মাংস

সৌরভ সরকার on

mangsho

অজিত সামন্ত সাথে ব্যাবসা তে পেরে ওঠা টা সহজ ছিল না। মফস্বলের বিরিয়ানি দোকানে যে মেক্সিকান ইন্টেরিয়র ডেকোরেশন হতে পারে কেউ ভাবতেই পারে নি এর আগে। আবার দেওয়ালে দেওয়ালে ফ্রেম করে উত্তম সৌমিত্র থেকে সৌরভ গাঙ্গুলির ছবি বাঙালিয়ানা কে উস্কে দিয়ে ক্রেতা দের মন জয় করে নিয়েছিল। এই কম্পিটিশন টা পুরোনো ছকে জিততে হবে বুঝেছিলেন অনিল বাবু। ডেকোরেশন এ নয় জিততে হবে স্বাদ এ সুগন্ধে। সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ নিয়েছিলেন কলকাতা স্টাইলে ছেড়ে যখন লোকনৌ করবেন ভেবেছিলেন। কারণ কলকাতার থেকে দাম অনেক বেশি পড়ে যায়। বিরিয়ানিতে কলকাতার তুলনায় অনেক বেশি মাংসের টুকরো দিতে হয়। বিরিয়ানিতে এত বেশি পরিমাণে মসলা দিতে হয় যা সাধারণ বিরিয়ানিতে থাকে না ।আবার সেই মশলা এমন ভাবে মেশাতে হবে যেনো তা একদম মিশে যায়। আওধের নবাব রা চাইতেন না মশলা মুখে পড়ুক। এবং গোটা রান্না টাও চার ঘণ্টার বিশেষ তামার বাসনে। এসব তিনি লকনৌ গিয়ে ইদ্রিস ও রহিমের দোকান থেকে জেনেছিলেন।

মশলা আতরও কিনেছিলেন মাসালা মান্ডির গুপ্ত স্টোর থেকে। পুরো সাপ্লাই টাও তিনি ওখান থেকেই নিতেন পরে। শুধু বাকি ছিল রাধুনী। কেউ এতো দূরে এসে কাজ করতে রাজি ছিল না। সারা লখনৌ তিনি আর পিসতুতো ভাই মিলে চষে ফেলেছিলেন।

জেদ চেপে গিয়েছিল অনিল বাবুর। লাভ এর কথা না ভেবেই ডবল মাইনে দিয়ে নিয়ে এসেছিলেন সেলিম চাচা কে। তিন কুলে কেউ না থাকা সেলিম চাচা চলে এসেছিলেন। কথাই আছে বিরিয়ানি কেমন হবে তা নির্ধারণ করে রাধুনীর ভাগ্য। এক সপ্তাহ ঘুরতে পারেনি রাস্তায় ভেসে যাওয়া গন্ধ তে দোকানে উপচে পরেছিল ভিড়।দাম অন্য দের থেকে বেশি হওয়া সত্বেও দূর দূরান্ত থেকে খেতে আসতে লাগলো মানুষ। প্রশংসার সাথে বাড়তে লাগলো ক্যাশ বাক্সোর আকার। কিন্তু তার সাথে চাচার মাসে মাসে মাইনে বাড়াতে গিয়ে লাভের অনেক টা অংশ চলে যাচ্ছিলো চাচার পকেটে । পরিবার হীন চাচার এতো টাকার প্রয়োজন কেনো প্রথমে বোঝে নি অনিল বাবু। বোতল বোতল বিদেশী মদ এ চাচা চুর হয়ে থাকতো সব সময়। জুয়া লটারি এসব তো ছিলই সঙ্গে ছিল কথায় কথায় জোগাড়ে দের সাথে ঝামেলা। দিন দিন সমস্যা বাড়ছিল।

