কালো মেয়ে

পৌলোমী মুখার্জী on

kalo_meye

মালারা লেকের জলে মায়াবী রোদে আর হিমেল বাতাসে কাটাকুটি খেলছে। হাল্কা
হাল্কা ঢেউয়ের দোলায় ড্যাফোডিলগুলো শরীর কাঁপিয়ে হাসছে। ওপারে তৃণভূমিতে
লালচে আভাযুক্ত সাইবেরিয় ক্রেনের ঝগড়া আর হুটোপুটি নৈসর্গিক নিস্তব্ধতাকে
ভেঙে খান খান করে দিচ্ছে।

সুইডেনের অন্য শহরগুলোর থেকেও ভাস্তারাকে বেশী সুন্দরী মনে হয় এরিখের। 
চেয়ারে বসে আনমনেই একটা ফ্লেক ধরালো। একটু আগেই বুকের ওপর থেকে পরম
আশ্লেষে  ডরোথিকে সরিয়ে বারান্দায় এসেছে সে। প্রাণভরে শুষে নিচ্ছে মাতৃভূমির
সমস্ত রঙ, রূপ, গন্ধ।

          সারা রাতের অবিচ্ছেদ্য পাগলামিতে ক্লান্ত ডরোথির শেষ রাত্তিরের ঘুম
সহজে ভাঙবে বলে তো মনে হয় না। অতএব ফেডেড জিন্স আর লাল টি শার্টটা চটপট
গলিয়ে নীচে নেমে এলো এরিখ। লাল লিমুজিনের গিয়ারে হাত রেখে আলতো পায়ে
এক্সিলেটরে চাপ দিল।

           সিলভিয়াকে আজ সারাদিন বড্ড আলসেমিতে পেয়েছে। সূয্যিমামা আজকাল
বড্ড লেটলতিফ চালে চলছে। ওর মনের সাথে তাল মিলিয়ে আকাশের মুখ আজ সকাল
থেকেই গোমরা। নাগাড় বৃষ্টিতে মাটি আলগা হয়ে সদ্য লাগানো হিবিসকাসের
চারাগুলো যে শুয়ে পড়েছে। তারে মেলা জামাগুলো সব জলে ধুয়ে ফুলে ফেঁপে আছে। ভারি
তলপেট নিয়ে কাজ করার ইচ্ছেটাই চলে গেছে। আর কাজই বা করবে কার জন্য। ফোঁস
করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। ক্যালেন্ডারে তাকিয়ে কেবলই দিন আর মাস
গোনা। সাতটা মাস কেটে গেল। খ্রিস্টমাসও চলে গেল। কেবল তলপেটে একটা ছোট্ট
প্রাণ দ্রুত বেড়ে উঠছে, এই মাটির পৃথিবীর রোদ্দুর গায়ে মাখবে বলে। কালো মায়ের
ছানার  গায়ের রঙ কি সাদা হবে না কালো ? পদবীতে কি রাখবে সেন্থিল নাকি গুস্তাভ
? নাকি দুটোই ? এই সব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে গলা শুকিয়ে কাঠ। বেডসাইড টেবিলে
রাখা কাঁচের গ্লাসটা আনমনে হাত থেকে পড়ে গেল। দামি কাঁচের টুকরো স্ফটিকের
মতন সারা ঘরে আলো জ্বালিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রইলো।

         বছর পঞ্চাশের এরিখ গুস্তাভ ছুটে চলেছে সুইডেনের এ প্রান্ত থেকে ও
প্রান্ত। দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ইউরোপ এবং একই সঙ্গে ভারতবর্ষও। ভারতের কথায়
মনে পড়ল সিলভিয়ার কথা। স্টিয়ারিংয়ে ধরা হাত একটু হলেও কেঁপে গেল। আসলে

মেয়েটা একটু অন্যরকম ছিল। ডরোথিদের মত সাদা ফ্যাসফ্যাসে আর কেঠো নয়।
ইন্ডিয়ার রাতের  আকাশের মতোই ঘন কালো রঙ। সারা শরীর জুড়ে একটা আদিম 
মাদকতা। বুনো পাহাড়ি অর্কিডের   ঘ্রাণ তার সারা শরীরময়। এরিখের রক্তে একটা
নেশা ধরানো আগুন লাগিয়ে দিয়ে মিটিমিটি হাসত। আর রাত্রিকালীন খেলায় পরিপক্ক
এরিখ  সেই আগুনে জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যেত প্রতি রাতে। মধ্য রাতের সূর্যের মতোই
এরিখের শরীরের লেলিহান শিখা বুভুক্ষের মত গ্রাস করত সিলভিয়াকে । বাধ্য,
কোমল মেয়েটি তখন বন্য হয়ে উঠত।

