বুকের ভিতর অচিন পাখি

সিদ্ধার্থ সিংহ on

অমৃত দাঁড়িয়ে পড়ল। সন্ধের শিয়ালদহ স্টেশন তখন জনসমুদ্র। চার দিক থেকে লোকের ঢল এসে নেমেছে। ছুটছে ট্রেন ধরতে। অমৃতও যাচ্ছিল। দক্ষিণ শাখার দিকে। ও কাজ করে একটা কাপড় ছাপার কারখানায়। তাদের কারখানা সরকারি বেসরকারি নামী-দামি নানা সংস্থার অর্ডার সাপ্লাই করে। তবে তাদের নিজস্ব কিছু ডিজাইনও আছে। সেটাই ধরে রেখেছে ওই কারখানার সহযোগী সংস্থা ‘রূপসী’ শো-রুমের আভিজাত্য।

অমৃত সেখানকার রং-মাস্টার। শেড মিলিয়ে মিলিয়ে রং বানায়। মাইনে পায় সাত হাজার দুশো টাকা। এ ছাড়া ডিউটি আওয়ার্সের মধ্যেই যখন তার কোনও কাজ থাকে না, তখন ধরে ধরে কাপড় ছাপে। তাতেও সাত-আটশো টাকা হয়ে যায়। কিন্তু ওর চালচলন দেখলে কেউ বিশ্বাসই করবে না যে, ও এতগুলো টাকা রোজগার করে। চলাফেরা থেকে খাওয়াদাওয়া, সব মিলিয়ে অমৃতের খরচ মাসে বড় জোর হাজার পাঁচেক টাকা। আসলে ও প্রতি মাসে কিছু না-হলেও অন্তত হাজার তিনেক করে জমায়। জমিয়ে জমিয়ে তা দিয়ে কেনে এক-একটা সাবেকি জিনিস। এর কোনওটা বাঁকুড়ার বড় ঘোড়া, কোনওটা চোঙওয়ালা গ্রামাফোন, আবার কোনওটা কুচকুটে কালো রঙের মাঝারি আলমারি অথবা ড্রেসিং টেবিল কিংবা নকশা-করা বড় ফুলদানি, নয়তো এক মানুষ সমান লম্বা ল্যাম্পস্ট্যান্ড।

অমৃত হেলতে দুলতে যেতে যেতে দেখল, একটা ঠেলাগাড়ির ওপরে কানা-উঁচু থালার আদলে বড় বড় তিন-তিনটে ঝুড়ি। পর পর রাখা। গোটা ঠেলাগাড়ি জুড়ে। কয়েক জন সেটা থেকে কী যেন বাছাবাছি করছে।

অমৃত সে দিকে গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গেল। পায়ের প্লাস্টিকের চটিটা কোলাপুরির মতো দেখতে। হাঁটতে হাঁটতে গোড়ালির ভারে থেঁতলে ধারগুলো ফেটে ফেটে গেছে। প্যান্টের রং ধূসর। কোনও দিন ইস্ত্রি করা হয়েছে বলে মনে হয় না। আকাশি রঙের জামাটায় ঘাড় থেকে নীচ অবধি টানা একটা রঙের দাগ। হয়তো জামাকাপড় মেলার তারে শুকোতে দিয়ে হয়েছে। পাঁচটা বোতামের তিনটেরই তিন রকম রং। আদলেও তিন রকমের। তাও আবার যখন যে সুতো হাতের কাছে পেয়েছে, সেই সুতো দিয়েই সেলাই করা। গালে খোঁচা খোঁচা দাঁডি, ছিপছিপে গরন। লম্বা। হাঁটলে হাত দুটো বেশি দোলে।

কাছে গিয়ে অমৃত দেখল সোনালি বর্ডার-টর্ডার দেওয়া ঝাউপাতা, ফুল-টুল আঁকা চিনে মাটির কাপ ডিশ। কারুকার্য করা ফুলদালি, দুধ সাদা টি-পট, নানা নকশার অ্যাশট্রে। বেশ পাতলা। যেন বেঙ্গল পটারির তৈরি। তবে নিখুঁত নয়। কোনওটার গায়ে চুলের মতো সরু কালো রঙের ফাটল। কোনওটা আবার একটু-আধটু চলটা ওঠা। এ জন্যই দামটা এত কম।

অমৃত ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখতে লাগল। ওর মধ্যেই যেগুলো সব চেয়ে ভাল, বেছে বেছে সেগুলোকে একটা জায়গায় জড়ো করতে লাগল। একটা টি-পট বেশ পছন্দ, কিন্তু ঢাকনাটা একেবারে যাচ্ছেতাই। দোকানদার একটু অন্যমনস্ক হতেই চোখের পলকে অমৃত ঝট করে সেই টি-পটের ঢাকনাটা অন্য একটা টি-পটের ওপর লাগিয়ে, ওই টি-পটের ঢাকনাটা এটার উপর বসিয়ে ওর বেছে রাখা জিনিসগুলোর মধ্যে রাখল।

দোকানদার ডিশ ক’টা কাগজে মুড়ে, কাপগুলো দড়িতে মালার মতো গেঁথে তুলে দিল ওর হাতে। ও কাঁধের ঝোলায় ডিশগুলো আর পটটা রেখে কাপগুলো ঝুলিয়ে নিল হাতে, তার পরে পা রাখল শিয়ালদহ দক্ষিণ শাখার চত্বরে।

ও বারুইপুর যাবে। শিয়ালদহ থেকে এগারো-বারোটা স্টেশন। শুধু একজনেরই যেতে আসতে লাগে পাঁচ-পাঁচ দশ টাকা। অমৃত যখন বারুইপুরে ঘর নেয়, তখন ট্রেনের মান্থলি টিকিট ছিল বিয়াল্লিশ টাকা। তার পর ধাপে ধাপে এ ক’বছরে সেটা বেড়ে যে কতয় গিয়ে দাঁড়িয়েছে, দুম করে জিজ্ঞেস করলে ও ঠিক মতো বলতে পারবে না। তবে যাতায়াতের পথে কাউকে কাউকে আক্ষেপের সঙ্গে বলতে শোনে, এ বার যা বেড়েছে আর মান্থলি করা যাবে না। বিনা টিকিটেই যেতে হবে।