কিন্তু বেশি দিন সে সমস্যা আর রইলো না। সমস্যা আর লাকনৌ ঘরানা দুটো কেই সঙ্গে নিয়ে চলে গেলেন সেলিম চাচা। তার লিভারে যে সিরোসিস ছিল কোনো দিন জানতে দেন নি তিনি। হয়তো মদ খেয়ে যাওয়ার আসক্তির জন্য। এই রকম একজন কারিগর এইরকম এক জন শিল্পীর চলে যাওয়া টা মেনে নিতে কষ্ট হয়েছিল অনিল বাবুর। যারা তার গুণমুগ্ধ ভক্ত ছিল তারাও দিনের পর দিন ফিরে যেতে লাগলো। তখন আবার নতুন করে শুরু করার কথা ভাবতে হলো তাকে।

কিন্তু এইবার আর লখনৌ বিরিয়ানি কারিগর পাওয়া গেলো না। অগত্যা মুর্শিদাবাদ থেকে অজিত সমন্তর কন্টাক্ট এ খুঁজে নিয়ে এসেছিলেন বিশু কে। মনে মনে আনন্দ পেলেও অজিত সামন্ত তখন পাশে দাড়িয়েছিল তার। আনন্দের কারণ টাও পক্তো ছিল অজিতের। কারণ এবার অনিল বাবু কে কারিগরের অভাবে ফিরতে হলো কলকাতা স্টাইলে।

বছর তিরিশের এর বিশুর চেহারা বাঘের মত। তেমনি খাটতে পারে সে। না আছে কোনো নেশা না আছে টাকা পায়সার খিদে। অনেক কম মাইনে তে সে রাজি হয়ে গিয়েছিল। তার আসার পর জোগারী দের ও আর প্রয়োজন হচ্ছিল না। দোকান খুলে রাতে প্লেট বাসন মাজা পর্যন্ত কাজ ছাড়া সে কিছুই বুঝত না । সমস্ত কিছু তে সে পারদর্শী। শুধু রান্না টা ..

রান্না টা খুব ভালো না হলেও দোকানে আগের মত ভিড় না হলেও কস্ট বেনিফিট এ অনিল বাবুর পুষিয়ে যাচ্ছিলো। সমস্যা টা ছিল অন্য জায়গায়। বিশু আসার পর থেকে এখন আর মাংস টা আর কেটে আসেনা।

আগে দাস মিট সেন্টার থেকে পুরো পিস করে চলে আসতো। এখন পুরো পাইকারি রেট এ অস্ত চলে আসে। পুরো দায়িত্ব টা বিশুই নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে। কারণ তার বাবা যখন তাদের ফেলে বিহারে চলে যায় বছর ষোলোর বিশু কে তখন তার মা বাজার সমিতির মেম্বার কে ধরে অনেক কাকুতি মিনতি করে কাজে দিয়েছিলেন বহরমপুরের সব চেয় বড়ো রেয়াজি খাসির দোকানে। পাশাপাশি দেশী পোল্ট্রির মুরগি টাও সেখানে বিক্রি হতো। মন দিয়ে দুটো কাজই শিখেছিল সে।

কিন্তু কিছু বছর পরে হঠাৎ মালিক কিছু একটা লক্ষ্য করে ছাড়িয়ে দিয়েছিল তাকে। পরে ইমাম বিরিয়ানির দোকানে যুগারি হিসাবে ঢুকেছিল সে। বহু কষ্টে রান্না টা শিখেছিল বিশু। কারণ ইমামের লোক জন তাকে বিশেষ পছন্দ করতো না।

বহু বছর সেখানে সহকারী হিসাবে কাজ করার পর যখন একদম হেড রাধুনী করে নিয়ে এলেন অনিল বাবু, তখন যেমন আনন্দ হওয়া স্বাভাবিক তেমন আনন্দ অনুভব হয়নি বিশুর।

কারণ তার সমস্ত আনন্দ অনুভূতি জড়িয়ে ছিল ঐ তাজা গরম রক্তে । ঐ রঙ এক অদ্ভুত স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে দেয় তারা মাথায়। যেনো পৃথিবীর যত সুখ যত শান্তি যত পবিত্রতা ঐ লালের মধ্যে লুকিয়ে আছে। রক্ত না দেখতে পেলে যেনো রাতে ঘুম আসে না তার।

