মৃত্যু মুখর

এরিনা ঘোষ on

(১)

জন্মের চোদ্দ বছর পর মা কে দেখেছিলাম আমি। মদ্যপ লম্পট স্বামীর সঙ্গে দুবছর সংসার করার পর বেরিয়ে আসার সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছিল আমার বিদূষী সুন্দরী মা। ততদিনে আমি এসে গেছি তার জীবনে। বিষাক্ত ভালবাসার ফলস্বরূপ সেই আমাকে অস্বীকার করে বৃহত্তর জীবনের টানে বেরিয়ে পরেছিলেন তিনি। সন্তান প্রতিপালন ও সন্তানের প্রতি দায়বদ্ধতা কেবল মাত্র নারীর হতে পারে বলে মনে করিনা আমি। বিশেষত সে সন্তান যখন কারো স্বেচ্ছাচারীতার ফল। তাই তার প্রতি কোন অভিযোগ ছিল না আমার।বুদ্ধি হওয়ার সাথে সাথে নিজেকে পেয়েছিলাম বহু লোকজন ভর্তি মহিশুর এর রিং রোডের সেই বাড়িতে যেটা আমার মাতামহী উত্তরাধিকার  সুত্রে পান। অগনিত ঘর ও লোকজনের মাঝে থাকার দরুন মা বাবার অভাব সে ভাবে বুঝতেই পারিনি। চোখ মেলার পর থেকেই জ্যানেট কে পেয়েছিলাম পাশে পাশে ছায়ার মত। আমার অবাধ্য চুলে পনি টেইল করা থেকে টেবল ম্যানার্স সব ই শেখায় ঐ অ্যাংলো ইন্ডিয়ান একমাথা সাদা বব চুলের জ্যানেট। রিং রোডের ঐ ছায়া ছায়া পুরোনো আসবাব ঠাসা বাড়িতে গাদাগাদি  আত্মীয় দের মাঝেই আমার আর জ্যানেটের একটা আলাদা দুনিয়া গড়ে উঠেছিল। ভিষন রাশভারী  আমার গ্র্যান্ডি কিম্বা হুইল চেয়ারে চেপে সারা বাড়ি ঘুরে বেড়ান ন্যানির কদাচিৎ চোখ পড়ত মা বাবা হারা এই  আমার ওপর।

(২) 

এসি হামিদি। ঊনিশ বছরের উদ্ভিন্ন যৌবনা পার্সি যুবতী, তার ছোট বেলার পরিচারিকা অ্যাংলো ইন্ডিয়ান বৃদ্ধা মিস জ্যানেটের খুনের দায় স্বীকার করে আজ তিন দিন উটকামান্ড পুলিশ কাষ্টাডি তে। লেডি অফিসার দের ক্রমাগত প্রশ্নের একটাও জবাবদিহি করেনি।তার অদ্ভুত গাম্ভীর্য ,নিরুত্তাপ গভীর সামুদ্রিক চাহনি আর ভাবলেশহীনতার অসহ্য আতিশয্যে সুপার ,কমিশনার সকলেই বিব্রত। এসির মাতামহ মহীশুরের নগোরন্নায়নের এক বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব । মেয়েটির মা সায়রা আহমাদি বিশিষ্ট সমাজ সেবি। বি পিতা আজুরা আহমাদি নীলগিরি ডিস্টির্ক্ট হেডকমান্ড এর সাব ম্যাজিস্ট্রেট। এইরকম পারিবারিক পরিচয় থাকা সত্বেও পয়ষট্টি বছরের বৃদ্ধা পরিচারিকা কে তার কোয়ার্টার সংলগ্ন ষ্টোর রুম এ ধারাল কোন অস্ত্রে সম্ভবত ড্যাগার বা ঐ জাতীয় কিছু দিয়ে এগার বার কুপিয়ে মারা হয় ও আশ্চর্যজনক ভাবে তার চোখটি উপরে ফেলা হয়। এবং খুনের পাঁচ ঘন্টা পর এসি পুলিশের কাছে এসে স্বীকারোক্তি দেয়। কিন্তু মার্ডার উইপন পাওয়া যায় না। ও মেয়েটি ও সম্পূর্ন নিশ্চুপ। 

 (৩)

