শ্যামলা জাদুকর

কামরুজ্জামান কাজল on

সকাল হতে না হতেই পাবলিক লাইব্রেরি ক্যাফেটেরিয়াটি ছাত্রছাত্রীদের ভীড়ে উপচে পড়ে । প্রচন্ড শব্দ, হৈ হুল্লোড় সিরিয়াল এইসব কিছুর মধ্যেও একটা নাম বারবার উচ্চারিত হতে থাকে—মুরসালিন!
মুরসালিন পিপাসায় মরে গেলাম তাড়াতাড়ি পানি দে ত ভাই, একজন চেঁচিয়ে ডাকে । মুরসালিন এক কাপ চা, মুরসালিন পানি নাই, কোনার টেবিলে ডিমমালেট, অইখানে খিচুড়ি, মুরসালিন, কই রে এইদিকে আয়— গমগমে ক্যাফেটেরিয়ায় মুরসালিন ছাড়া কারোর চলেই না ।
দিনের এই ব্যস্ত সময়টাতে মুরসালিন খুব আনন্দে থাকে । কেন জানি নিজেকে খুব প্রয়োজনীয় মনে হয় ওর । চারপাশ থেকে যে-ই ডাকুক না কেন, দৌড়ে ছুটে যায় । ওর সদ্য কৈশরের জালিমাখা মুখটায় খেলতে থাকে কৌতুক । একটা অর্ডার নিয়ে এসে আবার ক্যাশের সামনে বাঁকা হয়ে দাঁড়ায় । মুরসালিনের লম্বা হাঁটুতে কি একটা অজানা রোগ আছে!
কিরে মুরসা দেখোছস, তর প্রিয় নীরা আফা আসতাছে—ক্যাশে বসা জাহাঙ্গীর ভাই মশকরা করে । মুরসালিন ওর শ্যামলা মুখ নিয়ে লজ্জা লজ্জা হাসে । অকারণেই মাথার কোঁকড়া চুলে হাত বুলাতে থাকে ।
কিরে শাউয়োর পো, তোরে না কইছি বাইরে দুইডা নাস্তা পাঠাইতে? কতসময় লাগে রে মান্দারির পু!—হাত উচিয়ে মুরসালিনের দিকে খেকিয়ে আসে পলিটিক্যাল দিপক দা । মুরসালিন ভয় পায় না, সোজা হয়ে দাঁড়ায় শুধু । মুখটা নিচু করে বলে— রুটি এখনো হয় নাই ভাই ।
নীরা আপা বান্ধবির সাথে এসে সামনের টেবিলটায় বসেই ডাকে— মুরসালিন, একপ্যাকেট বিস্কিট আর দুইটা চা । মুরসালিন চা নিয়ে কাছে যায় । আস্তে করে কাপটা টেবিলে রাখে । নীরা আপা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করে কেমন আছিস রে ছ্যাড়া! ব্যাগ থেকে একটা বিদেশি চকলেট বের করে দেয় । মুরসালিন মুখে উদাসীন ভাবটা ধরে রাখে । জোর করে ।
সন্ধ্যার পর ক্যাফেটেরিয়া বন্ধ হলে মুরসালিন পাশে ওর থাকার ঘরটায় ফেরে । পাঁচজনের এই ছোট্ট ঘরটায় ঢুকতেই মুরসালিনের দম বন্ধ লাগে । তাড়াতাড়ি গোসল দিয়ে খেয়ে প্রস্তুত হয় । কাজ আছে ।
শাহাবাগ মোড় । রাত তখন তিনটা । দীপক দা দাঁড়িয়ে বিড়ি খাচ্ছিলো। মুরসালিন একটা হুংকার দিতেই— দীপক দা দৌড়াতে থাকে । হাতের রামদাটা নিয়ে মুরসালিন পিছু ধাওয়া করে ।
একেতে রাত, ফাঁকা রাস্তা, আজিজ মার্কেট হয়ে কাঁটাবন দিয়ে দীপক দা দৌড়ে ওঠে নীলক্ষেতের মোড়ে । মুরসালিনও ওর লম্বা পা নিয়ে ধাওয়া করে চলেছে । মাঝে একবার ধরেই ফেলেছিলো মুরসালিন, একটা মাত্র কোপ দিতে পেরিছিলো, দীপকদার ডান হাতটা পড়ে আছে নীলক্ষেতের মোড়ে । দীপক দা কোন দিকে যাবে ঢাকেশ্বরী, টিএসসিসি, ফার্মগেট নাকি আজিমপুরে?
মুরসালিন খুব চাচ্ছিলো—আজিমপুরে না, কিন্তু দীপক দা’র ভাগ্য খারাপ! সেদিকেই ছুটতে থাকে সে । কি আর করা! আজিমপুরে নীরা আপার বাসার সামনেই দীপকদা পড়ে যায় । মুরসালিন একের পর একটা কোপ দিয়ে দীপকদার হাত, পা, শেষে ধড়টাও আলাদা করে ফেলে ।
রক্তে ভেসে যায় মুরসালিনের নীল শার্ট
রক্তে ভেসে যায় মুরসালিনের কোমল জালিমাখা মুখ
রক্তে ভেসে যায় মুরসালিনের কোকড়া চুলের পাটি
সামনের দোতলা বাড়ির জানলা থেকে নীরা আপা সব দেখে । টের পায় মুরসালিন । এই প্রথম মুরসালিনের বুকটা কেঁপে ওঠে । কাল সকালে কীভাবে মুখ দেখাবে নীরা আপার সামনে? মুরসালিন দৌড়াতে থাকে ।
দৌড়াতে দৌড়াতে মন্ত্র পড়ে মুরসালিন । সে জানে সে বিছানায় । শুধু মন্ত্রটা শেষ হলেই আবার ফিরে যাবে । কিন্তু একি, মন্ত্র ! কোথায় সে মন্ত্র পড়ছে? মুরসালিনের মুখে শুধু একটাই নাম!
কালো জাদুর এই শহর থেকে বের হবার জন্য মুরসালিন চিৎকার দিতে থাকে । জাহাঙ্গীর ভাইয়ের ঘুম ভেঙে গেলে হো হো করে হাসে জাহাঙ্গীর ভাই— কি রে আইজও তুই নীরা আপারে স্বপ্ন দেখতাছস?
তুই গেছস মুরসা!

ফেসবুক অ্যাকাউন্ট দিয়ে মন্তব্য করুন


কামরুজ্জামান কাজল

জন্মস্থান বাংলাদেশ, পাবনা জেলার ঈশ্বরদী উপজেলা । প্রায় তিন বছরেরও অধিক সময় ধরে অণুগল্প নিয়ে কাজ করছেন । ফেসবুক গ্রুপ "অণুগল্প" থেকেই মূলত অণুগল্পের হাতেখড়ি । এছাড়াও দেশের বিখ্যাত সব সাহিত্যপত্রিকায় ও ওয়েবজিনে তার অণুগল্প নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে । ইতোমধ্যেই প্রকাশিত হয়েছে দুটি একক অণুগল্প গ্রন্থ ১। দলছুট শালিকগণ (২০১৭) ২। আটপুকুরের ফুল (২০১৮) ২০১৬ সালে বের হয়েছে কাব্যগ্রন্থঃ শ্যাম পাহাড়ের আড়ালে । বর্তমানে লেখক "ত্রৈমাসিক অণুগল্প" পত্রিকার সম্পাদনা পর্ষদের সদস্য । অণুগল্প নিয়ে আছেন, অণুগল্প নিয়েই কাজ করে যেতে চান ।

0 Comments

মন্তব্য করুন

Avatar placeholder

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।