একজন টিকটিকি (পর্ব – ৬)

শুভ্রদীপ চৌধুরী on

ekjon_tiktiki

হরিমতি উচ্চ বিদ্যালয়ে খুব জরুরি মিটিং চলছে। অন্যদিনের চেয়ে আজ অনেক আগে ছাত্রছাত্রীদের ছুটি দেওয়া হয়েছে।
হেডস্যার সাধনবাবুর পাশে গম্ভীর মুখে বসে আছেন ম্যানেজিং কমেটির সেক্রেটারি রীতেশ সাহা।ভদ্রলোক জরুরি মিটিং- এর ডাক শুনে প্রথমে আসতে চাননি। জরুরি বিষয়টা ঠিক তার পছন্দের নয়। বহু অভিজ্ঞতা তাকে একপ্রকার নিশ্চিত করেছে, এসব জরুরি  মিটিং- এ কাজের কাজ কিছু হয় না।
মিটিং শুরু হবার কিছুক্ষণের মধ্যে তার ধারণা পাল্টেছে। মনে হচ্ছে না এলে ভুল হত।এমন একজন মানুষকে নিয়ে আলোচনা হচ্ছে যাকে তিনি ঠিক চেনেন না। তবু মানুষটার সম্পর্কে যত শুনছেন ততই অবাক হচ্ছেন।

হেডস্যারের টেবিলের চারপাশে বেশ কিছু চেয়ারে বসেছেন  অন্যান্য শিক্ষক, শিক্ষিকা ও শিক্ষাকর্মীরা। 

হেডস্যারের দীর্ঘ ভাষণের পর সুদাম দত্তের দিকে তাকালেন, “সুদামবাবু, আপনি লাইব্রেরিরর বিষয়টা বলুন।দীনবন্ধুকে জানতে হলে এই ঘটনাটি মাথায় রাখতে হবে।”

“লাইব্রেরির বিষয়টা আপনারা জানতে চাইছেন বলেই বলছি, দীনবন্ধু মন্ডল মানুষটাকে আমার কখনও জটিল বলে মনে হয়নি। অনেকেই দেখে থাকবেন ওনার সংগে আমার টুকটাক কথা হত। সবে কাজে লেগেছেন উনি। আমায় চা দিতে এসে একদিন উনি বললেন , স্কুলের লাইব্রেরির চাবি আপনার কাছে থাকে স্যার?আমায় আরও অবাক করে বলেছিল, লাইব্রেরিটা আমায় খুলে দিলে আমি একটু বই-টই পড়তাম। আমি সাধনববাবুকে জানিয়ে এর পর বেশ কিছুদিন ওনাকে লাইব্রেরি খুলে দিয়েছি।”  একটানা কথাটুকু বলে থামলেন জিওগ্রাফির শিক্ষক সুদাম দত্ত।

হেডস্যার সুদামবাবু বললেন, “আমি ভেবেছিলাম একজন মানুষ পড়তে চাইছে। বইপত্র গুলো ভাল থাকবে।নিয়মিত লাইব্রেরি খোলা হয় না।তাই অনুমতি দিয়েছিলাম।আজ যখন বিভিন্ন  মানুষ দীনবন্ধু মন্ডলের সম্পর্কে খোঁজ খবর নিচ্ছেন তখন আমার মনে পড়ে লাইব্রেরিরর কথা। আমি নিজে লাইব্রেরি যাই।তালা খুলে উনি যেখানে বসতেন তার সামনের ডেস্কে তিনটে বই আর একটা দিস্তা খাতা পাই। ওনার পড়া বইগুলোর নাম শুনলে আপনারা প্রত্যেকেই চমকে যাবেন। আমি নিজেও অবাক হয়েছি।  আপনাদের নিশ্চয় কৌতুহল হচ্ছে বই গুলোর নাম জানতে? আমি থানায় জানিয়েছি।এবার আপনাদের বলি, প্রথম বইটির নাম,’দ্য সাইকোলজি অব দ্য সিম্পসনস’।  মনস্তত্ত্বের বিশ্লেষণ করে এমন একটি ইংরেজি ভাষার বই।এই বইটি উনি পড়েছিলেন তার নিশ্চিত প্রমান আমি পেয়েছি। বইটি প্রকাশিত হয় ১ মার্চ ২০০৬ সালে।আপনাদের নিশ্চয় মনে আছে, বছর দুয়েক আগে আমাদের এক প্রাক্তন ছাত্র আমেরিকা থেকে স্কুলের লাইব্রেরির জন্য বেশ কিছু বই পাঠিয়েছিল। এই বইটি ছিল ওর মধ্যে।