মান্থলির দাম যত দিন ছেচল্লিশ ছিল ও অবশ্য তত দিন করেছে। দামটা বাহান্ন হতেই মান্থলি করা ছেড়েছে। এখন তো একশো কত টাকা যেন! প্রথম প্রথম মৌলালি পর্যন্ত হেঁটে দুশো আঠারো নম্বর বাস ধরত। তাতে পয়সা একটু সাশ্রয় হত ঠিকই, তবে সময় লাগত ডবলেরও বেশি। তাই বাসে করে পার্কসার্কাসে গিয়ে ট্রেন ধরত। আসতও সেই ভাবে। ওই স্টেশনটা বেশ নিরাপদ। কোনও চেকার-টেকারের বালাই নেই। কিন্তু সব ট্রেনই তো আর ওই স্টেশন ধরে না। তাই…

চেকিং গেটের ও পারের দিকে এক ঝলক তাকিয়েই ও বুঝতে পারল, আজ আর গলে যাওয়া যাবে না। এ সময় প্ল্যাটফর্ম থেকে বেরোনো যাত্রীদের চেয়ে ট্রেন ধরতে ঢোকা যাত্রীদের টিকিট বেশি চেক করা হয়। তাই টিকিট কাউন্টারের লাইনে দাঁড়িয়ে পড়ল অমৃত। পাঁচ টাকার একটা কয়েন গলিয়ে দিয়ে বলল, বারুইপুর।

আগে টিকিটের দাম ছিল ছ’টাকা। কিন্তু সারা দেশে যখন এক টাকা, দু’টাকা খুচরোর আকাল শুরু হল, তখন তার হাত থেকে নিস্তার পাওয়ার জন্য রেল কর্তৃপক্ষ তিন থেকে সাত টাকা দামের টিকিটগুলোকে পাঁচ টাকা করে দিয়েছিল। আট থেকে বারো টাকা দামের টিকিটগুলোকে দশ টাকা। পাঁচ, দশ, পনেরো— এই ভাবে পাঁচ টাকার গুণিতকে সর্বত্র টিকিটের দাম ধার্য করেছিল। বাজারের সব কিছুর দাম যখন আকাশ-মুখী, সে সময় অমৃত দেখেছিল,ছ’টাকার টিকিট কী ভাবে পাঁচ টাকা হয়ে গেল।

তখন শিয়ালদা থেকে বাঘাযতীন পর্যন্ত লাগত দু’টাকা। বেশির ভাগ লোকই তখন দু’টাকা দিয়ে বাঘাযতীন অবধি টিকিট কেটে পাড়ি দিত ডায়মন্ড হারবার, ক্যানিং কিংবা বজবজে। কারণ বালিগঞ্জের পরে রাতের দিকে আর কোনও স্টেশনে চেকার থাকে না। যা একটু-আধটু থাকে, সেটা ওই সোনারপুরে।

তাই বেশির ভাগ লোকেরাই শিয়ালদা থেকে সব চেয়ে কম দামের, ওই দু’টাকার টিকিটই কাটত। সেটা টিকিট কাউন্টারে বসা ওই লোকগুলোও জানত। তাই যে দিন বাধ্য হয়ে টিকিট কাটতে হত, সে দিন অন্যদের মতো অমৃত সাধারণত বাঘাযতীন বলত না, বলত ঢাকুরিয়া বা যাদবপুর।

টিকিটটা হাতে নিয়ে ও কোলাপসিবল গেট পেরোল। মনে মনে চাইল, অন্তত একজন চেকার তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিক। একবার ট্রেনে উঠে গেলে এই টিকিটটার তো আর কোনও দামই নেই। ধীরে ধীরে ও এগোতে লাগল। কিন্তু ওর দিকে কোনও চেকার ফিরেও তাকাল না। কী করে যে ওরা বোঝে কে টিকিট কেটেছে আর কে কাটেনি! জানতে পারলে, সেই রকম অভিনয় করে বেরিয়ে যাওয়া যেত। টিকিট কাটতেই হত না।

প্ল্যাটফর্মে ঢোকার আগের চাতালে তখন রমরম করে সিনেমা হচ্ছে। ওপরে বসানো ক্লোজ সার্কিট টিভি-তে। কিছু লোক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে। স্টেশনের নানা বয়সের কিছু ভিখারি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে শুয়ে বসে রয়েছে। তাদেরও কারও কারও চোখ টিভির দিতে। অমৃতও দাঁড়িয়ে পড়ল টিভি দেখতে। একটা বাংলা ছবি হচ্ছে। উত্তম-সুচিত্রার। একটু দেখার পরেই ওর মনে হল, ছবিটা ওর দেখা। আগে কখনও কোথাও দেখেছে। কী যেন নাম সিনেমাটার! কী নাম যেন!