অ্যাসিস্টান্ট কমিশনার মিঃ ধীরাজ রাঠোর নিজেই এই কেস টার তদন্তের দায়িত্ব নেন। কেস অফ ক্লিয়ার হোমিসাইড,অথচ মার্ডার উইপন মিসিং। খুনী নিজেই স্বীকারোক্তি  দেয় কিন্তুু তার পর থেকে আর কোন সহযোগীতা করছে না।  খুনীর পারিবারিক  অবস্হান ভাল এবং সেই দিক থেকে তার  নির্দোষিতা প্রমাণের জন্য বিশিষ্ট এ্যাডভোকেড ও নিযুক্ত হয়েছে। যদি ও মেয়েটি তাকেও সহযোগীতা   করছে না। এরকম অনেক গুলো সূত্র হাতে এলেও গোলক ধাঁধা টা রয়েই যাচ্ছে। সবচাইতে সন্দেহজনক হোল গত দের বছরে উটকামান্ড ও মহীশুর এ আরও কয়েক টা আনসলভ্ড হোমিসাইডের কেস এ খুনের পর শরীরের কোন অংশ উপরে নেওয়া হয়। তদন্তে নেমে ধীরাজ প্রথমেই এসির বাড়ি যান। বর্তমানে  মেয়েটি তার বি পিতা ও মায়ের সঙ্গে উটকামান্ড এর চেরিং ক্রস রোডে মিঃ আহমাদির সরকারী  বাংলোয় থাকত। ব্যাক্তিগত কিছু জিনিসের সঙ্গে একটা ধূসর চামড়ার   ডায়েরী ও পান তিনি। বছর পাঁচেক আগে থেকে খাপছাড়া  ভাবে তাতে লিখতে শুরু করে এসি। 

    (৪)    

 বেশ উঁচু ঐ দাখ্মা তে উঠে ভীষন রকম গা গুলিয়ে উঠেছিল আমার। জ্যানেট যদিও বার বার মানা করেছিল এখানে আসতে। বড় অদ্ভুত ছেলে সাহিন। ন্যানির বড় বোনের আত্মীয়। মেডিকেল ফাইনাল দেবে অথচ ছেলেমানুষি  এখনো পিছু ছাড়েনি।রিং রোড ছাড়িয়ে শহরেরশেষ প্রান্তে বান্দিপুর ঘেঁষা এই জঙ্গুলে প্রান্তে  আমাদের দাখ্মা আছে জানতাম।  প্রভু জরাথ্রুষ্ঠের উপাসক পার্সি সম্প্রদায়ের বিশ্বাস এই নশ্বর দেহ ছেড়ে আত্মা চলে গেলেও তা নষ্ট না করে শবভূক পাখি,কীটপতঙ্গের খাদ্য হিসেবে ব্যবহার্য। আর তাই শহরের প্রান্তে তৈরি বর্তুলাকার এই স্তম্ভে আত্মীয়রা মৃতদেহকে উৎসর্গ  করে। একদম বাইরের দিকে পুরুষ দের দেহ মাঝে মহিলা ও ভিতরের সারিতে শিশুর মৃতদেহ থাকে। মাঝ দুপুরের উজ্জ্বল আলোয় বিকৃত গলিত ম্যাগট আক্রান্ত মাছি ওড়া কয়েকটা শবদেহ, তা থেকে গলা পচা রক্ত মাংস জড় হওয়া মাঝের গর্ত সব মিলে সেদিন আমায় এক বিবশ বিভীষিকায় আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল। আর তখনই সাহিন বলেছিল ওর হাসপাতালের চিকিৎসাধীন আমার বাবা দারিয়ূস হামিদির মরদেহ ও দু এক দিনের মধ্যে দাখ্মায় আনা হবে। এক লহমায় দুলে উঠেছিল আমার গোটা পৃথিবী ।

(৫)