ভোর সকালে বাজার থেকে ফিরে দোকানের পিছনে রোজ নির্মম ভাবে সে হত্যা লীলা করে । ছাগল গুলো কে জ্যান্ত ছুলে ফেলে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তারা চিৎকার করতে থাকে। যত বেশি রক্ত ঝরবে ততো বেশি সুখ বিশুর। মুরগি গুলোর পাখনা ছেড়ার পর তারা ছট্ফট্ করতে থাকলে গলা হাত দিয়ে ছিড়ে ফেলে মাথা টাকে মাটিতে ফেলে দেওয়ার পর ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটে এসে যখন মুখ ভিজে যায় বিশুর তাকে দেখলে বুকের রক্ত হিম হয়ে আসে । মাংস রান্নার সময় টা তেও এক অদ্ভুত পৈচাশিক হাসি ছড়িয়ে পড়ে তার মুখে লক্ষ্য করেছেন অনিল বাবু। এই রূপ যে দেখবে তার শিরদাড়া পর্যন্ত ঠান্ডা হতে বাধ্য।

তবে এত সকালে বাজারে কেউ থাকে না। তাই রাতের গার্ড রা ছাড়া তেমন কেউ চাতালের পিছনে ছাগল মুরগি গুলোর চিৎকার করার বিষয় টি নিয়ে অনিল বাবু কে বলে নি।

“একটু আস্তে সুস্তে করতে পারো তো বিশু।” সহ্য করতে না পেরে কয়েক বার বলেছেন রতন বাবু।

“মৃত্যু তো মৃত্যুই বড়ো বাবু .. যন্ত্রণা তো যন্ত্রণাই .. মাংস টা তো মাংসই ” দার্শনিকের মত জবাব দিয়েছিল বিশু।

“নতুন কারিগর পেলে ছাড়িয়ে দিতে হবে। এ জিনিস বেশি দিন চলতে দেওয়া যায় না”

পিছনের চাতালে রক্তের নদী তে স্লিপ খেয়ে পড়ে যেতে যেতে টাল সামলিয়ে নিয়ে ভেবেছিলেন অনিল বাবু।

পাক্কা দু’মাস লকডাউনের পর দোকান খোলার অনুমতি মিলেছে অবশেষে। তবু এই দুমাস রোজ দোকানের শাটার খুলে পিছনের চাতালে গিয়ে দাঁড়িয়ে থেকেছে বিশু। পাগলের মত তাকিয়ে থেকেছে শুধু চাতালে। বাড়ি ফিরে সেই অস্থিরতা তাকে গ্রাস করেছে প্রতিটা মুহূর্তে ।

রাতে ঘুমোতে পারেনি। বসে থেকেছে বস্তির দাওয়ায়।

কখনো অস্থির হয়ে পাগলের মত ছুটে বেড়িয়েছে শুধু। কোথায় যাবে কি করবে কাকেই বা প্রকাশ করবে তার ভিতরে কি ঝড় চলছে বুঝতে পারেনি সে। এ কথা বললে কেউ কি বুঝত। হয়তো হেসেই উড়িয়ে দিত। দম বন্ধ হয়ে আসে বিশুর। কারণ তার সমস্ত আনন্দ অনুভূতি সমস্ত সত্তা জুড়ে ছিল তার কাজ। যে সকাল তার শুরু হতো এক বিভৎস আনন্দ উল্লাসে এখন তা এক গাঢ় বিষণ্ণতা।

রক্তের তৃষ্ণা তাকে পাগলের মত করে তুলেছে এ কটা দিনেই। বাকি দিন গুলো কি হবে ভাবতে পারেনা সে।

আজ বাজারে গিয়েও তাকে ফিরতে হয়েছে খালি হাতে। সাপ্লাই নেই। মাল আসতে পারছে না সব আটকে আছে লক ডাউন এ। অার তা ছাড়া মালিক রান্না বন্ধ রাখতে বলেছে। এই লক ডাউন এ খরিদ্দার আসবে না। শুধু শুধু মাল নষ্ট। তাছাড়া দোকান খোলার উপরেই নিষেধাজ্ঞা আছে।