নাম মনে না পড়লেও ছবিটার গল্প ওর মনে পড়ে গেল। ছোট থেকেই নায়ক-নায়িকার প্রেম। হঠাৎ ওদের মধ্যে আর এক পুরুষ এসে হাজির। সেই পুরুষটি যেমন সুন্দর দেখতে, তেমনই পয়সাওয়ালা। মেয়েটি ভালবেসে ফেলল তাকে। বিয়েও হয়ে গেল। কিন্তু এক মাস কাটতে না-কাটতেই মেয়েটি বুঝতে পারল, সে ভুল করে ফেলেছে। তার স্বামী আসলে মাতাল, লম্পট, অত্যাচারী। রাতের পর রাত বাড়ি ফেরে না। বড় একা হয়ে পড়ে মেয়েটি। সে সময় আচমকা একদিন পথে দেখা হয়ে যায় তার পুরোনো প্রেমিকের সঙ্গে। এড়িয়ে যেতে গিয়েও সে পারে না। কথা বলে জানতে পারে, ও তার এই অবস্থার কথা সব জানে। এবং সেই আগের মতোই একই রকম ভাবে তাকে এখনও ভালবাসে। প্রেমিকটি আরও বলে, আমার দরজা তোমার জন্য চিরকাল খোলা থাকবে। যে দিন তোমার মনে হবে, চলো এসো। মেয়েটি সত্যিই একদিন সেই প্রেমিকের কাছে ফিরে এল। কিন্তু সেখানকার সংসারও তার সুখের হল না। প্রেমিকের বাড়ির লোকেরা তাকে মেনে নিল না। এর ফলে মেয়েটি শেষে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়ল। আর সেই দৃশ্য দেখে প্রেমিকটা উন্মাদের মতো বেরিয়ে পড়ল পথে।

প্রেমিকা আসা মাত্র ছেলেটি যদি তাকে নিয়ে অন্য কোথাও সরে যেত, তা হলে নিশ্চয়ই গল্পটার পরিণতি এ রকম হত না। অমৃত ভাবল, তার প্রেমিকাও তো বলেছে, সে ফিরে আসবে। সে এলে, তার বাড়ির লোকেরাও যদি এই সিনেমাটির মতোই তাকে মেনে না নেয়, যদি এই সিনেমাটির মতো তারও ওই একই দশা হয়… তখন? আগে অত কিছু ভাবতে পারেনি অমৃত। ঘরবাড়ি-বন্ধুবান্ধব সব ছেড়ে-ছুড়ে চলে এসেছিল। মনে হয়, এই তো সে দিনের কথা।

তখন ক্যানিংয়ে থাকত অমৃত। পাক্কা সাড়ে আট বছর মেলামেশার পর তার প্রেমিকা লক্ষ্মী হঠাৎ ওখানকার বর্ধিষ্ণু পরিবার, চৌধুরীদের বাড়ি নিয়ে মাতামাতি শুরু করল খুব। মেঠো পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে বা কখনও পুকুরের বাঁধানো ঘাটে বসে লক্ষ্মী বলত, জানো তো, ও বাড়ির মাসিমা বাঘের ছালে বসে পুজো করেন। ওদের বসার ঘরে না… কী বিশাল একটা পিয়ানো। দেয়ালে ঝোলানো ইয়া বড় বড় দু’খানা তলোয়ার। কতগুলো হরিণের মাথা। শুনলাম, ওদের কলকাতার বাড়িটা নাকি সারানো হচ্ছে। ছোট ছেলেটা, ওই যে গো কার্তিকদা, ও তো গত সপ্তাহে এসেছে। ক’টা দিন বোধহয় এখানেই থাকবে। কী দারুণ দারুণ গল্প বলে, ভাবতে পারবে না। কেউ বলবেই না যে, ও ওই বাড়ির ছেলে। কোনও অহংকার নেই। কী মিশুকে জানো…

সে সময় জানতে পারেনি অমৃত। যখন জেনেছিল, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। ক্যানিং ছেড়ে পালিয়েছে ওরা দু’জন। কিছু দিন পর অবশ্য চৌধুরীদের সেই ছেলেটাকে দেখা গিয়েছিল। মাত্র ক’টা দিন। তার পরেই যে কোথায় গেল! তবে লোকে বলে, ও নাকি এখন কলকাতার বাড়িতে থাকে। নতুন বিয়ে করেছে। সে বউ দেখতে কেমন, কোথাকার মেয়ে, সবই কানাঘুষোয় জানতে পারে অমৃত। শুধু জানতে পারে না তার প্রেমিকার কথা। লক্ষ্মীর কথা। না জানলেও ও বিশ্বাস করে, লক্ষ্মী যখন কথা দিয়েছে, যে কোনও দিন, যে কোনও সময় ও ঠিক আসবে।

লক্ষ্মী কথা দিয়েছিল। ত্রিমাতৃ মন্দিরের লাগোয়া পুকুরের বাঁধানো ঘাটে বসেছিল ওরা। ভরসন্ধ্যাবেলায়। পাশাপাশি একেবারে গায়ে গা লাগিয়ে। সে দিন মাঝে মাঝেই লক্ষ্মী বলছিল, ‘এই, এ বার তা হলে উঠি।’ আর প্রতিবারই অমৃত ওকে আটকাচ্ছিল, ‘আর দশ মিনিট’, ‘আর পাঁচ মিনিট’, ‘আর একটু, এই বলে। এক সময় লক্ষ্মী উঠে দাঁড়াল— আর নয়, হাট থেকে বাবার ফেরার সময় হয়ে গেছে। বাড়িতে এসে যদি দেখে… কথা শেষ হবার আগেই ওর হাত টেনে বসিয়ে দিয়েছিল অমৃত। আর একটু থাকো না… দিন দিন তুমি যেন কেমন দূরে সরে যাচ্ছ। অনেক দূরে…

কথাটা শুনে অমৃতের মুখের দিকে খানিকক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে ছিল লক্ষ্মী। তার পর পুকুরের জলে পা দোলাতে দোলাতে বলেছিল, দূরে সরে যাচ্ছি? তোমাকে ছেড়ে আমি কোথায় যাব? আমি তো তোমারই।
— সত্যি?
— সত্যি, সত্যি, সত্যি, এই তিন সত্যি করলাম।
সে দিনের ঘটনাটা অমৃতের বারবার মনে পড়ে। তাই ও বিশ্বাস করে, লক্ষ্মী আছে। যে কোনও সময় ও চলে আসবে। তাই ও যেগুলোর কথা বলত, যেগুলো ওকে মুগ্ধ করেছিল, সে সব জিনিস একে একে খুঁজে নিয়ে আসে সে।