টাওয়ার অফ সাইলেন্স , পার্সি রা বলেন দাখ্মা, বান্দিপুর ঘেঁষা এই অন্চল এমনিতেই বেশ ফাঁকা। দাখ্মার গোলাকার স্তম্ভের নীচতলায় অন্ধকার অফিস ঘর। কোমর পড়ে যাওয়া অশীতিপর বৃদ্ধ রেজিষ্টার কে মৃতদেহ দাখিলের তারিখ বলায় মোটা চশমার কাঁচের ভিতর দিয়ে অনেক কষ্টে খুঁজে পেল তার বিবরন। ডেথ সার্টিফিকেটে মৃত্যুর কারন লেখা হার্টফেল। বয়স ৪৫। আরেকটা চমক্প্রদ তথ্য ও হাতে এল মিঃ রাঠোর এর। মৃতদেহের বেশ কয়েকটি অঙ্গ মিসিং ছিল। কিন্তু কেন?সদুত্তর দিতে পারলনা বৃদ্ধ রেজিষ্টার। এবার গন্তব্য সিটি মেডিকেল কলেজ। ওখানেই মৃত্যু হয়েছিল দারিয়ূস হামিদির। এসির বাবা।সিটি মেডিকেলের রিপোর্ট অনুযায়ী দেহদান এর পর তার শরীর থেকে  দুটি কিডনী, দুটি চোখ ও লসিকা প্রতিস্হাপিত হয়েছিল। আর আশ্চর্যজনক ভাবে প্রতিস্হাপনের প্রতিটা ফর্মেই সই করেছেন সমাজ সেবি ও বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব সায়রা আহমাদি। দারিয়ূস এর প্রথমা স্ত্রীর। 

 (৬)

সেদিন আমাদের স্কুল এক্সকারসান ছিল সেন্ট ফিলোমিনায়।   সপ্তদশ শতাব্দীর এই ঐতিহাসিক চার্চটি বিখ্যাত তার গথিক স্থাপর্য র জন্য। অনেক ছবির শ্যুটিং ও হয়েছে এখানে। মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম অদ্ভুত করূকাজ করা আর্চগুলো।  এমন সময় চোখ পরল লোকটার উপর। কেমন মনখারাপ করা দৃষ্টিতে দেখছিল আমায়। তার পর থেকে প্রায়ই দেখি তাকে। লোকটা ছায়ার মত অনুসরন করছে আমায়। জ্যানেট কে লোকটার কথা বলতেই আঁতকে উঠল। অনেক অনুরোধের পর জানাল লোকটাই আমার পিতা। দারিয়ূস হামিদি। মার্চেন্ট নেভির ক্যাপটেন  পঁচিশ বছরের যুবক টির বৈশিষ্ট ছিল পিয়ানোয় ঝড় তোলা। আর তাতেই ভুলেছিল আমার তরুনী মা। ভুল ভাঙে বিয়ের কিছুদিনের মধ্যেই। কিন্থু কই একবার ও তো তাকে দেখে মনে হোলনা প্রবন্চক জীবন কে নেহাৎ ই হাতের তালুতে নিয়ে ফুঁ দেওয়া কোন মানুষ। বরং অদ্ভুত এক টান অনুভব করলাম আমি। একেই কি বলে রক্তের টান?

(৭)

সিটি মেডিকেল কলেজের রেজিষ্টার এ থাকা নাম ও বিবরনী অনুযায়ী  দারিয়ূসের অঙ্গ ও লসিকা গ্রহীতা দের পরিচয় জেনে ভিষন ভাবে চমকে উঠল একনিষ্ঠ পুলিশ অফিসার ধীরাজ রাঠোর। দারিয়ূসের কিডনী দুটি প্রতিস্হাপিত হয় মহীশুর আর পি এফ কলোনীর ৬২ বছরের মিঃ বাসুদেব রাও ও কলেজ রো র রিটায়ার্ড লাইব্রেরীয়ান রাজলক্ষী আইয়ার এর দেহে। লসিকা প্রতিস্হাপন হয় ন্যাশানাল হাই এর সেকেন্ডারির ছাত্র এস বালাজীর দেহে। ও চোখ ধুটি পায় উটকামান্ড এর ৬ বছরের পদ্মজা রাউত ও মহীশূর এর রিং রোডের ৬৫বছর বয়সি মিস জ্যানেট। যার খুনের দায় স্বীকার করে অভিযুক্ত এসি হামিদি এখন পুলিশী   হেফাজতে।  

   (৮)

