একলা আকাশ

এরিনা ঘোষ on

দিন-এক

গাঢ় সবুজ মস আর দীর্ঘ বৃক্ষে ঢাকা অরন্য পথে আমরা সকাল থেকেই চলছিলাম।মাঝে কিছু সময়ের বিরতি নিয়ে আবার ও চলা।এই ডায়েরি পেন পিঠের ব্যাগেই ছিল আমার।আজ চারদিন হোল ওরা আমাকে কিডন্যাপ করেছে।
হোলি চাইল্ড স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেছিলাম মাস দুই হয়েছে।দাদার সঙ্গে পাহাড়ি এই আধা শহরে আসবার পর সময় কাটতেই চাইতোনা আমার।আসামের এই বনান্চল খুব সুন্দর।কিন্তু আমরা চলেছি অনির্দিষ্ট পথে।প্রথমটায় না বুঝলেও এখন এদের ভাঙা ভাঙা কথায় বুঝেছি এরা বোরো জঙ্গি যাদের কোন এক মাথা কে গ্রেফতার করেছে আই বি। জঙ্গল ঘেঁসা আমাদের স্কুল টাই ছিল ওদের সফ্ট টার্গেট। বলির ছাগল হলাম আমি আর জোৎস্না গগৈ।
জোৎস্না তেজী মেয়ে।প্রতিবাদ করায় কালকেই গুলি খায়।রাস্তাতেই ওকে ফেলে এগিয়ে আসি আমরা।

দিন-দুই

পুরো উপত্যকা জুড়ে রঙীন ফূল ফুটে আছে।গত রাত থেকে বেশ জ্বর এসেছে আমার।কিছু একটা পোকা কামড়েছিল ঝোপে প্রাকৃতিক কাজ সারার সময়।পাঁচদিন হোল এদের তিন জনের সঙ্গে চলেছি।শুরুতে ভয় পেলেও এটুকু বুঝেছি এরা আর যাই হোক ধর্ষনকারী নয়।চুপচাপ কথা শুনে চলা ছাড়া উপায় ও নেই কোন।দুচোখে ঘুম নেমে আসছে আমার।বিষক্রীয়ায় এমনটাই হয়।কে জানে আর কখনো মাধবীলতা ঘেরা দাদার ঐ কোয়ার্টার এ ফিরতে পারব কিনা। কলকাতার বাড়িতে বাবা মা কে দেখতে পাব কিনা।চোখের কোনায় জল গড়াচ্ছে আমার।এ অবস্হায় আমায় নিয়ে চলা সম্ভব না।বেতের কন্চি ঘেরা মাটি লেপা নীচু চালার একটা ঘরে ঠেলে দিল আমায়। মাটিতে বিছানো খড়ের ওপর লুটিয়ে পরার আগে দেখলাম ওকে।মুখের কালো কাপড়টা খসে গেছে।কাঁধ পর্যন্ত লম্বা চুলে ঢাকা এক নিস্পাপ মুখ।জোৎস্না কে কি ওই গুলি করেছিল? বন্ধ হয়ে গেল কন্চির ঝাঁপ।

দিন-ছয়


তিন দিন জ্বরে বেহুঁশ থাকার পর আজ আবার লিখছি। মানুষ যে এভাবেও বাঁচে এখানে না এলে জানা হোতনা।খাবার বলতে পাহাড়ের গায়ে ঝুম চাষে পাওয়া মোটা চাল আর জঙ্গল খুঁজে আনা মূল কন্দ কি শাকপাতা।কোন জংলি ভেষজ খাইয়েই আমার বিষ নামানো হয়েছে।যদিও উঠে দাড়ানোর ক্ষমতা এখনো নেই।সেদিনের সেই তরুন আর এ গ্রামের এক প্রৌঢ়া ছাড়া আর কাউকেই দেখছিনা। রিষণ আধভাঙা হিন্দিতে যা বলল বুঝলাম ওরা আমার বদলে সুবিরদাদা নামের ওদের ঐ পান্ডাকে ছাড়াবে।কিন্তু সমস্যা হয়েছে সুবির বরুয়া পুলিশ কাষ্টাডিতে থার্ড ডিগ্রী চার্জে অসুস্হ হয়ে জেল হাসপাতালে ভর্তি।সে ঠিক না হওয়া পর্যন্ত আমাকেও ঠিক রাখতে হবে ওদের।রিষনের দায়িত্বে আমায় রেখে ওরা গেছে ছাব্বিশ মাইল দূরে তিনসুকিয়ায় খাবার ওষুধ আর অস্ত্র আনতে।তেড়ছা ভাবে এসে পরা একফালি চাঁদের আলোয় রিষনের মুখে শুনেছি ওর জীবনের কথা।গৌহাটির এক অনাথ আশ্রমে ক্লাস টেন পাশ করার পর মোটোর মেকানিকের কাজ শিখতে তিনসুকিয়া আসে ও। মোটর গ্যারেজের মালিকের সঙ্গে থাকা খাওয়া ও নাম মাত্র পারিশ্রমিক এর বদলে যে হাড়ভাঙা খাটনি হোত তাতে একটু একটু করে শেষ হয়ে যাচ্ছিল যখন হঠাৎ দেখা সুবির দাদার সঙ্গে।প্রত্যন্ত গ্রামে থাকা পিছিয়ে থাকা মানুষের জন্য ওরা ডাকাতি করত পয়সাওয়ালা লোকেদের বাসায়।দূরে বয়ে চলা পাহাড়ি ঝরনার শব্দ রাতচড়া পাখির ডাক হিম কুয়াশা মোড়া এই উপত্যকা আর রিষের নীচু আওয়াজে একটু একটু করে একাত্ব হয়ে যাচ্ছিলাম আমি ওদের এই লড়াই এ।