অগত্যা কোনো উপায় না দেখে সে শেষ মেষ ইচ্ছা না থাকলেও মুরগি পঞ্চুর হতে পায়ে ধরে। কিন্তু লাভ হয়নি। দোকানি ঠিক মত খুলছে না খরিদ্দার ও নেই কে দেবে কাজ এই সময় তাকে। উল্টে যারা কাজ করতো তাদেরই ছাঁটাই চলছে।

এই রকম কঠিন সময় তার জীবনে উপস্থিত হবে সে ভাবতে পারে না। সে কখনই কল্পনা করতে পারেনি এইরকম অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। তার অভ্যেস তার অস্তিত্ব কে যে সময় এইরকম অন্ধ কুঠুরির মধ্যে আটকে গলা টিপে হত্যা করবে তা কল্পনাতীত। দোকানে ফিরে শুধু চপারটার দিকে তাকিয়ে আছে সে। সে কি অন্যায় করছে নিজের সাথে? সেকি অন্যায় করছে অস্ত্র টার সাথে?

চপার এর ধার টাও কমে এসেছে যেন। প্রিয় অস্ত্র টা চক চক করতো তার। আর আজ বহু কষ্টে যেন সে বলতে চাইছে “কি রে আমাকে আনন্দ দিবি না .. আমাকে ব্যাবহার কর.. নিবৃত্ত কর যা তুই চাইছিস.. এ শরীরে যে বড়ো খিদে “

কেদে ফেলে বিশু।

ভোরে হাওড়া স্টেশন এ এসেছেন অনিল বাবু। সুমিত মুম্বাই থেকে ফিরছে আজ। ছেলে তিন বছর দূরে থাকে ঠিকই কিন্তু ও আসার সময় এই টুকু বাড়িতে বসে অপেক্ষা করা যেনো ভীষণ কঠিন হয়ে পড়ে।

মা মরা ছেলেটাকে ভীষণ কষ্ট করে মানুষ করেছিলেন অনিল বাবু। সুমিত মা মারা যাওয়ার পর যখন ওর মামা বাড়ির লোকজন চেয়েছিল সুমিত মামার বাড়ি এসে থাকুক পড়াশুনো করুক .. মামা দের শিক্ষা তে শিক্ষিত হোক, অনিল বাবু এক কথায় না করে দিয়েছিলেন। তারপর বহু দিন যোগাযোগ রাখেনি তারা অনিল বাবুর সাথে।

সেই সময় নতুন দোকান শুরু করছেন। ব্যাবসার চাপে নিজে হাতে লেখা পড়াটা শেখাতে পারেননি ঠিকই কিন্তু সুমিত নিজের চেষ্টায় উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষাতে জেলার মধ্যে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে। পরে আই আই টি, জে ই। দ্বিতীয় বারের চেষ্টা তে আইআইটি মুম্বাই।

ওর দাদু দিদা এসে যখন বলেছিলো

” তোমার বাবা কে আমরা ভুল বুঝেছিলাম, কিন্তু তুমি তোমার বাবার মুখ উজ্জ্বল করে আমাদের ভুল ভাঙিয়ে দিয়েছ।”

গর্বে চোখে জল এসে গিয়েছিল অনিল বাবুর।

সেই ছেলে কে প্রায় এক বছর পরে দেখবেন আজ।

কিন্তু ফোন টা হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেছে । ফোনের ব্যাটারি টা চার্জ দেওয়া সত্ত্বেও ব্যাটারি লো দেখিয়ে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে কিছু দিন ধরে। ফোনটার ও বয়েস হয়েছে। লক ডাউন এ নতুন ফোন ও নেওয়া হয়নি। অন্য কারো ফোন থেকে যে করবেন সে উপায় নেই। সুমিত এর নতুন নম্বর টা ফোনে সেভ করা মুখস্ত নেই। ইতস্তত ঘুরতে লাগলেন তিনি। এমনিতে ভীষণ বুদ্ধিমান সুমিত। যেকোনো সমস্যা কে ঠান্ডা মাথায় হ্যান্ডেল করতে পারে সে। তাই অত চিন্তা নেই যদিও।