আজ যেমন বেছে বেছে কাপ ডিশ নিয়ে যাচ্ছে। নতুন কেনার সামর্থ্য নেই তার, তাই অফিস ফেরতা পথে ঢু মারে পুরোনো বাজারগুলোতে। কখনও যায় শিয়ালদার বৈঠকখানা বাজারে, আবার কখনও যায় রফি আহমেদ কিদোয়াই রোড আর মার্কুইস স্ট্রিটের ক্রসিংয়ে। ছুটিছাটার দিনে চলে যায় ভবানীপুরের ঘোড়ার আড্ডায়। যায় গোপালনগরের চোরা-বাজারে। বেছে বেছে তুলে আনে কাঁটাচামচ, শীতে পরার দস্তানা, বেতের টুপি, ঝকঝকে তকতকে বই, সে যে কোনও বিষয়েরই হোক না কেন, পড়ার জন্য তো নয়, তাক সাজানোর জন্য।

একটা হুইসল বেজে উঠতেই অমৃত তাকাল প্ল্যাটফর্মের দিকে। দশ নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে একটা ট্রেন তখন ছেড়ে যাচ্ছে। কিছু লোক ট্রেনের পিছু পিছু ছুটছে। লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে। ও-ও ছুটতে যাচ্ছিল, কিন্তু হাতের ঝোলানো কাপগুলো একটার সঙ্গে আর একটার ধাক্কা লেগে টুং-টাং শব্দ হতেই ও থেমে গেল। টিভি-তে তখন জমাটি সিন। দেখতে গেলে ফের এই একই অবস্থা হবে। তাও ও আর না-দাঁড়িয়ে বারো নম্বর প্ল্যাটফর্মে গিয়ে ঢুকল। ট্রেনটায় লোক উঠছে। প্রথম কামরার প্রথম জানালায় উঁকি মেরে ও জিজ্ঞেস করল, কোন ট্রেন?

লোকটা কোনও উত্তর দিল না। দ্বিতীয় বার ওই একই প্রশ্নে নিরুত্তর দেখে তৃতীয় বার অমায়িক ভঙ্গিতে অমৃত জিজ্ঞেস করল, দাদা, এটা কোন ট্রেন?

— জানি না। শব্দ দুটো বলেই লোকটা নির্বিকার ভাবে তাকিয়ে রইল অন্য দিকে। অমৃত এগোতে লাগল। লোকটাকে নিশ্চয়ই আরও কয়েক জন এই একই প্রশ্ন করেছে। বারবার একই উত্তর দিতে দিতে লোকটা বিরক্ত হয়ে গিয়েছিলেন। তাই হয়তো ওর প্রশ্নটা শুনেও শুনছিলেন না।

এমনটা অমৃতেরও হয়। জানালার ধারে বসার এই হল একটা ঝামেলা। হাজার লোকের হাজার রকম প্রশ্নের উত্তর দাও। কী ট্রেন, কখন ছাড়বে, অমুক স্টেশন ধরবে কি না, তমুক স্টেশন যেতে কতক্ষণ লাগবে, এর আগে কোন ট্রেন আছে— এত প্রশ্ন, শেষে আর ধৈর্য থাকে না। হয়তো তেমনই কিছু একটা ঘটেছে লোকটার সঙ্গে। কিন্তু… তবে যে বলল, জানি না। তার মানে এমনও হতে পারে, উনি বালিগঞ্জে নামবেন। তাই কোন ট্রেন না জানলেও চলে। যে কোনও একটায় চেপে বসলেই হল। কিন্তু তা হলে তো গেটের কাছাকাছি থাকা উচিত। মাত্র সাত-আট মিনিটের তো পথ। অমৃত আরেকটা জানালায় উঁকি মারল। সেই একই ভাবে জিজ্ঞেস করল, দাদা, এটা কোন ট্রেন?

— লক্ষ্মী ছাড়া।

কথাটা শুনেই অমৃত পা বাড়াল সামনের দিকে। উঁকি মারতে লাগল একটার পর একটা জানালায়। ‘লক্ষ্মী ছাড়া’ মানে লক্ষ্মীকান্তপুর। বারুইপুর হয়ে যাবে। কামরাগুলো ফাঁকা ফাঁকা। সিটও রয়েছে প্রচুর। তবে জানালার ধারগুলো সব ভরা। যে ক’টা খালি, সে ক’টাই উল্টোমুখো। কয়েকটা কামরার পর ও দেখল, ও দিককার একটা জানালার ধার ফাঁকা। ও সোজা উঠে গিয়ে ওই রো-টা আর জানালাটা ভাল করে দেখল। এ রকম মনের মতো সিট পেলে কেন জানি ওর মনে হয়, জায়গাটা নিশ্চয়ই নোংরা। কেউ বমি-টমি করে গেছে। অথবা জানারায় কাচ নেই কিংবা খোলে না, বন্ধ হয় না। কোনও না কোনও একটা গণ্ডগোল আছেই। কিন্তু তেমন কিছু ওর নজরে পড়ল না। ও জানালা ঘেঁষে বসে পড়ল।

দেখতে দেখতে কামরা ভরে উঠল। ভিতরে হাত-পা ছড়িয়ে থাকা যায় তবু দরজাটা একেবারে ঠাসা। ওদের ভিতরে ঢুকতে বললেই বলবে, সামনে নামব। এই ‘সামনে’টা কারও কাছে যে শেষ স্টেশন, সেটা মাত্র দিনকতক ট্রেনে চড়েই এ বুঝে গিয়েছিল। ঠেলে-ঠুলে দু’-একজন মাঝে মধ্যে উঠছে। ট্রেনটা ছেড়ে দিয়েছে। জানালা দিয়ে হু হু করে আসা বাতাসের তোড়ে অমৃতের চুলগুলো পিছন দিকে প্রায় শুণ্যে তিরতির করে কাঁপতে লাগল। চোখ পিটপিট করতে লাগল ও। এক সময় জানালা থেকে মুখ সরিয়ে কামরার ভিতরে তাকাল। দেখল, ভিড় ঠেলে ঠেলে এগিয়ে আসছেন তার পাড়ার হরিহরবাবু। আসতে আসতে তার একদম রো ঘেঁষে দাঁড়ালেন। অমৃতের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই এক গাল হেসে বললেন, আইজও কিছু কিনলেন নাকি?
— তেমন কিছু না। ওই ক’টা কাপ।
— বাড়ি পাইলেন?
— খুঁজছি তো…
— সে তো অনেক দিন ধইরাই খুঁজতাছেন। তা কেমন বাড়ি চান?