নীল নীল আলোর একটা বল ঘুরে চলেছে লাউড মিউসিকের তালে তালে। জোড়ায় জোড়ায় ছেলে মেয়েরা উদ্দাম নাচছে। সঙ্গে চলেছে দেদার পানীয়ের ফোয়ারা। আমার কোমর জড়িয়ে সাহিন নাচছে। রক্ত লাল ছোট পোষাক টায় বেশ উত্তেজক দেখায় আমাকে। গাঢ় মাশকারা ,কাঁধ ছোঁয়া মসৃন চুলে তুমুল আহ্বান। মহীশুর এর এই ডিস্কোয় সাহিন ই আমায় এনেছিল দিন দশ আগে। দারিয়ূস হামিদি চালান এই ডিস্কবার। এখনো পিয়ানোয় ঝড় তুলে কাঁপিয়ে দেন ফ্লোর। কেমন নেশা ধরান সেই সুর আমাকেও আচ্ছন্ন করে দিল। থেমে গেছে পিয়ানো। ধীরপায়ে এগিয়ে আসছে আমার দিকেই মিঃ হামিদি, আমার ব্লাড ফাদার। জরানো গলায় বলে উঠলাম সায়রা আহমিদির বর্তমান স্বামী আমায় লিগ্যালি অ্যাডপ্ট করছেন আমার আগামী জন্মদিন এ। মুহূর্তে আমার বাবার মুখ ফ্যাকাশে। কাতরতা ফুটে উঠছে চোখে মুখে। জানতে চাইলেন আমি  খুশী কিনা?কি বলব আমি?আমার খুশীর খবর কেউ জানতেই চায়নি কোনদিন। নিজের খারাপলাগা ভাল লাগা নিয়ে খেলতে খেলতে কবেই ভুলে গেছি আসল খুশীর ঠিকানা।

(৯)

আর পি এফ কলোনী থেকে রেলস্টেশন ১০ মিনিটের পথ। সেদিন রাত ৯টার ট্রেন ধরে বেঙ্গালুরু তে ভাইপোর কাছে যাওয়ার কথা ছিল বাসুদেব রাও র। পারিবারিক  জমিজমার কয়েকটা কাগজপত্রে সই করার ছিল। জনবহুল মহীশুর রেলস্টেশনের গুমটি ঘরের পাশেই তার মৃতদেহ টি দেখতে পায় এক কুলি। রাত ১১টা নাগাদ। রক্তে ভেসে যাওয়া পেট থেকে কিডনি উপড়ে নেওয়া। বিপত্নীক   মিঃ রাও এর ভাইপো কেই সন্দেহ করে পুলিশ। কিন্তু খুনের রাতে বেঙ্গালুরু তে থাকার জোরাল অ্যালিবাই থাকায় গ্রেপ্তার হয় না সে। 

দিন দশ পরের পরের এক সপ্তাহান্তে ন্যাশানাল হাই এর বাস্কেট বল টিমের ক্যাপ্টেন এস বালাজি স্কুলের পর সাঁতার কাটতে যায় বাড়ির কাছেই এক পুলে। মাস তিনেক আগেই লসিকা প্রতিস্হাপন হয়েছিল তার। পুলের ঠিক মাঝামাঝি  সাঁতরেই ডুবে যায় সে। খুব অদ্ভুত ভাবেই মৃতদেহ পাওয়া যায় না পুলে। দিন তিনেক বাদে রক্তশূন্য দেহটি মেলে বান্দিপুর এর জঙ্গলে। ছোটবড় শ্বাপদ সংঙ্কুল জঙ্গলে একেবারে অক্ষত মৃতদেহ। 

সেন্ট্রাল পার্ক বাড়ির কাছেই। প্রতিদিন ভোরে আধঘন্টা হাঁটতেন রাজলক্ষ্মী আইয়ার। সেদিন দু ঘন্টা পর ও ফিরছেন না দেখে কাজের মেয়েটি পার্কে আসে। লোকজনের জটলার মাঝে আবিষ্কার করে মালকিনের পেট কাটা মৃতদেহ। 

ছটফটে বছর ছয়ের মেয়েটা লেক পাইকারায় পিকনিক করতে গেছিল। হঠাৎই হারিয়ে যায় সে। আজ ও মিসিং কেসের ফাইল এর পাতায় হাসিমুখে তাকিয়ে আছে সে। 

সাতচল্লিশ বছরের দুঁদে পুলিশ অফিসার ধীরাজ রাঠোর  বহু কঠিন সমস্যা সমাধান করা মস্তিস্কের ধুসর পদার্থে টান অনুভব করলেন। এ সব মৃত্যুর জন্য কি ঐ মেয়েটাই দায়ী?সব কটা কেসের সুরতহাল রিপোর্ট চেয়ে পাঠালেন তিনি। 