দিন-সাত


পোষাকের অবস্হা এত খারাপ ছিল যে প্রৌঢ়ার দেওয়া রোঁয়া ওঠা পশমের পেঁচালো কাপড় টাই পরতে হোল।ঝরনার জলে স্নান সেরে একগোছা বুনোফুল মাথায় দিতেই দেখি রিষণের অবাক দৃষ্টি।অলক্ষে হাসা বিধাতা বোধহয় অন্য কিছু লিখেছিল আমাদের জন্য।সাত দিন হয়ে গেছে এই গ্রামে।গতরাত থেকে তুমুল বৃষ্টি নেমেছে।এই অন্চলে সবচাইতে ভয় বিষাক্ত সাপের।মাটি লেপা খড়ের চাল বেয়ে জল নামছে।মৃদু প্রদীপের আলোয় খাবার যা ছিল শেষ করতেই রিষণ জানাল কালকে খাওয়ার মত আর কিছু নেই।মাত্র নয় ঘর লোক থাকে এখানে। সব মিলিয়ে ঊনত্রিশ জন।প্রান বাচাঁতে হলে এ জায়গা ছেড়ে উপত্যকা ছেড়ে পাহাড়ের ওপাশের বৃষ্টিচ্ছায় এলাকায় যেতে হবে।
এদিকে তিনসুকিয়া থেকে বাকিদের ফেরার সময় পেরিয়ে গেছে।এখন এখানে থাকলে না খেয়ে জলে ভিজে মরতে হবে।

দিন-দশ


হিসেব রাখতে আর ইচ্ছে করে না আমার।তিন দিন একটানা হেঁটে পাহাড়ের প্রায় ওপরে পৌঁছেছি।আমাদের দলের একটা বাচ্চাকে পথেই সাপ কামড়েছে।বাকলের দোলায় করে ওকে নিয়ে হাঁটছে রিষণ।এখন আর ও মুখ ঢাকেনা।রিষণ ডেকার পুরোটাই তো এখন জানা।কি আর হবে ঢেকে।এখন আমি মাটি খুঁড়ে কন্দমূল বার করে আগুনে ঝলসাতে শিখেছি।একটু একটু করে ভুলে যাচ্ছি শহুরে অভ্যাস গুলো। কাল রাতের পর শহরে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছেটাও নেই।একটানা বৃষ্টিতে ভিজে কান্ত আমরা পাহাড়ের এক গুহা কন্দরে আশ্রয় নিয়েছিলাম।গুহামুখে পাথরের খাঁজে আগুন জ্বেলে সারারাত পাহারা দিয়েছে রিষণ।দলের ছটা শিশুর সঙ্গে আমাকেও। ঘাড়ে করে পার করিয়েছে নালা।আর সবশেষে শুকনো বৃষ্টিচ্ছায় অন্চলে পৌঁছিয়ে যখন ওদের লোকের দেখা পেয়ে জেনেছি সুবির বরুয়া জেল হাসপাতালেই মারা গেছে কি জানি কেন এক অদ্ভুত ভালোলাগা হয়েছে হয়তো আমায় আর ফেরত দেবে না ভেবে।

ডায়েরির বাকি পাতা গুলো জলে ভিজে ঝাপসা।রাকা এই প্রত্যন্ত অন্চলে রিষণ ডেকার সঙ্গে আট বছর ঘর করেছে বাবা মা কে কি করে জানাবে ভেবে পাচ্ছিল না কুশল।ওর কাছে থাকতে এসেছিল বোনটা।শখের চাকরিতে স্কুল টিচার হিসেবে জয়েন করেছিল মিশনারি এক স্কুলে।বোরো জঙ্গিদের একটা দল ওকে আর সঙ্গে আরেকজন টিচারকে তুলে নিয়ে গেছিল।প্রথম কিছু মাস অনেক দৌড়োদৌড়ি করে হাল ছেড়ে দিয়েছিল ওরা।আসামের চাকরি ছেড়ে ফিরে গিয়েছিল কলকাতায়।আজ এই আটবছর পর পুলিশের ডাক পেয়ে খুঁজে খুঁজে এখানে এসে পৌঁছানোর আগেই চিরদিনের মত চলে গিয়েছে রাকা। রিষণ ডেকার পুলিশের গুলিতে মৃত্যুর সময় সামনে আড়াল করেছিল রাকা।প্রচুর রক্তপাতে ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া রাকার মৃত মুখ টাকেও অচেনা লাগে কুশলের।পুলিশের ডাকে সম্বিত পেয়ে দেখে কোঁকড়া চুলের একটা বছর পাঁচেকের ছেলে অবাক চোখে দেখছে।ঠিক যেন কলকাতার বাড়িতে ছুটে খেলে বেড়ানো ছোট্ট রাকা।কি করে সব ভুলে এমনটা করল রাকা। ক্লিয়ার কেস অফ স্টকহোম সিনড্রোম মশাই।গম্ভীর গলায় বললেন পুলিশ হাসপাতালের সুপার।কে জানে।বড্ড আবেগী ছিল বোনটা। সাইকোলজির শক্ত মানে বোঝে না কুশল।ছোট্ট মুঠিটা ধরে এগিয়ে চলে।অনেক দায়িত্ব এখন ওর। ওকেই এখন আগলাতে হবে রাকার এই অমূল্য ভালোবাসাকে।


ফেসবুক অ্যাকাউন্ট দিয়ে মন্তব্য করুন


এরিনা ঘোষ

পেশা — সিভিল ইন্জিনিয়ার, নেশা — বই ও কবিতা, অবসর বিনোদন — লেখা ও পশুপাখির সঙ্গে সময় কাটান।

0 Comments

মন্তব্য করুন

Avatar placeholder

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।