শুভ হুড়কো দিবস

… রাত এগারোটা। চৌকান এর জঙ্গল পেরিয়ে তখন দাপটে ছুটে চলেছে একটা মোটরবাইক। চালকের নাক অবধি মাফলার এ ঢাকা, কাঁধে দোনলা বন্দুক। মাইলের পর মাইল নিকষ কালো আঁধার পথ। দুপাশে শাল পিয়ালের জঙ্গল। পিচ রাস্তা পেরিয়ে কিছুটা লালমাটির পথ উঁচু নিচু হতে হতে ইউক্যালিপটাস এর জঙ্গল পেরিয়েছে। রাতের ইউক্যালিপটাস কামগন্ধী হয়, সে সৌগন্ধের রেশ টুকুতে হাড় হিম হয়ে যাচ্ছে মোটরবাইকের পিছনে বসা যুবতীটির। নভেম্বর মাস। মল্লভূম এর অচেনা জঙ্গলে সে সেই মুহূর্তে শুধু মাত্র আরোহী।
গন্তব্য; জঙ্গল পেরিয়ে।
কলজের ভিতর শহুরে অন্তর তখন হেমন্তের হাওয়ায় আর জঙ্গলের আঁধারে প্রমাদ গুনছে । প্রতি পলে মন বলছে…
”ঠিক করলাম তো এসে! একটা অজানা অচেনা মানুষের বিশ্বাসে ভর করে, বাইকে ভর করে , এই জঙ্গল রাজত্বে এসে! ঠিক করলাম তো! খুন হয়ে গেলে বডির তালাশ হবে? রেপ? রেপ্ হয়ে গেলে! যে রাস্তায় চলেছি সে রাস্তার শেষে আদৌ পৌঁছোনো যায় তো গন্তব্যে! যার জন্য এত বড়ো ঝুঁকি নেওয়া, মিলবে তো!”
মাথার ভিতর জট পাকানো একরাশ চিন্তা ডানা ঝাপটচ্ছে। এমনও হয়? এমন মতি হয় কি করে কারো? এতে নাকি দেশের হাল ফিরবে! বাস্তুহারার চাল ফিরবে! টেকো মাথার বাল ফিরবে!
তা ফেরে ফিরুক। পকেটে সাড়ে তিন হাজার মতো আছে। সাতটা পাঁচশোর নোট। আধা ঘন্টা পরে এগুলো কাগজ হয়ে যাবে। পাঁচশ টাকার নোটের এরোপ্লেন বানিয়ে পাছায় ফুঁ দিলে সোঁ করে গোঁত্তা খেয়ে পড়বে আলমারির পিছনে, ঝুল মাখবে ধূলো মাখবে, কেউ তুলেও আনবে না। পাঁচশ টাকার নোট। মানে হলো একটা কাগজের টুকরা। বাপের জন্মে এরম চুতিয়া বানিয়েছে কেউ!
রাত নটা থেকে গোটা মল্লভূম জুড়ে সাইকেল নিয়ে ঘুরপাক খেয়েছে সে। খবর টা একটু দেরি তে পেয়েছিল; আপনভোলা মানুষ। ততক্ষণে সমস্ত এ টি এম ফরসা। এসবি আই তে পুলিশ ঢুকতে দিচ্ছে না। বাকি দের ঝাঁপ বন্ধ। স্টেশন থেকে বাসস্ট্যান্ড, চকবাজার থেকে তুড়কি মোড় সব খোঁজা হয়ে গেছে। কোত্থাও নেই একটাও একশ টাকার নোট্। এই মালভূমি তে সাইকেল চালাতে বুকের খাল খিঁচে যায়। তবুও। সকাল ছটার শিরোমনি প্যাসেঞ্জার ধরতেই হবে। টাকা না থাকলে কলকাতায় পা দেবে কি করে তিনটে মানুষ! বাড়ি যে ফিরতেই হবে ! ছেলের ভ্যাকসিন , মায়ের লাইফ সার্টিফিকেট। বাড়ি যে ফিরতেই হবে…
নগরীর একমাত্র এসবিআই ই-লবি তে তখন বাওন বোষ্টম সাঁওতাল সোরেন মুর্মু একসাথে আওয়াজ দিচ্ছে, “আয় বেরিয়ে আয়”। ব্যাঙ্ক ম্যানেজার পুলিশি প্রহরায়। ঘড়িতে রাত এগারোটা। আশেপাশে আর দ্বিতীয় কোনো মেয়েমানুষ চোখে পড়ছে না কোত্থাও। ফিরে যাওয়া ছাড়া কি উপায়!