বাবা কে ফোনে না পেয়ে বাড়িতে না গিয়ে সোজা দোকানে চলে এসেছে সুমিত।

বহুদিন পর দোকানে এসে বেশ ভালো লাগছে। একদম ভোল পাল্টে গেছে দোকানের। বোঝাই যাচ্ছে বহু দিন খরিদ্দার আসে নি।

এতো সকালে পাশের দোকান গুলোও খোলে নি। তার পর লক ডাউনের রেশ ও কাটেনি এখনও। ক্যাশ কাউন্টারে একটা ধুপ জ্বলছে আরাদ্ধ দেবতার সামনে তার সুগন্ধে সকালের পরিবেশ টা অন্য রকম স্নিগ্ধ। এতো টা জার্নি করে এসেও কোনো ক্লান্তি যেনো স্পর্শ করতে পারছে না তাকে। শুধু রাস্তার ড্রেনের পাশে কাকগুলো সকালের নিস্তব্দতা টা কে মাঝে মাঝে ভেঙে দিচ্ছে এই যা। ছোটো বেলার স্মৃতি গুলো মাঝে মাঝেই ভিড় করছে মনে। বিশেষ করে হালখাতার কথা। যদিও বাকি বা পাওনা গন্ডা এ ব্যাবসা তে তেমন থাকে না তবু অক্ষয় তৃতীয়া একটা ট্র্যাডিশন এখানে।

বিকেলে ঘুম থেকে উঠে নতুন পাঞ্জাবী পরে দোকান এসে বাবার পাশে বসে রাত পর্যন্ত মিষ্টি আর ক্যালেন্ডার এর প্যাকেট দেওয়া।

অার বাবা নতুন খাতা তে নাম লিখে পাশে টাকার অঙ্ক লিখে দেওয়ার পর যে কত সুন্দর হেসে প্রণাম করতো। সে হাসি তে কোনো খাদ থাকতো না। সব শেষে পড়ে থাকা সমস্ত ঠান্ডা পানীয় খেয়ে ঠোঁট হলুদ করে বাড়ি ফেরা। সেসব যেনো সিনেমার মতো আজও চোখের সামনে দেখতে পাওয়া যায় ইচ্ছা করলেই।

– “কে ? “

চাতাল থেকে দোকানে ফিরে এসে অচেনা লোক দেখে রুক্ষ গলায় বললো বিশু।

_ ” হ্যাঁ ?” আচমকা সম্বিত ফিরতে দেরি হলো সুমিতের। স্মৃতি যত পুরোনো তত বেশি বর্তমানে ফিরতে সময় লাগে তাঁর।

– আমি মুম্বাই থেকেই আজ সকালে এলাম .. আসলে আপনি হয়তো আমাকে চিনবেন না..

_ চেনার দরকার নেই। যত না চিনব তত ভালো..

একটু দোকানের পিছনে আসবেন ?

সুমিত কে থামিয়ে দিয়ে অসম্ভব কঠিন গলায় বললো বিশু। যেনো সে আর নিজের মধ্যে নেই। যেনো অন্য কোনো শক্তি তার গলায় ভর করেছে।

_ মানে কেনো ..

প্রশ্ন টা করতে গিয়েও মিনমিন করে থেমে যায় সুমিত। এইরকম ভয়ংকর গলা আর চেহারা দেখে তার আর প্রশ্ন করার সাহস হলো না। সে একমুহূর্তে ভুলে গেলো দোকান টা তাদের ..

_হ্যাঁ চলুন..