কথাটা উনি এমন ভাবে বললেন, যেন বলামাত্রই তেমন একটা বাড়ি উনি জোগাড় করে দেবেন।

অমৃত বলল, মোটামুটি, থাকার মতো। কথা ক’টা মুখে বললেও মনে মনে বলল, আমি চাই এমন একটা বাড়ি, যেখানে ঘরে বসেই বোঝা যাবে সকাল হয়েছে, এমন আলো এসে ঢোকে। যেখানে বুক ভরে শ্বাস নেওয়া যায়। যেখান থেকে ওপরে তাকালে, যত কমই হোক, একটু আকাশ দেখা যায়। যেখানে দু’-একটা বন্ধুকে অনায়াসে আসতে বলা যায়। ইচ্ছে করলে, দরজা খোলা রেখে জ্যোৎস্না-রাতে হেঁটে যাওয়া যায় অন্তত বেশ খানিকটা পথ।

— মনে রাইখেন কিন্তু আমার কথাটা। মাইয়ারে নিয়া তো জামাই আলাদা হইব। ঘরের লাইগা পারতাছে না। যদি আপনের ঘরখান দেন তো… হাড় জিরজিরে লোকটার মুখে অদ্ভুত আকুতি।
— হ্যাঁ, মনে আছে। অমৃত বলল।
— শুনলাম কালিও নাকি আপনারে ধরসে…
— হ্যাঁ, ও বলছিল…
— আপনে কিন্তু আমারে দেইখেন। মাইয়াটা আমার আধখান হইয়া গ্যাসে। আপনে নিজের বুন মনে কইরা…
— ঠিক আছে, বললাম তো…
হঠাৎ অন্ধকার। নরেন্দ্রপুর থেকে সোনারপুর স্টেশনের মাঝখানে এইটুকু অংশে পাওয়ার থাকে না। দিনের বেলায় বোঝা যায় না। সন্ধ্যা হলেই মালুম হয়। মাত্র মিনিটখানেক। তারই মধ্যে ও দিক থেকে এক মহিলার গলা শোনা গেল, ঠিক হয়ে দাঁড়ান। অসভ্যের মতো…
ততক্ষণাৎ কে যেন একটা টর্চ জ্বালিয়ে কামরার সিলিঙে আলোটা ফেলল। ঠিকরে আসা আলোয় জ্যোৎস্না-জ্যোৎস্না মনে হতে না হতেই আবার আলো জ্বলে উঠল। বারুইপুর স্টেশনের দু’নম্বর প্ল্যাটফর্মে নেমে হরিহরবাবু অমৃতকে বললেন, আপনে আগান, আমি আইতাছি।
অমৃত দু’নম্বর থেকে নেমে রেললাইন পেরিয়ে এক নম্বর প্ল্যাটফর্ম ধরে হাঁটতে লাগল। গেট থেকে বেরোবার মুখে একটা গুমটি। সোডার জল বিক্রি হয়। খোলার সময় ফটাস করে আওয়াজ হয় বলে মুখে মুখে ওটার নাম হয়ে গেছে— ফটাস জল। আগে দু’রকমের হত। জিনজার ষাট পয়সা আর এমনি সোডার জলের দাম ছিল পঞ্চাশ পয়সা। নামী-দামি বিভিন্ন সফট ড্রিংসের বোতলে ভরা থাকত। একমাত্র সাউথ সেকশনেই এই জল পাওয়া যায়। বরফ-ঠান্ডা হলে তখন দশ পয়সা করে বেশি নিত। নুন-লেবু দিয়ে গ্লাসে সরবত করে দিলে আর একটু বেশি। এখন এমনি এক বোতল ফটাস জলের দাম চার টাকা। পকেট হাতড়ে দু’টাকার দুটো কয়েন এগিয়ে দিয়ে অমৃত বলল, একদম ঠান্ডা দেখে, আওয়াজ হয় যেন।

কেউ কেউ বলে জোরে শব্দ না হলে নাকি জলটা ভাল হয় না। এ কথা শুনে কাঁধের ব্যাগে বোতল নিয়ে ফেরি করতে থাকা এক জলওয়ালা একদিন বলেছিল, আওয়াজ শুনবেন, না জল খাবেন? এটা সূর্যপুরের জল…

চাবি দিয়ে ফটাস করে খুলে দোকানদার বোতলটা এগিয়ে দিল অমৃতর দিকে। বেশির ভাগ লোকই বোতলের মুখটা মুখে পুরে ঢক-ঢক করে খায়। না হলে নাকি ঠিক তৃপ্তি হয় না। অমৃত দোকানদারকে বলল, একটা পাইপ দিন না…

দোকানদার ওর দিকে একটা সবুজ রঙের স্ট্র বাড়িয়ে দিল। জল খেতে খেতে অমৃতর চোখ পড়ল ও পারের দু’নম্বর প্ল্যাটফর্মে। এ রকমই একটা গুমটির সামনে দাঁড়িয়ে জল খাচ্ছেন হরিহরবাবু। গুমটির বড় বাল্বটার আলো তাঁর উপর এমন ভাবে পড়েছে, এত দূর থেকেও তাঁকে স্পষ্ট চেনা যাচ্ছে।