  (১০)

“ইলেকট্রা কমপ্লেক্স ” এ রাতদিন কেমন নেশা ধরান হয়ে গেছে আজকাল। ভিষন ভাবে কাছে পেতে ইচ্ছে করে তাকে। আজুরা আহমিদি। মেঘ জমনো আওয়াজে তিনি যখন ডাকেন মা কে কি আমায় কিছু একটা কাঁপিয়ে দেয় অস্তিত্ব কে। আর ঠিক তখন ই বিজাতীয় অনুভুতি হয় সায়রা আহমাদির উপর।  কি দারুন চাতুর্যে আমার পিতা কে ছেড়ে অসহয়তার নিপুন জালে আটকেছেন আজুরা কে। আজকাল যাকে কাছে পেতে ঘন্টার পর ঘন্টা আমিও কাটাই তার সঙ্গে উটকামান্ড এর বাগানের পরিচর্যায়। গাছপালা  ও বাগান চর্চা নয় আজুরার কাছে থাকার মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন হয়ে। যেদিন দারিয়ূস জানাল সায়রা আহমিদির অজানা কথাগুলো সেদিনের পর থেকেই আরও চাইছি আজুরার কাছাকাছি যেতে। সর্বোতভাবেই দারিয়ূস কে মানষিক ভাবে বিপর্যস্হ করতেই আমাকেও সরিয়ে এনেছিল আমার মা। বিদূষী সুন্দরী সায়রা আহমিদি। ‘ মা’ শব্দটাও যার জন্য বিষাক্ত লাগে। 

 (১১)

শ্বাসক্রিয়া রূদ্ধ হয়ে মৃত্যু। তিনটে মৃত্যূর কারন ই মিলে গেল হুবহু। মিসিং বাচ্চাটির কথা বাদ দিলেও মিস জ্যানেটের মৃত্যুটা সব হিসেব এলোমেলো করে দিচ্ছে এসি কে বাকী খুনগুলোর জন্য দায়ী ভাবতে। মিঃ আজুরা আহমিদি এসেছেন। মিঃ রাঠোর ই ডেকেছেন তাকে তদন্তের কিছু সুত্র মেলানোর জন্য। হাইওয়ের ধারে থাকায় দারিয়ূসের বার কাম ডিস্কের বন্ধের নোটিশ দিয়েছিল সরকার।আর সেটি বাস্তবায়িত করার দায়িত্ব পরেছিল সায়রার এন জি ওর ওপর।  তাও মৃত্যু পরবর্তী দেহদানের ফর্মে সায়রা কেই ও সম্মতির দায়ভার দিয়ে গেছিল। অদ্ভুত চরিত্র তো দারিয়ূস হামিদির।  

     (১২)

কনিয়াম মাকুলাটাম বা বিষাক্ত হেমলক ,সাদা থোকা থোকা ফুলে ভর্তি ঝোপাল গাছ টার ফুল তুলতে যাচ্ছিলাম আচমকা টেনে সরিয়ে নিল আজুরা। আনমনা কখন যেন বাগানে চলে এসেছিলাম। ডিস্ক টা বন্ধ হওয়ার পর থেকেই অসুস্হ হয়ে পরেছিল দারিয়ূস হামিদি। গতকাল ই সিটি হসপিটাল এ ভর্তি হন তিনি। আমায় ডেকেছেন শুনেই সাহিনের সঙ্গে গিয়েছিলাম। আমায় বুকে জড়িয়ে ক্ষমা চাইলেন দু চোখ ভর্তিজল নিয়ে। টাওয়ার অফ সাইলেন্সে তার অক্ষত দেহ স্হাপনের শেষ ইচ্ছা জানালেন আমায়। কথা দিলাম। কখনো কখনো ছোটদের ও ক্ষমার উঁচু চৌকাঠ পার করতে হয়। বড় বিষাক্ত এই গাছের পাতা,ফুল। কয়েকটি তরল কোন পানীয়ের সাথে শরীরে ঢুকলেই নির্ঘাৎ মৃত্যু। কেন যে আজুরা জানাল এই কথা ?