          চোখ বুজলেই সিলভিয়া স্পষ্ট দেখতে পায় সেদিনের সব কিছু। পোলাচির লেক
জুড়ে পরিযায়ী পাখিদের আনাগোনা। গোটা রিসর্ট জুড়ে ইভেন্টের লোকেদের চরম
ব্যস্ততা। বেস্ট ডিজাইনারদের থেকে আনা দুধ সাদা গাউনের ট্রায়ালে পরিশ্রান্ত
সে। ফ্যামিলি, ফ্রেন্ডস, গ্যাদারিং এসবের মধ্যেই চার্চের ফাদারের নির্দেশে
কেয়ারিং হাজবেন্ডের মত এরিখের ওথ নেওয়া——

: I, , take you, , to be my lawfully wedded wife, to have and to hold, from this day forward,
for better, for worse, for richer, for poorer, in sickness and in health, until death do us part,,,,,,,,

তারপর, সবার চোখের সামনে দিয়ে গর্বিত
রাজহংসীর মতন কালো সিলভিয়াকে এরিখ পাঁজাকোলা করে নিয়ে বসালো সাদা সিদান
গাড়িতে। পক্ষীরাজের পিঠে চেপে উড়ে গেল ওরা হলুদ বসন্তের দেশে।

         দেখতে দেখতে বছর ঘুরে গেল আনন্দে, প্রেমে আর আশ্লেষে। পরিযায়ী
পাখিটির মতোই এরিখেরও নীড়ে ফেরার দিন এগিয়ে এলো। সে রাতে ওরা কেউই ঘুমায়
নি। অফুরান  ভালোবাসাবাসির শেষে এরিখ সিলভিয়াকে দিয়ে যায় অজস্র উপহার।
ব্যাংকের বই, এ টি এম, বাংলো তো ছিলই এছাড়াও ছিল একটি অমূল্য সম্পদ যা
আজ প্রতিপালিত হচ্ছে সিলভিয়ার কালো তলপেটে। যার জন্য আজ সে অসহায়ও
বটে।

           নিত্য নতুন প্রেম এবং যৌনতা এরিখের জীবনসঙ্গী। আসলে জীবনে
উদ্দামতা আর স্পিড দুইই পশ্চিমের সঙ্গী। সাদা মানুষের জীবনের অন্যতম রসদ।
তবুও মাঝে মাঝে ক্লান্তি আসে। সম্পর্কের ভাঙা গড়ার মাঝে মন চায় একটা
নিরাপদ কোমল আশ্রয়। যেখানে দিনের শেষে কাজ শেষে ঘরে ফিরলে তার জন্য
একটি উৎকন্ঠিত মুখ দরজার ধারে দাঁড়িয়ে প্রতীক্ষার কাল কাটাবে।
 

And when the evening light decays.
And all is calm around,
There is sweet music to the ear

In the distant sheep-bell’s sound.
 
But, oh! of all delightful sounds
Of evening or of morn,
The sweetest is the voice of Love
That welcomes his return”,,,,,,

 

 তাই এরিখের মন বার বার ছুটে চলে  যায় পুব দিকের ভারতবর্ষ নামে এক দেশে
যেখানে আছে তার ব্ল্যাক বিউটি, তার কালো বউ।

          ফেব্রুয়ারির শেষ। আবিস্কোর আকাশে আজ অলৌকিক আলোর খেলা। সবুজে,
নীলে, হলুদে, লালে মাখামাখি। এ আলোর শুরু কোথায় আর শেষই বা কোথায় তা কে
জানে। সৃষ্টির আদি মানবের সময় থেকে এই রঙের খেলা চলে আসছে। এই অসামান্য
আরোরার আলোয় এরিখ আজ স্তব্ধ। এত যে আলো, এত যে রঙ তবু একটা রঙই
এরিখের চোখ আজ খুঁজে বেড়াচ্ছে। এ রঙ তো পেতে গেলে  আবার ভারতেই যেতে হবে
তাকে। তবে এবার পাকাপাকি ভাবে।


ফেসবুক অ্যাকাউন্ট দিয়ে মন্তব্য করুন


পৌলোমী মুখার্জী

জুনিয়র ইঞ্জিনিয়ার, সেচ ও জলপথ দপ্তর (প. ব)। প্রকাশিত বই : মেঘ, বৃষ্টি, রোদ্দুর জার্নি ।

0 Comments

মন্তব্য করুন

Avatar placeholder

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।