ফিরেই যাচ্ছিলো।
পিছু ডাকলো আদিবাসী মরদ্। স্টেট ব্যাংকেরই সিকিউরিটি গার্ড। চুল ছাঁটা। কাঁধে বন্দুক।
চুপি চুপি এসে বললো… ” ইদিকে কুথাও মিলবেক লাই মেডাম্। চৌকান পেরিয়ে চলে যান, আজ সন্ধা বেলা টাকা ভরা হইছে ঐ এ টি এম এ “
বুক কাঁপে যুবতীর। সে তো বহুদূর। বিডিও অপিস ছাড়িয়ে , জঙ্গল তো! সাইকেল নিয়ে? মরণ হবে।
উপায় দিলো চুল ছাঁটা …. ” মেডাম্, সাইকেল টো ঢুকিয়ে দিচ্ছি ব্যাঙ্কের ভিতর। চাবি মেরে দেন, কেউ লিবেক লাই। চলেন আমার বাইকে। আমু তুলে লুবো একশো টাকা। সোকালে যদি না পাই। আমার সঙে আসেন।”…
বড়ো বাজারে কালোব্যাপারী দের নাকি সমূহ বিপদ হয়েছিল সেদিন। আছোলা বাঁশ ঢুকেছিল কালোধনওলা দের।
আর আমার মতো যাদের না আছে ব্যাপার না আছে ধন, তাদের পিছনে তৈলমর্দিত হুড়কো টি ঢুকেছিলো কোন অভিপ্রায়ে আজ বড়ো জানতে ইচ্ছে করে। জানতে ইচ্ছে করে এই একটা মহাজাগতিক নাটুকে ছ্যাবলামির জেরে যে কোটি কোটি আওয়াম্ সেদিন জ্বলে মরলো, লাইনে মরলো, হাতে মরলো, ভাতে মরলো, তাদের জন্য কোন অ্যাপোস্টলিক অর্থনীতি ছিঁড়ে আপনি আঁটি বেঁধে দিলেন! খিস্তির ভিতর বিপ্ এর মতো দুহাজারী নোটের চিপ্ হয়ে রয়ে গেলো আপনার ভাঁওতা। কেউ দেখতেও পেলো না, অথচ জানতেও চেলো না, … “রাজা তোর কাপড় কোথায়!!!”
আজ ৮ ই নভেম্বর।
ভারতের আমজনতার প্রথম অর্থনৈতিক হুড়কো দিবস।
একবার মনে করিয়ে দিলাম।
2 Comments
Subhrasi Basu · নভেম্বর 10, 2019 at 11:26 পূর্বাহ্ন
Somokalin sarbojonin protikul churanto protikul obosthar ekti nitol onughotona. Sthaniyo kothyovasha jeno ‘Dekhinai fire’ rke mone koriye dichchye…. otisoyokti noy etotuku
Subhrasi Basu · নভেম্বর 10, 2019 at 11:32 পূর্বাহ্ন
Somokalin sarbojonin protikul churanto obosthar ekti nitol onughotonar çhabi. Sthaniyo kothyovasha jeno ‘Dekhinai fire’ ke mone koriye dichchye…. otisoyokti noy etotuku