     (১৩)

আবছায়া অন্ধকার কোন থেকে এগিয়ে এসেছিল মেয়েটা। চোখে দেখতে পায়না। হাতে ব্লাইন্ডস্টিক। মায়া হোল বৃদ্ধ বাসুদেব রাওর। উটকামান্ড এর বিখ্যাত হোম মেড চকোলেট নিয়ে বিক্রি করছে। টেষ্ট স্যাম্পেল ও দিল একটু। তারপর আর কিছুই বোঝেনি সে। ভিষন রকম বুক ধরফর আর চোখে ঝাপসা দেখছিল । সেই প্রথম এত রক্ত একসাথে দেখেছিল এসি। বিষাক্ত কনিয়াম মাকুলাটাম এর প্রতিক্রিয়ায় ততক্ষনে স্নায়ুপেশীর সংযোগস্হল এ রক্ত জমাট বেঁধে শ্বাসরূদ্ধ করে তুলেছে লোকটাকে। একই ভাবে বাকি দুজন কেও শেষ করেছিল। পায়ে দড়ি বেঁধে বালাজীর দেহ টেনে নিয়ে গেছিল জঙ্গলে। সাহিনের থেকে না বলে নেওয়া সিরিন্জের টানে বের করেছিল রক্ত মিশ্রিত লসিকা। হেমলকের বিষে মরা দেহে দাঁত ফোটাতে বনের জন্তুরাও ভয় পেয়েছিল। 

একটু অসুবিধা হয়েছিল বাচ্চাটাকে নিয়েই। চোখ উপরানোর পর দেহটাকে দিনের আলোয় লুকান সম্ভব হচ্ছিল না। লেক পাইকারার জলেই ভাসিয়ে দেয় শেষে। কিন্তু সব হিসেব গুলিয়ে গেল জ্যানেটের রেটিনা প্রতিস্হাপনের পর। সায়রা আহমিদির ইচ্ছেকে একদম সফল হতে দেবে না ও। দারিয়ূসের শেষ ইচ্ছেকে সম্মান জানাতে হারাতেই হবে ঐ মহিলাকে। বাবার সব অঙ্গ কে পৌঁছে দিতেই হবে দোখমায়। উপড়ে নেওয়া চোখের সাথে ছোরাটাও ফেলে দিল দোখমার মাঝের গর্তে। পচা গলা রক্ত মাংস আর লার্ভা ম্যাগট এ এতদিনে ঢেকে ফেলেছে ওটা। 

  (১৪)

বড় চতুর চাল চেলেছিল স্বার্থপর হিংস্র দারিয়ূস। সায়রা র উপর নেওয়া চরম প্রতিশোধ। বাঁচবে না জেনেই সায়রা কে অঙ্গদানপত্রের সাক্ষী করে দেয়।  আর মায়ের মতই বোকা মেয়েটাকে সফলভাবে ভুল বোঝায়।  খুনের দায়ে মেয়ের জেল হলে সায়রার সামাজিক অবস্হান যে হেয় হবে তা অনুমান করেই শান্তির শেষ নিশ্বাস   ফেললেছিল দারিয়ূস। আর তাতে ঘি ঢেলেছিল আজুরার কঠিন প্রত্যাক্ষান। নেহাৎ  ই বোকা মেয়েটা স্নেহ আর প্রেমের পার্থক্য বুঝতে পারেনি। 

  (১৫)

এখানে ঘুম আসেনা এসির। ঘটনার আচম্ভিকতায় হতভম্ব ও। মার্ডার উইপন খুঁজে পায়নি পুলিশ। ন্যানির অ্যাডভোকেট হয়ত ওকে মানষিক রোগী প্রতিপন্ন করবে। তাতে ফাঁসিটা আটকালেও জেলেই কাটবে আজীবন। একটা দিন ফুরিয়ে যাচ্ছে। ঘূলঘূলি দিয়ে বিদায়ী সূর্যের আলো এসে পরেছে ওর পায়ে। যে পায়ে টলমল করে হাঁটবে ভবিষৎএর কত শিশু। শক্ত মুঠোয় জন্মদাতার হাত ধরে।তারা নিশ্চই দারিয়ূসের মত হবে না~


ফেসবুক অ্যাকাউন্ট দিয়ে মন্তব্য করুন

Categories: গল্প

এরিনা ঘোষ

পেশা — সিভিল ইন্জিনিয়ার, নেশা — বই ও কবিতা, অবসর বিনোদন — লেখা ও পশুপাখির সঙ্গে সময় কাটান।

0 Comments

মন্তব্য করুন

Avatar placeholder

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।