তা হলে কি এই জন্যই উনি ‘আসছি’ বলে কেটে গেলেন। ভেবেছেন নিজে খেলে যদি আমাকেও খাওয়াতে হয়! সত্যিই কী ছোট মন এঁদের! অমৃত পা বাড়াল বাড়ির দিকে। বাড়িটা মল্লিকপুর আর বারুইপুরের মাঝামাঝি জায়গায়।

যখন ও ঘর নেয়, তখন শুনেছিল, কিছু দিনের মধ্যেই একটা স্টেশন হচ্ছে এখানে। সামনেই ভারতিয়া কোম্পানি। রেলের চাকা-টাকা বানায়। তিন শিফটে প্রায় হাজার তিনেক লোক কাজ করে। ওই ভারতিয়াই অনেকটা জমি ছেড়ে দিচ্ছে। এখন বাকি শুধু নির্ধারিত কিছু মান্থলি টিকিট হোল্ডার শো করা। ক্রসিংয়ের জন্য অবশ্য মাঝে মাঝে এখানে গাড়ি দাঁড়ায়। ফেরার সময় হলে লাফ দিয়ে নেমে পড়ে অমৃত। নামতে দেখে আরও দু’দশ জনকে।

‘খাড়ান’। পিছনে হরিহরবাবুর গলা শুনে দাঁড়িয়ে পড়ল অমৃত। ও পিছন ফিরতেই উনি বললেন, এক লগে যাই। আমার টর্চটা আবার… ব্যাটারিগুলান কালকাই রোদে না দিলে… বলতে বলতে এগিয়ে এলেন হরিহরবাবু। অমৃত অমনিই হাঁটছিল। দু’পাশে গাছের ঝাঁকড়া মাথাগুলোতে এতক্ষণ ঘাপটি মেরে ছিল অন্ধকার। উনি টর্চের কথা বললেই, ঝুপ করে তা যেন পথের ওপরে নেমে এল। অমৃত ব্যাগ হাতড়ে পেনসিল টর্চটা বের করল। আলো-বৃত্তের পিছু পিছু এগোতে লাগল ওরা দু’জন।

বাড়ি যাওয়ার পথে বাঁ হাতে একটা মুদিখানা দোকান। সেটার দাওয়ায় একটা বস্তা পেতে কতকগুলো ছেলে-ছোকরা তাস খেলছে। রাস্তায় ল্যাম্পপোস্ট আছে। কিন্তু আলো জ্বলে না। ওদের আসতে দেখে ওই ছেলেগুলোর কেউ কেউ মাথা তুলে দেখার চেষ্টা করল, কারা আসছে।

অমৃত মুড়ি কেনার জন্য দাওয়ায় উঠল। ওর রাতের খাবার বলতে, হয়-পাউরুটি, নয়-মুড়ি। একটু চিনি বা চিনি গোলা জল হলেই হল। হরিহরবাবু অপেক্ষা করতে লাগলেন। মুড়ির ঠোঙাটা ব্যাগে পুরে নীচে নেমে এল। আবার হাঁটতে লাগল সে। সঙ্গে হরিহরবাবুও।

অমৃতের দুটো বাড়ির পরেই হরিহরবাবুর বাড়ি। উনি বললেন, আলোটা এট্টু দেহান দেহি, ঢুইক্যা পড়ি।

অমৃত ওখানে দাঁড়িয়েই টর্চটা তুলে ধরল। আলোটা অত দূর পৌঁছল না। তার আগেই মিলিয়ে গেল। কিন্তু উনি না ঢোকা পর্যন্ত ও টর্চটা ধরেই রইল। দুটো বাড়ির মাঝখানে হাতখানেক চওড়া মেঠো পথ। সেটা ধরে কিছুটা এগোলেই পর পর বেশ কয়েকটা ঘর। টালির ছাউনি। প্রত্যেকটার সামনে একটু করে বারান্দা। রান্নার জন্য। সেখানে দরজা নেই। তার পরে ঘর। এ রকমই একটা ঘরের ভাড়াটে অমৃত। কোনও ঘরেই কোনও সাড়াশব্দ নেই। বেশি রাত অবধি জাগলে শুধু শুধু কেরোসিন পোড়ে। তাই এখানকার লোকেরা সন্ধ্যার পরেই শুয়ে পড়ে। ওঠে খুব সকালে। কারখানারই এক বন্ধু তাকে এই বাড়ির হদিশ দিয়েছিল। দেখেই পছন্দ হয়েছিল অমৃতের। বারুইপুর তো নিউ ক্যালকাটা। মানুষ এ ভাবেই এগোয়। এর পরে খোদ কলকাতা।

কাপগুলো পায়ের কাছে নামিয়ে রেখে ঘরের তালা খুলল অমৃত। হাতড়ে হাতড়ে চিমনি-বাতিটা জ্বালাল। দেওয়ালগুলো যেন দাঁত বার করে হাসছে। ইটের ফাঁকে ফাঁকে জমাট পুরু সুরকি ঠেলে বেরিয়ে এসেছে। ঘরময় স্তূপ করা জিনিসপত্র। এ দেয়ালে ঠেস দেওয়া খুলে রাখা পালঙ্ক, তো ও দেয়ালে লটকানো শিংওয়ালা ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাওয়া হরিণের মাথা। দেয়াল ঘেঁষে টাল করে রাখা বড় বড় বেশ কয়েকটা বোঁচকা। আচমকা এলে মনে হবে থিয়েটারে ভাড়া খাটানোর সাজ-সরঞ্জামের কোনও গো-ডাউন। ও দিকটায় শুধু বই আর বই। দরজার বাঁ হাতেই একটা সাবেকি ড্রেসিং টেবিল। নতুন কেউ এলে ঠিক মতো পা ফেলতে পারবে না। চলাফেরা করতে গেলে পাঞ্জাবির পকেটে আটকে যাবে খোঁচা হয়ে বেরিয়ে থাকা লম্বা কোনও কিছুতে অথবা কনুইতে ধাক্কা লেগে মাটিতে পড়ে চুরমার হবে দারুণ নকশা করা বড় ফুলদানিটা কিংবা কাত খেয়ে পড়ে যাবে এক মানুষ লম্বা ল্যাম্পস্ট্যান্ড।