কিছু না বুঝেই চেয়ার থেকে বাধ্য শিশুর মতো উঠে দাড়ালো সুমিত।

দুপুরে ফিরলেন অনিলবাবু। সুমিত কে না পেয়ে ক্যাব বুক করে সোজা চলে গিয়েছিলেন বড়ো বাজার। দোকান খুললে বেশি দিনের মশলা অার নেই তাই একেবারে অর্ডার টা করিয়েই এলেন। আর ছেলে তো ছোট নয় বাবা কে না পেয়ে সে নিশ্চই বাড়ি ফিরে যাবে।

রাস্তা থেকে আসার সময় গন্ধ টা পাচ্ছিলেন। বারণ করা সত্বেও বিশু টা রান্না চাপিয়েছে আজ। তবু ভালো সকালে ব্যস্ততাই কিছু খেতে পারেন নি। তাই আজ প্রথম বার বিশুর হাতে খাবেন ভাবলেন। বিশু আসার পর চেখে দেখা ছাড়া পাত পেরে খাওয়া হয় নি।

“বিশু.. কই রে ..” হাঁক দিয়ে ডাকলেন অনিল বাবু।

_ রান্না করতে বলেছি ? খরিদ্দার আছে? ” ধমক দিয়ে বিশুর দিকে তাকিয়ে থেমে গেলেন অনিল বাবু। লাল চোখ দুটো যেনো জ্বলছে। অসম্ভব পাশবিকতা ফুটে উঠেছে বিশুর সারা মুখে।

এতো টা আগে দেখেন নি অনিল বাবু। এই রকম লাগছে কেনো আজ ওকে ? বুঝতে পারলেন না তার বোঝার কথাও নয়।

_ “দে দে কি করেছিস দে .. বড্ডো খিদে পেয়েছে বাবা..”

একটু নরম হয়ে বললেন অনিল বাবু।

কোনো কথা না বলে চলে গেলো বিশু। কিছুক্ষণ পরে থালা ভরা বিরিয়ানি নিয়ে এলো বিশু।

হাত ধুয়ে শুরু করলেন অনিল বাবু।

কিন্তু একি !! এ যেনো অমৃত। যেমন ভালো রান্না। তেমন সুস্বাদু মাংস। এতো ভালো মাংস তো বিশু কখনো করেনি। আজ কি যাদু করেছে সে।

গোগ্রাসে খেতে থাকলেন অনিল বাবু।

“এতো ভালো রান্না করেছিস তুই? “

খাওয়া শেষ করে পরম স্নেহে বিশু কে জিজ্ঞাসা করলেন অনিল বাবু। চুপ করে রইলো বিশু। যেনো রাগে ফুঁসছে সে।

হটাৎ রান্না ঘর থেকে হাসি মুখে বেরিয়ে এলো সুমিত। সুমিত কে দোকানের রান্না ঘর থেকে বেরোতে দেখে অবাক হলেন অনিল বাবু।

_ “খুব রেগে আছে বাবা .. সব কিছু আমি করেছি বলে .. ওই জন্য হয়তো কথা বলছে না। তোমার জন্য আমি বিরিয়ানি টা শিখেছিলাম কলেজে .. এতো বড়ো সারপ্রাইজ টা দেওয়া থেকে তোমার বিশু কেনো কেউ আমাকে আটকাতে পারত না। ” বিশুর দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বললো সুমিত। ঝড়ের বেগে দোকান থেকে বেরিয়ে গেলো বিশু।

তার গতিবেগ দেখে মনে হলো না সে আর ফিরবে।


( সমাপ্ত )

ফেসবুক অ্যাকাউন্ট দিয়ে মন্তব্য করুন


সৌরভ সরকার

প্রথম কবিতা প্রকাশ সপ্তম শ্রেণী তে স্কুল ম্যাগাজিনে । তারপর থেকেই বিভিন্ন জেলার কাগজে চুটিয়ে লেখালিখি। রাস্তার বেড়াল কুকুর দের খাওয়ানো এবং যত্ন করা লেখকের নেশা ।

0 Comments

মন্তব্য করুন

Avatar placeholder

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।