চলচ্চিত্র সমালোচনা: The Machinist

সুরজ ভৌমিক on

the_mechinist

শুভাশীষ হোমওয়ার্ক দিয়েছিল, বলেছিল ক্রিস্টিয়ান বেল অভিনীত “দ্য মেসিনিস্ট” সিনেমাটি দেখতে। গতকাল রাত্রে ছবিটা ইউ টিউবে দেখলাম। সত্যি অনবদ্য একটি সিনেমা। সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার জঁর বা ধারার প্রকৃষ্ট উদাহরণ এই সিনেমাটি৷ সিনেমাটির শরীর জুড়ে রয়েছে হিচককিয়ান আবহ। ভীষণ ধূসর, স্লেটরঙ্গা একটা পটভূমি বেছেছেন পরিচালক ব্র‍্যাড অ্যান্ডারসন। সেই বিবর্ণ পটভূমিকা যেন সিনেমার প্রোটাগনিস্ট ট্রেভর রেজনিকের মনোভূমি। জাভি গিমেনেজ ও চার্লি জিমিনেজের ওয়াশড আউট, দানাদার সিনেমাটোগ্রাফি পরিচালকের ভাবনা কে আরো প্রসারিত করেছে। সিনেমা জুড়ে একটা দমবন্ধকরা টেনশন, চাপা আতঙ্ক, অস্থিরতার পরিবেশ যা ছবির নায়ককে এবং তাঁর সাথে দর্শককেও তাড়া করে বেড়াবে। ট্রেভর একজন দশটা-পাঁচটা ডিউটি করা ফ্যাক্ট্ররি কর্মী। তাঁর কঙ্কালসার চেহরা দেখে তাঁর পরিচিতদের মনে শঙ্কা জাগে। ট্রেভর কি কোনো অজানা রোগে আক্রান্ত? দর্শকদের মনেও একি প্রশ্ন জাগে। ক্রমেই জানা যায় ট্রেভর এক বছর ঘুমায়নি। সে ইনসোমনিয়া গ্রস্ত। ট্রেভরের ওই হতশ্রী চেহরা, তাঁর নিশিযাপন, তাঁর সাথে ঘরে বাইরে হতে থাকা অদ্ভুতুরে কান্ডগুলি ক্রমশই এক নিদারুণ পরিণতির দিকে নির্দেশ করে। ট্রেভরের নিঃসঙ্গ, মনোলোগ পূর্ণ রাত্রিযাপনের বিপরীতে রয়েছে দেহজীবি স্টিভি এবং বিমানবন্দরের ওয়েট্রেস মারিয়ার সাথে কাটানো উচ্ছ্বল মূহুর্তগুলি। স্টিভি নিছকই ট্রেভরের যৌনসঙ্গী নয়, ও ট্রেভরের একমাত্র স্বজন। মারিয়া যেন ট্রেভরের বদ্ধ জীবনে এক ঝলক টাটকা বাতাস। মারিয়া ও তার মৃগীরোগাক্রান্ত ছেলে নিকোলাসের সাথে কাটানো মূহুর্তগুলি ট্রেভর কে নিয়ে যায় নিজের ভীষণরকম হলুদ বাল্যবেলায়। পুরোনো ফোটো অ্যালবামের খাঁজে ট্রেভর খুঁজে নিতে চায় মায়ের বুকের ওম। কিন্তু সেই ব্যর্থ অন্বেষণ আরো বাঙ্ময় হয়ে ওঠে যখন সে নিজেকেই খুঁজতে থাকে সিনেমার প্রায় পুরোটা জুড়ে। Who are you? এই অমোঘ প্রশ্নটি ট্রেভরকে পুরো সিনেমা জুড়ে তাড়া করে বেড়ায়। ট্রেভরের এই অস্তিত্ব সংকট মনে করায় ক্রিস্টোফার নোলানের কাল্ট ক্ল্যাসিক “মেমেন্টো” র সেই হতভাগ্য রেট্রোগ্রেড অ্যামনেশিয়ায় ভোগা প্রোটাগনিস্টকে। কিংবা হয়ত ফিওডোর দস্তায়ভস্কির “দ্য ইডিয়ট” উপন্যাসের নায়ক প্রিন্স কে। তাই হয়ত এক দৃশ্যে দেখতে পাই আধঘুমন্ত ট্রেভরের হাতে “দ্য ইডিয়ট” উপন্যাসটি। দস্তায়ভস্কির উপন্যাসটির এলোমেলো কাঠামোর মতন এই সিনেমার চলন। মৃগীরোগাক্রান্ত প্রিন্স আর অ্যানোরেক্সিয়ায় ভোগা ট্রেভরের ন্যারেটিভ যেন একই ছকে, একই গতে বাঁধা। দুজনার অস্তিত্ব সংকট এই দুটি গল্পেরই প্রধান থিম। দুজনার জীবন আবর্তিত দুটি নারী চরিত্রকে কেন্দ্র করে। স্টিভি যেন দস্তায়ভস্কির প্রধানা নারীচরিত্র নাস্তাশিয়ার প্রতিরূপ। বই এবং সিনেমার এই দুটি নারী চরিত্র এক আত্মধংসী, মনোরোগীর প্রতি ধাবমানা। সিনেমাটি জটিল থেকে জটিলতর হয়ে ওঠে ইভান নামক একটি চরিত্রের কুহক উপস্থিতিতে। ইভান কি একজন রক্তমাংসের চরিত্র নাকি সে ট্রেভরের নিছকই এক কল্পনা? এই প্রশ্নের উত্তর ট্রেভর