নিজেকে নিংড়ে ও এগুলো কিনেছে। শুধু কেনাই তো নয়, নিয়ে আসাটাও যে কত হ্যাপার, সেটা কেবল ও-ই জানে। কখনও চেকারের হাত‌ে দু’-পাঁচ টাকা গুঁজে দিয়ে ট্রেনে তুলেছে, কখনও ম্যাটাডরে চাপিয়েছে কারও সঙ্গে শেয়ারে। কখনও আবার পেয়ারা বা লিচুর সিজনে বারুইপুর-শিয়ালদহ যাতায়াত করা জানাশোনা ট্রাক বা টেম্পোয় তুলে নিয়ে এসেছে সামান্য খরচে। যাতে চোট না লাগে, কী ভাবেই না বুকে আগলে এনেছে এ সব। এই কান ছাড়া বড় ঘোড়া, ও দিককার ওই চোঙওয়ালা গ্রামাফোন কিংবা কুচকুচে কালো রঙের ওই মাঝারি আলমারিটা। আনতে কত কষ্টই না হয়েছে… যত কষ্টই হোক, ঘরে একবার ঢুকিয়ে দেওয়ার পর সে যে কী আনন্দ, কী তৃপ্তি! কেবলই থেকে থেকে মনে হয়, কী যেন একটা পেয়েছি। কী যেন একটা পেয়েছি।

কাপগুলো একটা কোণে রেখে ব্যাগ থেকে বের করল মুড়ির ঠোঙাটা। নামিয়ে রাখল টি-পট আর প্লেটগুলো। তার পর আলনা থেকে একটা লুঙ্গি নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এল। ওর এক বন্ধু মাঝে মাঝেই স্নান না করে কাজে আসে। তার মুখেই ও শুনেছে, কলকাতায় তাদের জলের কষ্টের কথা। এখানে সে বালাই নেই। কী শীত, কী গ্রীষ্ম, বারো মাসই ও গা ধোয়। সে যত রাতই হোক না কেন।

অমৃত গা-টা মুছে ড্রেসিং টেবিলটার সামনে এসে দাঁড়াল। ড্রয়ার থেকে দাঁত ভাঙা চিরুনি বের করে চুলে বসিয়ে সামনে টানতে লাগল।
আঁচড়াতে আঁচড়াতে হঠাৎ ভ্রু কুঁচকে গেল ওর। কপালে দু’-তিনটে ভাঁজ দেখা দিল। চিরুনি নামিয়ে পেতে আঁচড়ানো চুল থেকে কয়েকটা চিমটি কেটে তুলে ধরল। আয়নায় দেখে দেখে খুঁজতে লাগল,এইমাত্র এক ঝলক দেখা সাদা রঙের চুলটা। একটা দুটো করে বাদ দিয়ে দিয়েও আলাদা করতে পারল না সেটাকে। আয়নায় ভাল করে তাকিয়ে দেখল, সব ক’টার রংই কেমন যেন ধূসর ধূসর। ছাই ছাই। গাল একদম ভেঙে গেছে। চোখ দুটো ঢুকে গেছে কোটরে। চামড়াগুলো কেমন যেন কুঁচকে কুঁচকে গেছে। হঠাৎ ওর মনে হল, ভুল দেখছি না তো! কী দেখছি আজ! বুকটা মোচড় দিয়ে উঠল ওর। গলার কাছটায় কী যেন একটা দলা পাকিয়ে আটকে গেল। এরই মধ্যে এই! তা হলে আর নতুন জীবন শুরু করব কবে! এখনও তো কিছুই জোগাড়যন্ত্র হল না।

দরজা জানালা বন্ধ করে একটা বোঁচকা টেনে বের করল অমৃত। একে একে বের করতে লাগল জামা, প্যান্ট, রাতের পোশাক। একটা একটা করে পরে আয়নার সামনে দাঁড়াতে লাগল। নিজেকে ভারী অদ্ভুত লাগল ওর। সেই কবে যে এ সব বানিয়েছিল! ঠিক ছিল, নতুুন বাড়িতে উঠে গিয়ে পরবে। কিন্তু এ কী! সেই বুক, সেই দেহ তার কই! আর এ কী কাটছাঁট! আজ এগুলো পরে বেরোলে লোকে তাকিয়ে থাকবে। ভাববে, পুরোনো পোশাকের ফ্যাশন শো-য়ে যোগ দিতে যাচ্ছে।

হাঁটুর কাছটা অসাড় হয়ে আসতে লাগল ওর। গায়ে আর জোর নেই। যেন এক্ষুনি হুড়মুড় করে ভেঙে পড়বে শরীরটা। তা হলে কি অনেক দিন হয়ে গেল? অনেক দিন! লক্ষ্মী আর আসবে না! কিন্তু ও যে এই সে দিন কথা দিল! পুকুরের জলে পা দোলাতে দোলাতে বাঁধানো ঘাটে বসে বলল, আমি তো তোমারই।

বলেছে যখন, তখন আসবেই। কিন্তু ঘুমিয়ে পড়লে যদি ডাক শুনতে না পাই! এসে যদি ফিরে যায়! তড়িঘড়ি উঠে ঝটপট করে ঘরের সব ক’টা জানালা দরজা হাট করে খুলে দিল অমৃত। ঘরের এক কোণে গুটিয়ে দাঁড় করানো ছিল মাদুর। ও সেটা ডাই করা বোঁচকাটার পাশে, এক চিলতে জায়গাটায় বিছিয়ে শুয়ে পড়ল। ব্যাগ থেকে বের করে রাখা মুড়ির ঠোঙাটা হাতের কাছে টেনে নিল। অন্যান্য দিনের মতোই খেতে খেতে ঘুমিয়ে পড়বে। দু’-এক মুঠো মুখেও দিল।