এবার দুই নম্বর বইটির কথা বলি, ‘পোকামাকড়ের অদ্ভুত জীবন’ নামের এই বইটি থেকেও বিশেষ বিশেষ লাইন গুলো খাতায় লিখে রেখেছেন।

তিন নম্বর বইটির নাম, মৌলানা আবুল কালাম আজাদের ‘ভারত স্বাধীন হল’।

এই তিনটি বই ছাড়াও তিনি এমন কিছু  কথা,চিঠি  সেই খাতায় লিখে রেখেছেন যা দীনবন্ধু মন্ডলের মত মানুষ লিখবে এটা আশা করি না। অনেক লেখার মধ্যে একটা চিঠির কয়েক লাইন আপনাদের শোনাই। চিঠিটা মাকে উদ্দেশ্য করে লেখা।

  ” মা,
             গতকাল রাতে  নিজেকে নিয়ে খুব ভাবলাম। বহুক্ষণ ভাবার পর মনে হল, আমরা এক একটা মানুষ আসলে আশ্চর্য পুতুল, যাকে জীবন্ত মানুষের মত সাজিয়ে রাখা হয়েছে। এই জীবনের মঞ্চে যখন সে হাসে, নিজের মত বাঁচে কিংবা  সফল হয়। সবাই হাততালি দেয়। কারণ দর্শক তার হাত পা কিংবা মাথা থেকে শূন্যে উঠে যাওয়া সুতোগুলো দেখতে পায়না। ভাবে এটা বুঝি তার নিজের কৃতিত্ব।  আমি জেনে গেছি, দেখেছি,আমাদের এই জগতে খুব আলোর মধ্যেও থাকে থিকথিকে  সব হারানো অন্ধকার । যা সত্যি গুলিয়ে দিতে পারে।
মুগ্ধ দর্শক  কোনো দিনই পুতুলের হাঁটাচলা, দৌড়, জয়ের পেছনে ঘাপটি মেরে বসে থাকা সেই লোকটিকে দেখতে পায় না। বলা ভাল দেখতে চায় না। পেলেও পুতুলের গল্পে এতই সে ডুবে গেছে যে কিছুতেই অন্যকিছু নিয়ে ভাবতে চায় না।
যেমন তোমায় ভুলে গেছে সবাই। ভুলে যাবার মত সহজ আর কিছু নেই। তুমি বলতে সত্য ভুলে থাকা যায় না।সে বেরিয়ে পড়বেই। আমার অবশ্য তা মনে হয় না। মন্ত্রগুপ্তি’র কথা আজীবন মেনে চললে কেন মা। বিশ্বাস কর বাবাকে আমার আর খারাপ মানুষ মনে হয় না। খুব বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে, এই পৃথিবীতে খারাপ মানুষ ভাল মানুষ বলে কিছু নেই।  কঠিন পরিস্থিতির সামনে মানুষ হয়ে থাকার নাম জীবন।যে লোকটাকে খুব ভাল বলে মনে হচ্ছে আসলে সে ভয়ংকর পরিস্থিতির সামনে কখনও দাঁড়ায়নি। অনেকটা সাপ লুডোর মত। সাপের মাথা বাঁচিয়ে গন্তব্যে পৌঁছে যাওয়া।  তাই না মা?”

সাধনবাবু থামতেই ম্যানেজিং কমিটির সেক্রেটারি বললেন, “আপনার কথামত এই মানুষটি  খুন করেছে এবং জেল খেটেছে এসব কার মাধ্যমে জানলেন?”

