশনের মত ঠাণ্ডা আসছে। নীলচে ধোঁয়া বেরোচ্ছে। মাকড়শাগুলো দ্রুত জাল বুনে যাচ্ছে চারিদিকে। যেন আমাকে সমেত গোটা ঘরটাকেই গুটিতে ঢেকে ফেলবে। এমন সময় মাথা তুলতেই হঠাৎ সিলিং-এর দিকে চোখ গেল। একটা হুক, সিলিং ফ্যান ঝুলনোর জন্য যেমন থাকে। তবে বাথরুমে আর কী ঝুলবে! ভাবার সঙ্গে সঙ্গেই মাকড়শাগুলো আট পায়ে ছুটে গিয়ে জড়ো হয়ে গেল হুকটার কাছে। জায়গাটা ঢেকে গেল মাকড়শায়। ক্রমে একটা ফাঁশ নেমে এলো সেখান থেকে। মাকড়শার লালা দিয়ে তৈরী ফাঁস, মোটা ফাঁস। ক্রমে গলায় এসে বসতে টের পেলাম সেটা তখনও ভিজে, হরহরে, ঠাণ্ডা। 
— — —
অতঃজাল পর -১) জাফরির ফাঁক দিয়ে আসা-যাওয়া করার একটা টেকনিক আছে। মাকড়শাগুলো অনেক কিছু দেখলেও, সবটা জানে না। আমিও প্র‍্যাক্টিস করছি।
২) রবিবার বিকেলেই বাড়িওয়ালা এসে বলল ঘর খালি করতে। এটা ভদ্রলোকের পাড়া। ওনার এক প্রতিবেশি নাকি ছাত থেকে দেখেছে – আমি মাতাল হয়ে বেলা অবধি বারান্দার মেঝেতে পড়ে ঘুমোচ্ছি, গায়ে জামাকাপড় কিছু নেই।
৩) আচ্ছা, এই হুইস্কি আর সিগারেটের ককটেল গন্ধটা ঠিক কেমন তা ধারণা আছে? কখনও সরাসরি অভিজ্ঞতা হয়েছে? এটা কি এতটাও গভীরে প্রবেশ করতে পারে কারো চেতনা বা সত্ত্বার… যে অশরীরী অবস্থাতেও তার অংশ হয়ে থাকবে? টিকটিকিগুলো চোখাচোখি হলেই এড়িয়ে যায়। আমিও সরে আসি দরজার আড়ালে।

ফেসবুক অ্যাকাউন্ট দিয়ে মন্তব্য করুন


জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়

বর্তমানে হায়দ্রাবাদ নিবাসী  হলেও, জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়ের শৈশব থেকে যৌবন সবটাই কলকাতার শহরতলী জুড়ে। জন্ম ২০শে আগস্ট, ১৯৮৬। বায়োটেকনলজিতে বি টেক শেষ করেই কর্মসূত্রে ২০০৮ সালে কলকাতা ছেড়ে বেঙ্গালুরু চলে যান, এবং তারপর হায়দ্রাবাদ। প্রায় দশ বছর হয়ে গেল, কলকাতার বাইরেই জীবন। বাংলা সাহিত্যের প্রতি নিবিড় ভালবাসা থেকেই একসময় লেখার ইচ্ছে জন্মায়। প্রায় সাত-আট বছর উনি একাধিক আন্তর্জাল পত্রিকা এবং মুদ্রিত পত্রিকায় লিখে চলেছেন গল্প, প্রবন্ধ, গদ্য এবং কবিতা। ২০১৩ সালে 'আদরের নৌকা' প্রকাশনা থেকে প্রকাশ পায় ওনার প্রথম গল্প সংকলন 'প্রতিবিম্ব'। এর পর ২০১৫ সালে  'হাওয়াকল' প্রকশনা থেকে প্রকাশ পায় ওনার প্রথম উপন্যাস 'কৃষ্ণঘন যাম'। ২০১৭ সালে 'হাওয়াকল' প্রকশনা  থেকেই প্রকাশিত হয় প্রথম অণুগল্প সংকলন 'টিনিটাস'। ২০১৮ সালের কলকাতা বইমেলায় 'তবুও প্রয়াস' প্রকাশনা থেকে জয়দীপের প্রথম গদ্য সংকলন 'হৃদয়পুর কত দূর?' প্রকাশ পায়। এই লেখার মধ্যেই তিনি আনন্দ খুঁজে পান। আর প্রতিযোগিতামূলক এই জীবনে এই লেখাই তাঁর কাছে একটা রিফিউজ। লেখার প্রতি ভালবাসার টানেই উনি লিখতে চান... যতদিন পারেন।

0 Comments

মন্তব্য করুন

Avatar placeholder

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।