কোমরটা যেন ভেঙে যাচ্ছে। বুকের ভিতরটা কেমন করতে লাগল। বড় বড় কয়েকটা শ্বাস নিল অমৃত। ঘরের মধ্যে ঢুকতে লাগল এলোপাতাড়ি বাতাস। চোখ বুজে এল অমৃতের। দেখল, তিরতির করে সেই বাতাস বয়ে যাচ্ছে একটা ধান খেতের ওপর দিয়ে। ও পারে দাঁড়িয়ে আছে লক্ষ্মী। দু’হাত বাড়িয়ে তাকে ডাকছে। ঘোরের মধ্যেই ও চেঁচিয়ে উঠল, দাঁড়াও দাঁড়াও, আমি যাচ্ছি। আমি যাচ্ছি।

হঠাৎ ডানা ঝাপটানোর শব্দে ওর তন্দ্রা কেটে গেল। মনে হল, একটা বিশাল বড় পাখি বেরোনোর জন্য ঘরময় ছটফট করছে। চোখ মেলে তাকাল ও। চিমনিটায় ততক্ষণে কালি পড়েছে। শিখাটা তেরচা ভাবে উঠে দপদপ করছে। পাখিটা কোথায়! ওপরে চোখ তুলে দেখল, বাতাসের দাপটে দেয়ালে অনবরত আছাড় খাচ্ছে বহু বছরের পুরোনো একটা ক্যালেন্ডার। আর হাতের কাছে থাকা মুড়ির ঠোঙাটা কখন কাত হয়ে পড়ে সারা ঘর ছড়িয়ে পড়েছে। এলোপাতাড়ি দমকা বাতাসে তারই কিছু কিছু উড়ছে। ওগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে অমৃতের মনে হল, ওগুলো মুড়ি নয়, সাদা খই। শুধু সাদা খই।


ফেসবুক অ্যাকাউন্ট দিয়ে মন্তব্য করুন


সিদ্ধার্থ সিংহ

সিদ্ধার্থ সিংহ : ২০১২ সালের 'বঙ্গ শিরোমণি' সম্মানে ভূষিত সিদ্ধার্থ সিংহের জন্ম কলকাতায়। ১৯৬৪ সালে। ক্লাস নাইনে পড়ার সময়ই তাঁর প্রথম কবিতা ছাপা হয় 'দেশ' পত্রিকায়। প্রথম ছড়া 'শুকতারা'য়। প্রথম গদ্য 'আনন্দবাজার'-এ। প্রথম গল্প 'সানন্দা'য়। যা নিয়ে রাজনৈতিক মহল তোলপাড় হয়। মামলা হয় পাঁচ কোটি টাকার। ছোটদের জন্য যেমন সন্দেশ, আনন্দমেলা, কিশোর ভারতী, চির সবুজ লেখা, ঝালাপালা, রঙবেরং, শিশুমহল ছাড়াও বর্তমান, গণশক্তি, রবিবাসরীয় আনন্দমেলা-সহ সমস্ত দৈনিক পত্রিকার ছোটদের পাতায় লেখেন, তেমনি বড়দের জন্য লেখেন কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ এবং মুক্তগদ্য। 'রতিছন্দ' নামে এক নতুন ছন্দের প্রবর্তন করেছেন তিনি। এ পর্যন্ত প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা দুশো একচল্লিশটি। তার বেশির ভাগই অনুদিত হয়েছে বিভিন্ন ভাষায়। বেস্ট সেলারেও উঠেছে সে সব। এ ছাড়া যৌথ ভাবে সম্পাদনা করেছেন লীলা মজুমদার, রমাপদ চৌধুরী, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, মহাশ্বেতা দেবী, শংকর, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, সুচিত্রা ভট্টাচার্য, নবনীতা দেবসেন, রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়দের সঙ্গে। তাঁর লেখা নাটক বেতারে তো হয়ই, মঞ্চস্থও হয় নিয়মিত। তাঁর কাহিনি নিয়ে ছায়াছবিও হয়েছে বেশ কয়েকটি। গান তো লেখেনই। মিউজিক ডিরেক্টর হিসেবেও কাজ করেছেন বেশ কয়েকটি বাংলা ছবিতে। তাঁর ইংরেজি এবং বাংলা কবিতা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে কয়েকটি সিনেমায়। বানিয়েছেন দুটি তথ্যচিত্র। তাঁর লেখা পাঠ্য হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদে। ইতিমধ্যে পেয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ শিশু সাহিত্য সংসদ পুরস্কার, কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত পুরস্কার, কাঞ্চন সাহিত্য পুরস্কার, সন্তোষকুমার ঘোষ স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা লোক সাহিত্য পুরস্কার, প্রসাদ পুরস্কার, নতুন গতি পুরস্কার, ড্রিম লাইট অ্যাওয়ার্ড, কমলকুমার মজুমদার জন্মশতবর্ষ স্মারক সম্মান, কবি সামসুল হক পুরস্কার, সুচিত্রা ভট্টাচার্য স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার, অণু সাহিত্য পুরস্কার, কাস্তেকবি দিনেশ দাস স্মৃতি পুরস্কার, শিলালিপি সাহিত্য পুরস্কার, চেখ সাহিত্য পুরস্কার ছাড়াও ছোট-বড় অজস্র পুরস্কার ও সম্মাননা। পেয়েছেন ১৪০৬ সালের 'শ্রেষ্ঠ কবি' এবং ১৪১৮ সালের 'শ্রেষ্ঠ গল্পকার'-এর শিরোপা।

0 Comments

মন্তব্য করুন

Avatar placeholder

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।