খুঁজে চলে পাগলের মতো। চলচ্চিত্রের ইভান চরিত্রটি যেন দস্তায়ভস্কির ম্যাগনাম ওপাস “দ্য ব্রাদার্স কারামাজভ” এর সেই নাস্তিক গল্প বলিয়ে ইভানের মতন। আর ট্রেভর যেন প্রিন্সের মতো একজন ইডিয়ট। যাকে ব্যাঙ্গ, বিদ্রুপে ভরিয়ে দেওয়া যায়, যাকে বক্রোক্তি করা যায়, যাকে পাগল বলে দেগে দেওয়া যায়। গল্পশেষে কি মিলবে সব প্রশ্নের উত্তর? ট্রেভরের জটিল মনস্তত্ত্বের কোনো হদিশ পাবে দর্শকেরা? জানতে হলে অবশ্যই দেখা উচিত এই সিনেমাটি। এই সিনেমাটি হয়ত আমার দেখা সেরা সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার নয়, কিন্তু এর টেক্সটবুক অ্যাপ্রোচটি আমার বেশ লেগেছে। আমাদের চেনাজানা পরিধির মধ্যে চেনাশোনা চরিত্রগুলি কে নিয়ে গল্পটি বলেছেন চিত্রনাট্যকার স্কট কোসার। তাই হয়ত দেখবার সময় একটা অজানা শিহরণ অনুভূত হয়েছে। খুব অবাক লাগে না যখন জানতে পারি এই স্কট কোসার পরবর্তীতে লিখেছেন “দ্য টেক্সাস চেইন ম্যাসাকার” এর মতন গা-শিউরানো চিত্রনাট্য। আলেইন বেইনের নিখুঁত প্রোডাকশন ডিজাইন ছবিটার মুড কে আরো স্থায়ী করে। রক বানোসের আবহ সঙ্গীত তাতে যোগ্য সঙ্গত দান করে। ব্যাস ক্ল্যারিনেটের যথেচ্ছ ব্যাবহার সেই মুড কে প্রলম্বিত করে। বেইনের প্রোডাকশন ডিজাইন এতটাই নিখুঁত যে পুরো শুটিং টা বার্সেলোনায় হলেও, ছবিতে মনে হয় শুটিং আমেরিকার কোনো শহরে হয়েছে। আগেই বলেছি, এই ছবিতে পরিচালক যে টেক্সটবুক অ্যাপ্রোচ নিয়েছেন, সেটা আমার বেশ লেগেছে। বিলম্বিত লয়ে প্লট ডেভলপমেন্ট আর একটা প্লট পয়েন্ট থেকে আর একটা প্লট পয়েন্টে যাত্রা সত্যি তারিফযোগ্য ও শিক্ষণীয়। তবে এই সিনেমার প্লট নয়, এই সিনেমার সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক বস্তুটি হলো ট্রেভর রূপী ক্রিস্টিয়ান বেল। এই সিনেমার চরিত্রায়নের স্বার্থে বেল ৬৩ পাউন্ড ওজন কমিয়েছিলেন। হয়ে গিয়েছিলেন এক জীবন্ত কঙ্কাল। ইন্টেন্স মেথড অ্যাক্টিং এর বর্ণপরিচয় মেলে ধরেছেন তিনি এই সিনেমাতে। অন্যকিছুর জন্য না, শুধুমাত্র বেলের জন্যই এই সিনেমা দেখা যায়। যারা অভিনয় শিখতে ইচ্ছুক, তাদের অবশ্যই এই সিনেমা দেখা উচিত। পরিশেষে বলি, দস্তায়ভস্কি কে বলা হয় ইউরোপে অস্তিত্ববাদ তত্ত্বের অন্যতম প্রবক্তা। কামু, সাঁত্রে, কাফকা তাঁর উত্তরসূরী। তাঁর প্রায় সবকটি উপন্যাস মানুষের জটিল মনস্তত্ত্বকে কাঁটাছেড়া করেছে। অস্তিত্বের নির্মান মানুষের মনোভূমিতে, এমনটাই বিশ্বাস করতেন দস্তায়ভস্কি। প্রোটাগনিস্টের অস্তিত্ব সংকট এই সিনেমার প্রধান উপজীব্য। ট্রেভর শুধু একটু ঘুমাতে চায়, কিন্তু যন্ত্রের সংস্পর্শে থাকা মানুষটি ক্রমশ যন্ত্রবৎ হয়ে পড়ে। যন্ত্রের কি ঘুম আসে?


ফেসবুক অ্যাকাউন্ট দিয়ে মন্তব্য করুন


সুরজ ভৌমিক

জন্ম: জুলাই, ১৯৭৯। নিবাস: দক্ষিণ দিনাজপুরের সদর শহর বালুরঘাট। পেশায় পশ্চিমবঙ্গ সরকার অধীনস্থ ভূমি ও ভূমি সংস্কার দপ্তরের রাজস্ব আধিকারিক। Jack of all trades, master of none. অল্পকয়েকটা বই পড়া আছে আর সিনেমা দেখা আছে, তাতেই একটু নিজেকে প্রকাশ করার চেষ্টা ।

0 Comments

মন্তব্য করুন

Avatar placeholder

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।