সাধন বাবু উত্তর দিলেন, “থানার একজন ইনফরমার আছে। তার নাম জগদীশ। ও প্রথম খবরটা দিয়েছিল। নিশ্চিত হবার জন্য আমি থানাতে খোঁজখবর  নিয়ে জানতে পারি খবরটা ঠিক। দীনবন্ধু সাজা খেটে বেরিয়েছে তিনবছর আগে। এর আগে  এক সেরেস্তায় কাজ করত। সেটা দুম করে চলে যাওয়াতে আমাদের এখানে কাজে ঢুকেছিল। ওর আসল কাজ বিভিন্ন জনের খবরাখবর সংগ্রহ করে জায়গা বুঝে বিক্রি করা।”

শিক্ষকদের কেউ একজন বলল, “তবে দীনবন্ধুকে থানা থেকে ছেড়ে ছেড়ে দিল কেন?”

সাধনবাবু এই প্রশ্ন উত্তর দেবার জন্য যেন অধীর অপেক্ষায় ছিলেন, ” আমিও অবাক হয়েছিলাম।পরে জগদীশের সংগে কথা বলে পুরোটা বুঝেছি। “

সুদাম দত্ত বললেন,  “জগদীশ কী বলল?

সাধন বাবু বললেন,”জগদীশ আমায় বলেছে, দীনবন্ধু যাতে কিছুই আঁচ না করতে পারে তার জন্য ছেড়ে দিয়েছে। ভেতরে ভেতরে বেশ কয়েকজন ওর উপরে নজর রাখছে। ও আসলে এমন ভয়ংকর কিছু করতে যাচ্ছে যা আমরা কেউ এখনও বুঝে উঠতে পারছি না।”

রীতেশ সাহা বললেন, “কেমন করে নিশ্চিত হওয়া গেল এই  দীনবন্ধু মন্ডল মানুষটি ভয়ংকর কিছু করতে চলেছে?”

সাধনবাবু বেশ কিছুক্ষণ চুপকরে থেকে বললেন, “তেমন জোরালো প্রমাণ নেই। তবে এই শহরের তিনজন মানুষকে সে চোখে চোখে রেখেছে। ভেবেছিলাম আজ বলব না । এদের মধ্যে তিন নম্বর মানুষটি হলেন আপনি। আশাকরি আপনি অবাক হয়েছেন।”

মুহূর্তের মধ্যে রীতেশ সাহার মুখ পালটে গেল। চাপা গলায় সে বলল, “আমি ছাড়া আর দু’জন মানুষের নাম কী?”

সাধনবাবু এই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বললেন, “ধরে নিন এক আমি, দুই প্রণব বসু।”

“প্রনব বসু! মানে হিস্ট্রির অধ্যাপক প্রণব বসু?”

“ইয়েস। আমরা এখনও জানি না দীনবন্ধু আসলে কী করতে চলেছে! তবে সাবধান থাকাটাই আমাদের পক্ষে ভাল হবে।”

ঘরের বাইরে থেকে খসখসে গলা ভেসে এল, “আমি জগদীশ! ভেতরে আসতে পারি স্যার? “

অনুমতি মিলতেই জগদীশ ঘরে ঢুকে চমকে  গেল। ঘরভর্তি মানুষ। এত মানুষের সামনে দীনবন্ধুর গোপন কথাগুলো বলবে কেমন করে!


ক্রমশ…


পড়ুন, এই ধারাবাহিক উপন্যাসের আগের পর্ব।

ফেসবুক অ্যাকাউন্ট দিয়ে মন্তব্য করুন


শুভ্রদীপ চৌধুরী

শুভ্রদীপ চৌধুরীর জন্ম ১ জানুয়ারি ১৯৮৩। গ্রামের নাম ইদ্রাকপুর। বাংলাসাহিত্য নিয়ে পড়াশুনা। প্রথম গল্প প্রকাশ ২০০৪ সালে। বিভিন্ন সংবাদপত্র ও পত্রিকায় নিয়মিত লেখালেখি করেন। বর্তমানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা সূত্রে বালুরঘাটে থাকেন। অক্ষরে আঁকেন গল্প। লেখকের কথায়, জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত যা শেখায়, "যা মনে করায় তার প্রতিচ্ছবিই আমার লেখা"। যোগাযোগঃ subhradip.choudhury@gmail.com

0 Comments

মন্তব্য করুন

Avatar placeholder

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।